✷ De-industrialization {অবশিল্পায়ন}
ロ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশের অবাধ বাণিজ্য ওঅসম শিল্পনীতির জন্য ভারতের চিরাচরিত ও ঐহিত্যশালী কুটিরশিল্পের যে ধ্বংসসাধন ঘটে তা 'অবশিল্পায়ন’ বা 'De-Industrialization' নামে পরিচিত। দাদাভাই নওরােজি, রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গােবিন্দ রাণার্ডে প্রমুখ জাতীয়তাবাদী লেখক এ ব্যাপারে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পরবর্তীকালে রজনী পামদত্ত, গ্যাড়গিল, বি. ডি. বসু, ড. নরেন্দ্রকৃয় সিংহ, ড. বিপান চন্দ্র, ড, অমিয় বাগচি প্রমুখ এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন।
অষ্টাদশ শতকে ভারত ছিল এক শিল্প-সমৃদ্ধ দেশ। বিদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যাদির চাহিদাও ছিল ব্যাপক। ইংল্যান্ড ও ইউরােপের প্রায় প্রতিটি দেশে ভারতের রেশম ও সুতিবস্ত্র প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এর ফলে ইংল্যান্ড-সহ ইউরােপের বিভিন্ন দেশের কলকারখানায় মন্দা দেখা দেয় এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের চাপে ১৭০০ এবং ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে আইন পাস করে ভারতীয় বস্ত্রাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপিত হয়। ১৭৪৭, ১৭৫৯ এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে আমদানিকৃতভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরােপ করা হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে কোম্পানির দালালরা এদেশের তাঁতিদের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে একমাত্র কোম্পানির জন্যই সুতিবস্ত্ৰ বুনতে বাধ্য করে। এজন্য তারা তাঁতিদের জোর করে অগ্রিম নিতে বাধ্য করত। অগ্রিম নেওয়া তাঁতি লােকসান স্বীকার করে বাজার দরের চেয়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কম মূল্যে তার বস্ত্র কোম্পানিকে বিক্রি করতে বাধ্য হত।
তাঁতিরা আগে দক্ষিণ ভারত থেকে তুলাে আমদানি করত, কিন্তু কোম্পানি পরে নিজেই সেই তুলাের সবটা কিনে নিয়ে মন প্রতি ১৪/১৫ টাকা বেশি দামে ওই তাঁতিদের তা কিনতে বাধ্য করে। এর ফলে
তাঁতিরা বেশি দামে তুলাে কিনে কম দামে বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে কেনা ও বেচা দুদিকেই তাদের ক্ষতি স্বীকার করতে হত। এই লােকসান ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাজার হাজার তাঁতি দেশত্যাগ করে এবং অনেকে দায়িত্ব এড়াবার জন্য নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে ফেলে। এর ফলে সমৃদ্ধ জনপদগুলি শ্রীহীন ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের পর উন্নত মানের ও সস্তা দামের ব্রিটিশ পণ্যাদি জলস্রোতের মতাে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যগুলি বিনা শুল্কে ভারতে প্রবেশ করে এবং দেশে- বিদেশে সর্বত্র ভারতীয় পণ্যাদির ওপর বিরাট করের বােঝা চাপানাে হয়। এই অসম প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্পগুলির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এর ফলে কেবলমাত্র সুতিবস্তুই নয়-রেশম ও পশমজাত দ্রব্যাদি, লােহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলােয়ার, খােদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দেশীয় শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অবশিল্পায়ন বাংলার উপররেও চরম প্রভাব পড়েছিল আর ভারত পরিণত হয় ইংল্যান্ডের কারখানাগুলির খােলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে।
তাঁতিরা বেশি দামে তুলাে কিনে কম দামে বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এইভাবে কেনা ও বেচা দুদিকেই তাদের ক্ষতি স্বীকার করতে হত। এই লােকসান ও অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাজার হাজার তাঁতি দেশত্যাগ করে এবং অনেকে দায়িত্ব এড়াবার জন্য নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে ফেলে। এর ফলে সমৃদ্ধ জনপদগুলি শ্রীহীন ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের পর উন্নত মানের ও সস্তা দামের ব্রিটিশ পণ্যাদি জলস্রোতের মতাে ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যগুলি বিনা শুল্কে ভারতে প্রবেশ করে এবং দেশে- বিদেশে সর্বত্র ভারতীয় পণ্যাদির ওপর বিরাট করের বােঝা চাপানাে হয়। এই অসম প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্পগুলির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এর ফলে কেবলমাত্র সুতিবস্তুই নয়-রেশম ও পশমজাত দ্রব্যাদি, লােহা, মৃৎশিল্প, কাচ, অস্ত্রশস্ত্র, ঢাল-তলােয়ার, খােদাই ও কারুকার্যের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন দেশীয় শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অবশিল্পায়ন বাংলার উপররেও চরম প্রভাব পড়েছিল আর ভারত পরিণত হয় ইংল্যান্ডের কারখানাগুলির খােলা বাজার ও কাঁচামাল সরবরাহের উৎসে।
- (১) সস্তা দামের বিদেশি পণ্যের আমদানি
- (২) ধনী ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের বিদেশি পণ্যের প্রতি ঝোঁক
- (৩) দেশীয় শিল্পের পৃষ্ঠপােষক দেশীয় রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের বিলুপ্তি
- (৪) ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, শিল্পপণ্যের বিপুল উৎপাদন এবং ভারতে তার অব্যাহত জোগান
- (৫) ভারতীয় ঔপনিবেশিক বাজারে নিজের শিল্পদ্রব্য একচেটিয়া বিক্রির প্রবণতা
- (৬) ব্রিটিশ বণিক ও পুঁজিপতিদের এদেশ থেকে শিল্পপণ্যের পরিবর্তে শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল (যথা সুতিবস্ত্রের পরিবর্তে তুলাে, রেশমবস্ত্রের পরিবর্তে কাঁচা রেশম ইত্যাদি) সংগ্রহের নীতি এবং
- (৭) সর্বোপরি, ব্রিটিশ সরকারের সংরক্ষণ শুল্ক নীতি। রাসব্রুক উইলিয়মস, হ্যামিলটন প্রমুখের মতে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবই ছিল ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের মূল কারণ—এর জন্য ব্রিটিশ সরকার দায়ী ছিল না। যন্ত্র ও হস্তশিল্পের মধ্যে বিরাট ব্যবধানই এর কারণ। অপরপক্ষে, রমেশচন্দ্র দত্ত ব্রিটিশ সরকার অনুসৃত নীতিকেই দায়ী।
পরবর্তীতে , ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী ..
- (১) ভারত একটি রপ্তানিকারী দেশ থেকে আমদানিকারী দেশে পরিণত হল
- (২) তৈরি করা পণ্যাদির (finished goods) পরিবর্তে ভারত থেকে রপ্তানি হতে লাগল কাঁচা তুলাে, নীল, রেশম, চা প্রভৃতি। ভারত পরিণত হল ব্রিটেনের কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে
- (৩) শিল্প-বাণিজ্যের ধ্বংসের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেল। বেকার শ্রমিকরা কৃষিক্ষেত্রে ভিড় করায় জমির ওপর চাপ বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়
- (৪) শিল্প-সমৃদ্ধ ও ঘনবসতিপূর্ণ নগরগুলি ক্রমে জনবিরল স্থানে পরিণত হয়
- (৫) চিরাচরিত অর্থনীতি ধ্বংস হওয়ায় ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, মহামারি ভারতীয় জীবনের অঙ্গে পরিণত হয়।
অবশিল্পায়ন বিতর্ক বিদেশি ঐতিহাসিক Daniel Thorner, মরিস ডেভিড মরিস (Morris David Morris), স্যার থিওডাের মরিসন (Theodore Morrison) প্রমুখ ‘অবশিল্পায়ন তত্ত্ব মানতে রাজি নন। মার্কিন গবেষক মরিস ডেভিড মরিস-এর মতে, অবশিল্পায়নের পুরাে ব্যাপারটিই হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। ঐতিহাসিকদের দ্বারা বহুল প্রচারিত একটি নিছক ‘অলীক কল্পনা' বা 'myth'। অপরপক্ষে, ড. অমিয় বাগচি, ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. তপন রায়চৌধুরী, ড, ইরফান হাবিব, ড. বিপান চন্দ্র প্রমুখের মতে, অবশিল্পায়ন একটি বাস্তব সত্য। অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ-এর মতে, -- “কোনাে যুক্তি দিয়েই অবশিল্পায়নের ঘটনাটি অস্বীকার করা যায় না।”
-------------
ロ বাংলা তথা ভারতের অর্থনীতির ওপর অবশিল্পায়ন অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলে। কোম্পানির বিমাতৃসুলভ নীতির ফলে বাংলার ঐতিহ্যশালী তাঁতশিল্পের নাভিশ্বাস ওঠে এবং এই বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ চরম দুর্দশার মুখােমুখি হয়।
✯ অবশিল্পায়নের ফলা ফল :-
[1] কর্মহীনতা সৃষ্টি ; শিল্পায়নের ফলে ভারতে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। শুধু বাংলা দেশেই ১০ লক্ষ লােক জীবিকাচ্যুত হয়।
[2] কৃষি-অর্থনীতিতে ভাঙন : সুরাট, আমেদাবাদ, পুনা, বেলারী, আর্কট, মাদুরা প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পকেন্দ্রের তাঁতশিল্পীরা চরম দুর্দশার মুখােমুখি হয়। হাতের কাজ ছেড়ে অনেকেই কৃষিকাজে ফিরে আসতে শুরু করে; এর ফলে কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণভাবে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়ে।
[3] অনাহারে মৃত্যু : বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের একটা বড় অংশ, যেমন—রঞ্জক, সুতা কাটুনি ইত্যাদি পেশার লােকেরা কোনাে কাজ না পেয়ে অনাহারে মারা যায়।
[4] কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন : অবশিল্পায়নের ফলে কুটিরশিল্পের ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়। কুটির শিল্পের জায়গায় গড়ে ওঠে যন্ত্রনির্ভর কলকারখানা।
উপসংহার : অবশিল্পায়নের ফলে ভারতীয় শিল্পের অপমৃত্যু হয়, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মহামারি হয়ে ওঠে ভারতবাসীর নিত্য সঙ্গী, এক সর্বগ্রাসা হতাশার অন্ধকার নেমে আসে ভারতবর্ষে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মতে , - “অবশিল্পায়নের ফলে ভারতীয় জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।"
-------------
✷ ‘Drain of wealth' Indian Economy (সম্পদের বহির্গমন বলতে কী বোঝ)
ロ ভূমিকাঃ- অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে কৃষিকাজ এবং শিল্প বাণিজ্যে বাংলা তথা ভারত ছিল এক সমৃদ্ধিশালী দেশ। পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলা তথা ভারতের এক বিস্তীর্ণ অংশে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে ইংরেজ শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল ভারতকে যথেচ্ছভাবে শােষণ করে ভারতীয় সম্পদ ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া। ড. বিপান চন্দ্র বলেন, নিজেদের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য ব্রিটিশ জাতি ভারতের জন্য এক নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থা উদ্ভাবন করে। যতদূর সম্ভব ভারতের অর্থ শুষে নিয়ে ব্রিটিশের স্বার্থে তা কাজে লাগানােই ছিল ব্রিটিশের মূল লক্ষ্য।” স্বভাবতই ইংরেজদের অনুসৃত অর্থনৈতিক নীতি ভারতের চিরাচরিত সমৃদ্ধিশালী কৃষি ও শিল্পকে ধ্বংস করে এবং এর ফলে ভারতের গ্রামীণ সমাজ ভেঙে পড়ে। বণিক, শিল্পী, কৃষক, জমিদার, সাধারণ মানুষ সবার জীবনে পরিবর্তন আসে।
✯ সম্পদের নির্গমন :- পলাশির যুদ্ধের পর রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণে সমগ্র অষ্টাদশ শতক ধরে বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যায় এবং এর বিনিময়ে ভারত কোনাে উপযুক্ত সুযােগসুবিধা পায়নি। ঐতিহাসিকরা এই ঘটনাকে সম্পদের নির্গমন ‘আর্থিক নিষ্ক্রমণ ‘আর্থিক নির্গমন’বা ‘Drain of wealth' বলে অভিহিত করেছেন। ব্ৰুকুস্ অ্যাডামস এই ঘটনাকে 'পলাশি লুণ্ঠন' ('Plassey Plunder') বলে আখ্যায়িত করেন।
ভারতীয় অর্থনীতিতে এই নির্গমন হয়েছিল দুটি ধারায় ...
(১) বেসরকারিভাবে কোম্পানির কর্মচারী, ইংরেজ বণিকদের দ্বারা বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন এবং
তা ইংল্যান্ডে পাচার।
(২) কোম্পানির বাণিজ্য, আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ফলে বাংলার সম্পদের নির্গমন।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধজয়ের পর থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীরা উৎকোচ, উপঢৌকন, নজরানা ও অন্যান্য সূত্রে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। পলাশির যুদ্ধের পর ‘নবাব তৈরির ব্যবসায়' নেমে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। বাংলায় ঢালাও লুণ্ঠন চলতে থাকে। ড. পাসিভ্যাল ম্পিয়ার (Dr. Perceval Spear)
পলাশি-পরবর্তী যুগকে ‘প্রকাশ্য ও নির্লজ্জ লুণ্ঠনের যুগ' ('Age of open and unashamed plunder') বলে অভিহিত করেছেন।
১৭৫৭ থেকে ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত অবাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর উপার্জন করে এবং তা ইংল্যান্ডে পাঠায়। ড. নরেন্দ্রকৃয় সিংহ বলেন যে, উৎকোচ ও নজরানা অপেক্ষা কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য থেকে প্রাপ্ত আয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন প্রকার গােপন ও অবৈধ চুক্তি এবং ঠিকাদারির মাধ্যমে কোম্পানির কর্মচারীরা প্রচুর আয় করত। এ ব্যাপারে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন তুলনাহীন। 'বাের্ড অফ ট্রেড' এর সদস্যরাও নানা দুর্নীতির মাধ্যমে রােজগার করতেন। কোম্পানির মাল কেনার সময় তাঁরা গরিব চাষি, তাঁতি ও দেশীয় বণিকদের কাছ থেকে বলপূর্বক কমিশন 'আদায় করতেন।
কোম্পানিও সরকারিভাবে সম্পদের নির্গমন ঘটাত। পলাশির যুদ্ধের পূর্বে কোম্পানি ভারত থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি ক্রয় করে তা ইউরােপের বাজারে বিক্রি করত। এজন্য কোম্পানিকে নিজের দেশ থেকে সােনারুপা আমদানি করতে হত। পলাশির যুদ্ধ, বিশেষ করে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানির হাতে বাংলার রাজস্বের যে-বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, কোম্পানি সেই অর্থই বাণিজ্যে বিনিয়ােগ করতে
থাকে। এইভাবে বাণিজ্যিক লগ্নি মারফত বাংলার টাকা বাইরে চলে যায়। কোম্পানির অংশীদারদের‘ডিভিডেন্ড’, ব্রিটিশ সরকারের প্রাপ্য অর্থ, ভারতের প্রশাসনিক ব্যয়, ইংল্যান্ডে ইন্ডিয়া অফিস এর ব্যয়, বােম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক ব্যয় ও বাণিজ্যিক লগ্নি—সবই মেটানাে হত বাংলার রাজস্ব থেকে।
এইভাবে ভারত থেকে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ ইংল্যান্ডে গেছে তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে নানা পণ্ডিত নানা ধরনের হিসাব দিয়েছেন। মাদ্রাজের রাজস্ব বাের্ডের সচিব জন সুলিভান (John Sullivan) বলেন, “আমাদের শাসনব্যবস্থা অনেকটা স্পঞ্জের মতাে। গঙ্গা-তীরবর্তী দেশ থেকে এই স্পঞধর্মী শাসন যা কিছু সম্পদ সব শুষে নেয় এবং টেম-তীরবর্তী দেশে এনে তা নিংড়ে দেয়।”
উপসংহার :- দাদাভাই নওরােজি, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের দারিদ্রের মূল কারণ হল ভারতীয় সম্পদের নির্গমন। অপরপক্ষে, ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার জন স্ট্রাচি, স্যার থিওডাের মরিসন, পি.জে. মার্শাল নির্গমন তত্ত্ব মানতে রাজি নন। বলা বাহুল্য, নির্গমন তত্ত্ব একটি বাস্তব ঘটনা। রমেশচন্দ্র দত্ত বলেন যে, পৃথিবীর কোনাে দেশে সম্পদ নির্গমনের এত ন্যক্কারজনক উদাহরণ আর দেখা যায় না।
---------------