স্নেহের প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে নতুন সিলেবাস অনুযায়ী 2023 সালের উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান যারা পরীক্ষা দিবে তাদের জন্য ভেরি ভেরি গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রশ্ন ১০০% কমন সাজেশন আকারে প্রশ্ন উত্তরসহ নোটস এখানে দেয়া হয়েছে। তোমাদের সুবিধার্থে সেগুলি HD পিডিএফ ফাইল করে ডাউনলোড লিঙ্ক এই পোষ্টের নিচে দেওয়া রয়েছে তোমরা চাইলে ডাউনলোড করে নিতে পারো। আর মাত্র কয়েকটা মাস এখন থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করে দাও। মনে রাখবে এই গুরুত্বপূর্ণ সাজেশন নোটস গুলি তোমরা খাতায় লিখে লিখে মুখস্ত করে প্র্যাকটিস করবে আমার বিশ্বাস প্রত্যেকেই তোমরা কমন পারে এবং ভাল রেজাল্ট করবে।
Class 12 Political Science Suggestion 2023 || hs রাষ্ট্রবিজ্ঞান Question Answer & Suggestion
❑ প্রথম অধ্যায়ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
প্রশ্ন ১. ক্ষমতা বা শক্তি কাকে বলে? ক্ষমতা বা শক্তির মূল উপাদান গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো?
প্রশ্ন ২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো?
প্রশ্ন ৩. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
প্রশ্ন ৪. বিদেশ নীতি নির্ধারনে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা আলোচনা করো?
❑ পঞ্চম অধ্যায়ঃ কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ
প্রশ্ন ১. উদারনীতিবাদ কাকে বলে? উদারনীতি বাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো?
প্রশ্ন ২. মার্কসবাদের মূল সূত্র গুলি লেখ? ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে কি জানো আলোচনা করো?
প্রশ্ন ৩. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা করো?
❑ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে কী বোঝো? এই নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে
যুক্তি দাও?
প্রশ্ন ২. এককক্ষ ও দ্বিকক্ষ আইনসভা কাকে বলে? এর পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
প্রশ্ন ২. এককক্ষ ও দ্বিকক্ষ আইনসভা কাকে বলে? এর পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
❑ সপ্তম অধ্যায়ঃ ভারতের শাসন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ভারতের যেকোনো একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী লেখ?
প্রশ্ন ২. ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো?
❑ অষ্টম অধ্যায়ঃ ভারতের আইন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো?
প্রশ্ন ২. পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকার বা অধ্যক্ষ এর ভূমিকা আলোচনা করো।
অথবা, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি লেখো।
❑ নবম অধ্যায়ঃ ভারতের বিচার বিভাগ
প্রশ্ন ১. সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো।
প্রশ্ন ২. ভারতের বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লেখ?
প্রশ্ন ৩. ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের উপর একটি টীকা লেখ?
প্রশ্ন ২. ভারতের বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লেখ?
প্রশ্ন ৩. ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের উপর একটি টীকা লেখ?
❖❖ সাজেশন প্রশ্ন ও উত্তর
❖❖
❑ প্রথম অধ্যায়ঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ❑
প্রশ্ন ১. ক্ষমতা বা শক্তি কাকে বলে? ক্ষমতা বা শক্তির মূল উপাদান গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো?
❍ ক্ষমতা বা শক্তির মূল উপাদান : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি বা ক্ষমতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অর্গানস্কি তাঁর 'World Politics' শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ
করেছেন যে, রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ক্ষমতাবাশক্তি । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্র কী ভূমিকা নেবে তা প্রধানত ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়। হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। হিসেবে (...a struggle for power) ব্যাখ্যা করেছেন। শক্তি বা ক্ষমতার উপাদান হিসেবে যেসব বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয় সেগুলি হল—
❍ ভৌগােলিক উপাদান: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ মর্গেনথাউ এর মতে, ভৌগােলিক উপাদান হল এমন এক
স্থায়ী উপাদান যার ওপরে কোনাে জাতির শক্তি নির্ভরশীল। ভৌগােলিক উপাদানের
মধ্যে রয়েছে দেশের অবস্থান, আয়তন, ভূপ্রকৃতি এবং জলবায়ু।
❍ জনসংখ্যা: জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ জাতীয় শক্তির অন্যতম নির্ণায়ক উপাদান। প্রতিরক্ষা,
আর্থিক বিকাশ এবং দেশগঠনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী, দক্ষ ও শিক্ষিত জনগণের কার্যকরী
ভূমিকা রয়েছে। অনেকের মতে, অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবহার ও আর্থিক বিকাশের জন্য
জনসংখ্যা যেমন প্রয়ােজন, তেমনই অতিরিক্ত জনস্ফীতিও আবার অর্থনৈতিক অবনমন ডেকে
আনে।
❍ প্রাকৃতিক সম্পদ: আধুনিক বিশ্বে কোনাে দেশকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে তাকে অতি অবশ্যই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতে হবে। আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমানের ইস্পাত, খনিজ তেল, ইউরেনিয়াম, প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের অত্যন্ত প্রয়ােজন৷ প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে কৃষিজ দ্রব্য ও খাদ্যশস্যেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যশস্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন কোনাে একটি দেশের জাতীয় শক্তি ও সামর্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।
প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ, শিল্পোন্নয়ন ইত্যাদির জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য।
❍ অর্থনৈতিক সামর্থ্য: অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছাড়া কোনাে দেশের পক্ষে জাতীয় শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়।বর্তমান বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলি এই কারণে জাতীয় শক্তির দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। বস্তুত যে- কোনাে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের হার অনুকূল না হলে তার পক্ষে মানবসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এই সম্পদকে কাজে লাগানাের জন্য প্রযুক্তি বিদ্যার জ্ঞান প্রয়ােজন। এই প্রযুক্তি বিদ্যায়ত জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে জাপান বর্তমানে নিজেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
❍ সামরিক ব্যবস্থা: বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা না থাকলে
কোনাে দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
একটি দেশের সামরিক শক্তি কেবল
গতানুগতিক স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না। পারমাণবিক বােমা, আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিশালী মারণাস্ত্রের ওপর বর্তমানে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে। আধুনিক বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত না হলে কোনাে দেশের পক্ষে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।
❍ সরকারের প্রকৃতি: হ্যান্স জে মর্গেনথাউ-এর মতে, একটি উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রকৃতির ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ভর করে। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাবর্গের সক্রিয়তার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য।
❑ উপসংহার:- যে-কোনাে একটি বা কয়েকটি উপাদানের বিশ্লেষণ থেকে শক্তি বা ক্ষমতার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায় না। জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদানের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলিরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
প্রশ্ন ২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো?
▢ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংজ্ঞা : প্রাচীনকাল থেকেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিষয়ে আলােচনার সন্ধান পাওয়া যায়। চিনের দার্শনিক মেনসিয়াস, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য এবং ইতালির দার্শনিক মেকিয়াভেলির রচনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৬৪৮ সালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব, অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক তাৎপর্যপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আস্তর্জাতিক সম্পর্ক সাবেকি কূটনীতির দ্বারা পরিচালিত হত। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
পর্যালােচলা গুরুত্ব লাভ করে। অবশ্য এ সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় সেটিই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামে পরিচিতি।
❍ বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে প্রধানত ক্ষমতার লড়াইকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য বা নতুন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরােধ ও সংঘর্ষের ধারণা এরসঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযােগিতামূলক ও প্রতিযােগিতামূলক সম্পর্ক, শত্রুতা ও মিত্ৰতামূলক সম্পর্ক, সংঘর্ষ ও সমন্বয় সব কিছু নিয়েই আলােচনা করে। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সে তুলনায় যথেষ্ট
সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে সীমিত।
❍ দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য : আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত
পার্থক্য বিদ্যমান ৷ কে জে হলসটি-র মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির
আলােচনাকে অনেক সময় পররাষ্ট্র সম্পর্কিত আলােচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ
রাখা হয়। এখানে মূলত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার উপাদান, পারস্পরিক
সম্পর্ক ও ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি ওপরে বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি তা নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে
রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, যােগাযােগ ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন,
বিশ্বযুদ্ধ প্রভৃতি বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।
❑ উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের যে পরিচয় মেলে তা আংশিক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমকালীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক পরিচয় কে তুলে ধরতে চায়।
প্রশ্ন ৩. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
▢ জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা : জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ একমত নন। হার্টম্যান বলেছেন,
জাতীয় স্বার্থ হল তাই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনাে রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয় তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেল মনে করেন, জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবােধের সমষ্টি। তাঁর মতে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেভাবে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব নিকেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কও সেভাবে জাতিরাষ্ট্রের লাভক্ষতির অঙ্ককে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। ফ্র্যাঙ্কেল, এই লাভক্ষতির হিসাবকে জাতীয় স্বার্থরুপে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মর্গেনথাউ-এর অভিমত অনুসারে যে-কোনাে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্র ভৌগােলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুন্ন রাখার মতাে কয়েকটি ন্যূনতম স্বার্থপূরণ করতে চায়।
সুতরাং, উপরােক্ত আলােচনা থেকে জাতীয় স্বার্থের একটি মােটামুটি গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে - জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বােঝায়, যেগুলি পূরণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।
❍ ভৌগােলিক অখণ্ডতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগােলিক অখন্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয় অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন । দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে । অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটি দেশ সমস্ত রকমের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই কারণে যে-কোনাে মূল্যে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
❍ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান: জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের ছােটো বড়াে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য বর্তমান বিশ্বে কোনাে দেশ, সে ছােটো বড়ো যাই হােক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। তাই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামজ্ঞস্য বিধান করতে চায়।
❍ অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রতিযােগিতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুন্ন রাখা, বহির্বাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযােগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
❍ সাংস্কৃতিক বিনিময়:
জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন
রাষ্ট্রের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি ভূমিকা রয়েছে। বর্তমান
যুগে কূটনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার পরে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের
বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের নয়া ব্যবস্থায়
তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের
সাংস্কৃতিক উৎসব, প্রদর্শনী, ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়ােজনের মাধ্যমে
সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথ প্রশস্ত করা হয়। সাংকৃতিক বিনিময়ের সাহায্যে
এক দেশ অন্য দেশে কাছে তার সংস্কৃতির প্রচারের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক
সম্পর্ককে মজবুত করে জাতীয় স্বার্থের লক্ষ্য পূরণ করতে চায়।
গতানুগতিক স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না। পারমাণবিক বােমা, আন্তর্দেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও অন্যান্য শক্তিশালী মারণাস্ত্রের ওপর বর্তমানে একটি দেশের সামরিক শক্তি নির্ভর করে। আধুনিক বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত না হলে কোনাে দেশের পক্ষে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়।
❍ সরকারের প্রকৃতি: হ্যান্স জে মর্গেনথাউ-এর মতে, একটি উৎকৃষ্ট সরকার ছাড়া পররাষ্ট্রনীতির সার্থক রূপায়ণ সম্ভবপর নয়। সরকারের প্রকৃতির ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা নির্ভর করে। অবশ্য সরকারের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি আমলাবর্গের সক্রিয়তার কথাও এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য।
❍ জাতীয় চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাস: কোনাে দেশের শক্তি অর্জনের বিষয়টি সেই দেশের জনগণের জাতীয় চরিত্র বা
জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। জাতীয়
চরিত্র বা জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও আত্মবিশ্বাসের তারতম্যের ফলে জাতীয়
শক্তির তারতম্য ঘটে বলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
প্রবল দেশপ্রেম ও সুদৃঢ় মনােবলের জন্যেই ভিয়েত নামের মতাে দেশ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে বৃহৎ শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে
সাফল্যের সঙ্গে লড়াই চালাতে পেরেছিল।
❑ উপসংহার:- যে-কোনাে একটি বা কয়েকটি উপাদানের বিশ্লেষণ থেকে শক্তি বা ক্ষমতার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায় না। জাতীয় শক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদানের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে শক্তি বা ক্ষমতার উপাদানগুলিরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
প্রশ্ন ২. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো?
▢ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংজ্ঞা : প্রাচীনকাল থেকেই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিষয়ে আলােচনার সন্ধান পাওয়া যায়। চিনের দার্শনিক মেনসিয়াস, মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য এবং ইতালির দার্শনিক মেকিয়াভেলির রচনার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৬৪৮ সালে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব, অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশে এক তাৎপর্যপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আস্তর্জাতিক সম্পর্ক সাবেকি কূটনীতির দ্বারা পরিচালিত হত। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
পর্যালােচলা গুরুত্ব লাভ করে। অবশ্য এ সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক আলােচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একটি স্বতন্ত্র পাঠ্যবিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় সেটিই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নামে পরিচিতি।
❑ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে
পার্থক্য :
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পাথক্য রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল-
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে যেসব পাথক্য রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল-
❍ আলোচনার ক্ষেত্রের পরিধিগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক রাজনীতির তুলনায় শ্রান্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােতে
পরিধি অনেক ব্যাপক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু যে রাষ্টগুলির মধ্যেকার
সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে তাই নয়, অ রাষ্ট্রীয় (Non-state) সংগঠন
ও প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়েও আলােচনা করে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
শুধুমাত্র রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে না, অর্থনৈতিক,
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সম্পর্ক নিয়েও বিচারবিশ্লেষণ করে।
অধ্যাপক পামার ও পারকিনসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাজনৈতিক ও
অরাজনৈতিক উভয় ধরনের বিষয় নিয়েই আলােচনা করে। বস্তুত আন্তর্জাতিক
রাজনীতি হল রাজনৈতিক সম্পর্কের আলােচ্যসূচির একটি অংশ মাত্র।
আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের পণ্ডিতরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তুর পরিধি অত্যন্ত সীমিত।
সম্পর্কের পণ্ডিতরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তুর পরিধি অত্যন্ত সীমিত।
❍ বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মর্গেনথাউ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে প্রধানত ক্ষমতার লড়াইকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িত, ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য বা নতুন করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য বিরােধ ও সংঘর্ষের ধারণা এরসঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযােগিতামূলক ও প্রতিযােগিতামূলক সম্পর্ক, শত্রুতা ও মিত্ৰতামূলক সম্পর্ক, সংঘর্ষ ও সমন্বয় সব কিছু নিয়েই আলােচনা করে। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু সে তুলনায় যথেষ্ট
সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে সীমিত।
❑ উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে আন্তর্জাতিক সমাজের যে পরিচয় মেলে তা আংশিক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমকালীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি সামগ্রিক পরিচয় কে তুলে ধরতে চায়।
প্রশ্ন ৩. জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা দাও। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
▢ জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা : জাতীয় স্বার্থের সংজ্ঞা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণ একমত নন। হার্টম্যান বলেছেন,
জাতীয় স্বার্থ হল তাই যাকে প্রতিটি রাষ্ট্র অর্জন ও সংরক্ষণ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনাে রাষ্ট্র যখন অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সচেষ্ট হয় তখনই এই স্বার্থের উন্মেষ ঘটে। অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্কেল মনে করেন, জাতীয় স্বার্থ হল জাতীয় মূল্যবােধের সমষ্টি। তাঁর মতে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক যেভাবে ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসেব নিকেশ দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কও সেভাবে জাতিরাষ্ট্রের লাভক্ষতির অঙ্ককে সামনে রেখে পরিচালিত হয়। ফ্র্যাঙ্কেল, এই লাভক্ষতির হিসাবকে জাতীয় স্বার্থরুপে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মর্গেনথাউ-এর অভিমত অনুসারে যে-কোনাে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থ। প্রতিটি রাষ্ট্র ভৌগােলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা, প্রচলিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সত্তা অক্ষুন্ন রাখার মতাে কয়েকটি ন্যূনতম স্বার্থপূরণ করতে চায়।
সুতরাং, উপরােক্ত আলােচনা থেকে জাতীয় স্বার্থের একটি মােটামুটি গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে - জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় উন্নয়ন, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বােঝায়, যেগুলি পূরণের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রই সক্রিয় উদ্যোগ নেয়।
❑ জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় : আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত
ধারণাটি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক । জাতীয় স্বার্থের
উপাদানগুলিও তাই। কোনাে
একটিমাত্র উপাদানের সাহায্যে জাতীয় স্বার্থ তৈরি হয় না। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল—
একটিমাত্র উপাদানের সাহায্যে জাতীয় স্বার্থ তৈরি হয় না। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল—
❍ ভৌগােলিক অখণ্ডতা: দেশের প্রতিরক্ষা ও ভৌগােলিক অখন্ডতাকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রধান উপাদান গঠিত হয় অনেকে একে জাতীয় নিরাপত্তা বলে অভিহিত করেছেন । দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিও এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে । অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটি দেশ সমস্ত রকমের বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে চায়। এই কারণে যে-কোনাে মূল্যে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও ভৌগােলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়টিকেই আধুনিক বিশ্বের দেশগুলি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
❍ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান: জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান। বিশ্বের ছােটো বড়াে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে মেলবন্ধন করাই হল এর মুখ্য উদ্দেশ্য বর্তমান বিশ্বে কোনাে দেশ, সে ছােটো বড়ো যাই হােক না কেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বাইরে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। তাই জাতীয় স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে রেখে বিদেশনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামজ্ঞস্য বিধান করতে চায়।
❍ অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় স্বার্থের উপাদান হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। প্রতিযােগিতানির্ভর বিশ্ববাণিজ্যে নিজের স্থান অক্ষুন্ন রাখা, বহির্বাণিজ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার অর্জন করা, অবাধ বাণিজ্য ও বিদেশি পুঁজি লগ্নির সুযােগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সব রাষ্ট্রের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
❍ আন্তর্জাতিকসংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি দেশ বিভিন্ন ধরনের সংগঠনে কতখানি সক্রিয় ভূমিকা
পালন করতে পারছে তার উপর সেই দেশের জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি অনেকাংশে
নির্ভরশীল। এই কারণে অর্জিাতিক সংগঠনগুলিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে
জাতীয় স্বার্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়। সম্মিলিত
জাতিপুঞ্জ ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে বর্তমান বিশ্বে যেসব আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে
উঠেছে, সেখানে জাতীয় স্বার্থপূরণের বিষয়টি একটি
ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণ:- হিসেবে ইউরােপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান, সার্ক, ওপেক, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। উদাহরণ:- হিসেবে ইউরােপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান, সার্ক, ওপেক, আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
❍ বিশ্বজনমত: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিশ্বজনমতের কথা উল্লেখ করা হয়। আন্তর্জাতিক সংকটের মােকাবিলায় বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশ্বজনমত গঠনের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বার্থপূরণের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নকে এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসবাদ কবলিত বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে বিশ্বজনমত গঠনে প্রয়াসী হয়েছে। এই প্রসঙ্গে, ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মুম্বাই বিস্ফোরণের পরে পাক সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরােপিয়ান ইউনিয়নের মতাে বৃহৎ শক্তিগুলির কাছে ভারত বারে বারে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদের স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থের উপাদান গুলিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ছােটো বড়াে সব রাষ্ট্র বিশেষ গুরুত্ব দিলেও কখন কোন উপাদানকে প্রাধান্য দেওয়া হবে তা অনেকটাই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। তবে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায় যে জাতীয় স্বার্থের উপাদান একমুখী নয়, বহুমুখী। তাই এক্ষেত্রে একটিমাত্র উপাদানের ভূমিকা যথেষ্ট নয়।
প্রশ্ন ৪. বিদেশ নীতি নির্ধারনে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা আলোচনা করো?
❑ বিদেশনীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থের ভূমিকা : কোনাে দেশের বিদেশনীতি নির্ধারণে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে সেই দেশের জাতীয়
স্বার্থ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতীয় স্বার্থকেই প্রতিটি
রাষ্ট্র বিদেশনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভিত্তিগত উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
তাই কোনাে দেশের বিদেশনীতি তথা বৈদেশিক সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থ বহির্ভূত অন্য
কোনাে শর্ত মেনে গড়ে ওঠে না। প্রকৃতপক্ষে, জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটেই
পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং সেই মতাে
নিজেদের বিদেশনীতি গ্রহণ করে থাকে। বলা বাহূল্য, প্রতিটি রাষ্ট্রের বিদেশনীতি
গড়ে ওঠে তার জাতীয় স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য। জাতীয় স্বার্থের মধ্যে
জাতীয় আশা, আকাঙ্ক্ষা, রুচি, সংস্কৃতি, মূল্যবােধ এবং বিকাশের ইঙ্গিত নিহিত
থাকে।
❑ উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় স্বার্থই হল কোনাে রাষ্ট্রের বিদেশনীতির
মূলমন্ত্র। তবে বৈদেশিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের জাতীয় স্বার্থকে
গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কোনাে ক্ষেত্রেই অন্ধ জাতীয় স্বার্থকে প্রশ্রয়
না দেওয়াও জরুরি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বার্থ ও বিশ্বমানবতার
স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ এর ফলেই বিদেশনীতি নির্ধারণের
ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের ধারণা অর্থবহ ও কার্যকর হয়ে উঠবে।
❑ পঞ্চম অধ্যায়ঃ কয়েকটি প্রধান রাজনৈতিক মতাদর্শ ❑
প্রশ্ন ১. উদারনীতিবাদ কাকে বলে? উদারনীতি বাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো?
▢ উনবিংশ শতকের শেষ দশকে সাবেকি উদারনীতিবাদ তার গুরুত্ব অনেকটা হারিয়ে ফেলে। এই
সময় টি এইচ গ্রিন, ম্যাক্আইভার এবং ল্যাস্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিবাচক
ধারণা নিয়ে উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন একেই ইতিবাচক বা আধুনিক
উদারনীতিবাদ (Positive or Mod- ern Liberalism) বলা হয়।
প্রশ্ন ১. উদারনীতিবাদ কাকে বলে? উদারনীতি বাদের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো?
❑ উদারনীতি বাদের মূল বৈশিষ্ট্য :
❍ রাষ্ট্র সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ : ইংল্যান্ডের ভাববাদী দার্শনিক টি.এইচ. গ্রিন বলেন, জনগণের সম্মতিই হল রাষ্ট্রের ভিত্তি, বলপ্রয়ােগ নয় (Wil, not force, is the basis of State.)। গ্রিন রাষ্ট্রকে সমষ্টিগত মঙ্গলের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন। গ্রিনের মতে, রাষ্ট্র কখনও নিজেই নিজের লক্ষ্য হতে পারে না।
রাষ্ট্র হল ব্যক্তিবর্গের পূর্ণ নৈতিক বিকাশের হাতিয়ার মাত্র। গ্রিনের অভিমত তার “সাধারণ ইচ্ছা”র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি মনে করতেন সাধারণ ইচ্ছা তথা সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠার জন্যই স্বাধীনতার প্রয়ােজন। রাষ্ট্র এই সদিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। রাষ্ট্র এর প্রতিবন্ধকতাসমূহ অপসারণ করবে। তার মতে, নাগরিকরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা ছাড়া অন্য কোনাে কারণে রাষ্ট্রের বিরােধিতা করতে পারে না। অবশ্য স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধাচরণ করাকে তিনি অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
❍ বহুত্ববাদী দৃষ্টিতে রাষ্ট্র: আধুনিক উদারনীতিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্আইভার, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, ব্যক্তির বহূমুখী জীবনের সম্পূর্ণ বিকাশ রাষ্ট্র একা করতে পারে না। এজন্য মানুষ সমাজের অভ্যন্তরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সংঘ বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে থাকে। রাষ্ট্রের মতাে এইসব সংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন৷ এদেরও রাষ্ট্রের মতাে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকা উচিত। বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করলেও অন্তৰ্জীবনের ওপর তার কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। ম্যাক্আইভারের ভাষায়, ‘পেনসিল কাটার জন্য কুঠার যেমন অনুপযুক্ত', সেরকম ব্যক্তির অন্তর্জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির বিকাশে রাষ্ট্রও অনুপযুক্ত।
❍ রাষ্ট্র জনগণের সেবক : অধ্যাপক ম্যাক্আইভারের মতে, রাষ্ট্র জনগণের সেবা করে বলেই তার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্র সমাজের ‘এজেন্ট হিসেবে জনগণের অধিকারসমূহ সৃষ্টি করে রাষ্ট্র জনগণ অপেক্ষা বড়াে হতে পারে না। ম্যাক্আইভার ধর্ম, নৈতিকতা, প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিরােধী ছিলেন। রাষ্ট্রের কাজকর্মকে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষপ তথা কৃষি ও শিল্পের বিকাশসাধনে সীমিত রাখার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন।
আইনসংগতভাবে বলপ্রয়ােগের অধিকারী এই ক্ষমতা সার্বভৌমিকতা নামে পরিচিত। তার মতে, রাষ্ট্রকে সমাজস্থ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করতে হয়। জনগণের ব্যাপক অংশের সর্বাধিক পরিমাণ সামাজিক মঙ্গলসাধন রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। ল্যাস্কি অবশ্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণাকে জনগণের শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সপক্ষে রায় দেন।
❍ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্ব : রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরবর্তীকালে উদারনীতিবাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলে উদারনীতিবাদের সমর্থকরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র তত্ত্ব প্রচার করেন। সমাজতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থিত এই তত্ত্বে একটা মাঝামাঝি অবস্থার কথা বলা হয়। এই মতবাদে মিশ্র অর্থব্যবস্থা চালু করে জনকল্যাণ সাধন সম্ভব বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রতত্ত্বে উদারনীতিবাদের মৌল নীতিগুলির মধ্যে নাগরিকদের রাজনৈতিক ও পৌর
অধিকারের স্বীকৃতি, সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা, বহুদলীয় ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তন প্রভৃতি গৃহীত হয়।
প্রশ্ন ২. মার্কসবাদের মূল সূত্র গুলি লেখ? ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
সম্পর্কে কি জানো আলোচনা করো?
▢ ভূমিকা : জার্মান মনীষী কার্ল মার্কস তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু ফ্রেডারিক
এঙ্গেলস এর সহযােগিতায় মানবইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা বিশ্লেষণ করে যে বিজ্ঞানসম্মত
তত্ত্ব উপস্থিত করেন তাই মার্কসবাদ নামে পরিচিত।
লেনিনের মতে, “মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ও শিক্ষামালার নামই হলাে মার্কসবাদ।”অতএব মার্কসবাদ কোনাে মুনিঋষির মুখনিসৃত বাণী নয়।
❑ মার্কসবাদের বিভিন্ন দিক : মার্কসবাদের বিভিন্ন দিককে সাধারণত ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, (২) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, (৩) উদ্ধৃত্ত মূল্যতত্ত্ব, (৪) শ্রেণিসংগ্রাম, (৫) রাষ্ট্র-সংক্রান্ত তত্ত্ব এবং (৬) বিপ্লব-সংক্রান্ত তত্ত্ব।
❍ দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদঃ মার্কসবাদ হলাে একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন। আবার মার্কসবাদ হলাে একটি দ্বান্দ্বিক বীক্ষণ। সংক্ষেপে মার্কসবাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় হলাে দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কস তাঁর রচনায় ‘দ্বান্দ্বিকতা’ ও ‘বস্তুবাদ’ কথাটি প্রয়ােগ করেননি।
❍ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ : মানবসমাজের প্রকৃতি এবং ইতিহাস বিশ্লেষণে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রয়ােগকেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে। ডারউইন যেমন জীবজগতের বিবর্তনের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, মার্কসও তেমনি মানবইতিহাসের বিবর্তনের মূল সূত্রটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে আবিষ্কার করেছিলেন। শ্রেণিসংগ্রাম ও মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে– “আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যতিত আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস হলাে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।” “The history of all hitherto existing Society is the history of class Struggle." উৎপাদনের উপায় ও উৎপাদন পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে প্রতিটি যুগে শােষক ও শােষিত শ্রেণির মধ্যে অবিরাম সংগ্রাম চলে আসছে। ফলে সংগ্রাম কখনাে প্রকাশ্যে, কখনাে-বা গােপনে ঘটেছে। তা বলে সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। এক কথায় যতদিন পৃথিবীতে বৈরী শ্রেণি থাকবে ততদিন শ্রেণিসংগ্রাম থাকবে।
❍ উদ্ধৃত্ত মূল্যতত্ত্ব: কাল মার্ক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর উদ্ধৃত্ত মূল্যের শ্রমতত্ত্বের সূত্র ধরে, তাঁর উদ্ধৃত্ত মূল্যতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। যাই হোক, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবনধারণের চেষ্টা করে। উৎপাদনের মালিকানা থেকে তারা বঞ্চিত বলে তাদের সর্বদা পুঁজিপতিদের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু একজন শ্রমিককে পুঁজিবাদী যে মজুরি দেয় তার চাইতে মূল্যদ্রব্য বিক্রি করে সে মুনাফা ভােগ করে।
❍ মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্ব : মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে বলা হয়েছে, আধুনিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রধানত দু'টি শ্রেণি রয়েছে যথা- (১) পুঁজিবাদী এবং (২) শ্রমিক শ্রেণি। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণিকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে তার একটা বিরাট অংশ তারা ভােগ করে। এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একটি বলপ্রয়ােগ সংগঠন আছে এবং সেটি হলাে রাষ্ট্র।
❑ উপসংহার : উপরিউক্ত মার্কসীয় সূত্রগুলি থেকে সাধারণত এই রকমই প্রমাণ দেয় যে পুঁজিবাদী সমাজে শাসকশ্রেণি নিজেদের অর্থনৈতিক প্রাধান্যকে বজায় রাখার জন্য সর্বহারা শ্রেণির বৈপ্লবিক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে এবং হিংসা ও যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে।
প্রশ্ন ৩. ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা করো?
▢ ভূমিকা : মানবসমাজের বিকাশের প্রকৃতি ও ইতিহাস বিশ্লেষণে
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বের প্রয়ােগ ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে পরিচিত। কার্ল
মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ইতিহাসের জড়বাদী ব্যাখ্যা
উপস্থাপিত করেন। ডারউইন যেমন ভাবে জীবজগতের বিবর্তনের নীতি আবিষ্কার করে ছিলেন,
মার্কসও তেমনি মানব ইতিহাসের বিবর্তনের মূল সূত্র বিজ্ঞানসম্মতভাবে আবিষ্কার করে
ছিলেন। মার্কসের কাছে ইতিহাস কয়েকটি ঘটনার সংকলন অথবা কাহিনির বিবরণ নয়।
মানবসমাজের ইতিহাস আবশ্যিকভাবেই শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস, শ্রেণিশােষণ ও দমনের
ইতিহাস।
মরিস কর্নফোর্থের মতে, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তিনটি মূল সূত্র রয়েছে। সেগুলি হল— (i) সমাজের পরিবর্তন ও বিকাশ প্রকৃতির মতাে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। (ii) সমাজের বৈষয়িক জীবনের বিকাশের ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক তত্ত্ব, মতাদর্শ, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। (iii) বৈষয়িক জীবন থেকে যেসব মতাদর্শ ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, বাস্তবে সেগুলি বৈষয়িক জীবনের বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
❑ বস্তুবাদ তত্ত্বটির মূল বক্তব্য :
(i) মানবসমাজের পরিবর্তন: মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের 'German laeology' শীর্ষক রচনায় লিখেছেন, মানুষের অস্তিত্বের জন্য প্রাথমিক প্রয়ােজন হল খাদ্য, পানীয়, পরিধেয় ও বাসস্থান। জীবন যাপনের এই বাস্তব প্রয়োজনগুলি পূরপের জন্য মানুষ প্রথমে উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করে। মার্কসের মতে, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, প্রতি চিন্তাধারা নয়, মানুষের জীবনযাপনের প্রয়ােজনীয় উপকরন গুলির উৎপাদন পদ্ধতি রয়েছে মানবসমাজের পরিবর্তনের মূলে।
(i) মানবসমাজের পরিবর্তন: মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের 'German laeology' শীর্ষক রচনায় লিখেছেন, মানুষের অস্তিত্বের জন্য প্রাথমিক প্রয়ােজন হল খাদ্য, পানীয়, পরিধেয় ও বাসস্থান। জীবন যাপনের এই বাস্তব প্রয়োজনগুলি পূরপের জন্য মানুষ প্রথমে উৎপাদনের কাজে অংশগ্রহণ করে। মার্কসের মতে, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, প্রতি চিন্তাধারা নয়, মানুষের জীবনযাপনের প্রয়ােজনীয় উপকরন গুলির উৎপাদন পদ্ধতি রয়েছে মানবসমাজের পরিবর্তনের মূলে।
(ii) ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর ধারণা: মার্কসের ঐতিহাসিক
বস্তুবাদে রয়েছে ভিত্তি ও উপরিকাঠামাের ধারণা। উৎপাদন পদ্ধতি
এবং উৎপাদন সম্পর্ককে নিয়ে যে অর্থনৈতিক কাঠামাে তাই হল সমাজের মূল ভিত্তি বা
বুনিয়াদ এই ভিত্তি বা বুনিয়াদের ওপরে গড়ে ওঠা সামাজিক সম্পর্ক, মতাদর্শ ও
প্রতিষ্ঠান হল উপরিকাঠামাে।
(iii) উৎপাদন পদ্ধতির গুরুত্ব: ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুসারে,
মানবসমাজের বিকাশের ধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদন পদ্ধতি। এই উৎপাদন পদ্ধতি
সবকিছুর মূল। তাই ইতিহাসকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে উৎপাদন পদ্ধতির বিশ্লেষণ
প্রয়ােজন। প্রসঙ্গত বলা যায়, মার্কসীয় তত্ত্বে উৎপাদন বলতে সবসময় সামাজিক
উৎপাদনকে বােঝানাে হয়েছে। সমাজবিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে উৎপাদন শক্তি ও
উৎপাদন সম্পর্কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে উৎপাদন পদ্ধতি। সমাজের কাঠামাে এই উৎপাদন
পদ্ধতির প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে সমাজব্যবস্থাও
পরিবর্তিত হয়।
(iv) উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস: মার্কসীয় মতবাদ অনুসারে, মানবসমাজের বিকাশের ইতিহাস হল উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের ইতিহাস। মানবসমাজের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ হল উৎপাদন শক্তি ও উপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব। মার্কসের বক্তব্য হল, নতুন উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক পুরােনাে ব্যবস্থার ধবংসের ফলে আলাদাভাবে সৃষ্টি হয় না। পুরােনাে ব্যবস্থার মধ্যেই নুতন উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভূত হয়। 'Capital 'গ্রন্থে মার্কস বলেন, প্রত্যেক
সমাজব্যবস্থার গর্ভে যখন নতুন সমাজের উদ্ভব হয়, শক্তি তখন ধাত্রী হিসেবে কাজ করে।
(V) সমাজবিবর্তনের বিজ্ঞানসঙ্গত ধারা: মার্কসীয় তত্ত্ব অনুসারে, আদিম যৌথ সমাজ জীবনে উৎপাদনের উপাদানের মালিক ছিল সমগ্র মানবসমাজ। উৎপাদনের উপাদানের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা না থাকায় সে সময় শ্রেণিশােষণ ছিল না। দাস সমাজব্যবস্থায় দাস মালিকরা ব্যক্তিগত মালিকানা কায়েম করে। ক্রমে সমাজব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের মালিক হল সামন্তপ্রভুরা। এসময় উৎপাদনে নিযুক্ত শ্রমিকরা ছিল ভূমিদাস। তখনকার সমাজব্যবস্থার আর উৎপাদন ব্যবস্থার সম্পর্ক যথেষ্ট সংগতিপূর্ণ ছিল পরে কৃষির উন্নতির পাশাপাশি যন্ত্রশিল্পের উদ্ভব ঘটলে সামন্তসমাজের।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কলকারখানায় একসঙ্গে কাজ করায় উৎপাদনে সামাজিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানা পুঁজিপতি মালিক শ্রেণির কুক্ষিগত থাকার ফলে তা ব্যক্তিগত থেকে যায়। এই অবস্থায় সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে।
❑ ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে কী বোঝো? এই নীতির পক্ষে ও বিপক্ষে
যুক্তি দাও?
❑ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে যুক্তি :
❍ বিভাগীয় স্বাধীনতার সংরক্ষণ : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্রের সঙ্গে কাজকর্ম পরিচালনা করায় একে অপরের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পায় না। এর ফলে বিভাগীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার কোনাে আশঙ্কা থাকে না।
❍ বিভাগীয় স্বাধীনতার সংরক্ষণ : ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্রের সঙ্গে কাজকর্ম পরিচালনা করায় একে অপরের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পায় না। এর ফলে বিভাগীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার কোনাে আশঙ্কা থাকে না।
❍ কর্মকুশলতার বৃদ্ধি: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সরকারের তিনটি বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজ করার যে সুযােগ লাভ করে, তার ফলে তাদের কর্মকুশলতা বৃদ্ধি পায়।
❍ স্বৈরাচারী প্রবণতা রােধ : অনেকে মনে করেন, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণনীতি বাস্তবে রূপায়িত হলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রােধ করা সম্ভব হয়। কারণ এক্ষেত্রে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ প্রায় সমমর্যাদার অধিকারী হওয়ায় কোনাে একটি বিভাগের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা
হ্রাস পায়।
❍ দায়িত্বশীলতার বিকাশ: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলে সরকারের তিনটি বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এতে কাজকর্মের তাগিদে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বিকাশ ঘটে।
❑ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি :
❍ বাস্তবায়ন দুরূহ: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রধান সমালােচনা হল বাস্তবে এই
নীতির পূর্ণ প্রয়ােগ আদৌ সম্ভব নয়। কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের
প্রধান তিনটি বিভাগকে কখনােই পুরােপুরি স্বতন্ত্র করা যায় না।
❍ পূর্ণ প্রয়ােগ অনভিপ্রেত: জন স্টুয়ার্ট মিল, ফাইনার, ল্যাঙ্কি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিটির পূর্ণ প্রয়ােগ আদৌ কাম্য নয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে এই স্বাতন্ত্র বিরােধ ডেকে আনবে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পটভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ং ম্যাডিসন ও অন্য যুক্তরাষ্ট্রীয়পন্থীরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়ােগ করা হলে প্রশাসন অচল হয়ে পড়বে।
❍ ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ নয়: গিলক্রিস্ট, স্যাবাইন প্রমুখ আধুনিক লেখকরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে মেনে নেননি। কারণ, আইন বিভাগ যদি স্বৈরাচারী হয়, তবে তার দ্বারা প্রণীত স্বৈরাচারী আইনকে কার্যকর করতে শাসন বিভাগ যেমন বাধ্য থাকে, তেমনি সেই আইন অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করতে বিচার বিভাগও বাধ্য। সুতরাং, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কখনােই ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে।
❍ তিন বিভাগের অসম ক্ষমতা: সমালােচকরা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সমক্ষমতাসম্পন্ন বলতে রাজি হননি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগ তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষমতার অধিকারী। কারণ আইন বিভাগের প্রণীত আইন অনুসরণ করে শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে চলতে হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে আইনসভা হল চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
❍ মার্কসবাদী সমালােচনা: মার্কসবাদী সমালােচকরা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক
ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্বের সাফল্য সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
মার্কস বাদীদের মতে, অসমাজ-তান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকার এক বিশেষ শ্রেণির
স্বার্থ রক্ষা করে চলে। কাজেই এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির
প্রয়ােগ অর্থহীন।
❑ উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বাস্তবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ প্রয়ােগ কখনােই কাম্য নয়। তবে আংশিক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়ােজন। কারণ ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য।
প্রশ্ন ২. এককক্ষ ও দ্বিকক্ষ আইনসভা কাকে বলে? এর পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও।
▢ এককক্ষবিশিষ্ট ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা সংজ্ঞা
: আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারের শক্তিশালী অঙ্গ হিসেবে শাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলেও
আইনসভার একটি স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। আইনসভা আজও একটি দেশের
সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গানারের মতে, -
"কয়েকটি অঙ্গের মধ্যে যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয় এবং সঞ্চালিত
হয়, আইনসভা নিঃসন্দেহে প্যারামাউন্ট স্থান দখল করে"। “Of the several organs
through which the will of the State is expressed and carried out, the
legislature unquestionably occupies the Paramount place".
গঠিত হয় তাকে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Unicameral Legislature) বলা হয়, যেমন গণসাধারণতন্ত্রী চিনের আইনসভা জাতীয় গণ কংগ্রেস। অন্যদিকে, যে সকল আইনসভা দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত তাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Bicameral Legislature) বলা হয়। যেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে সেখানে আইনসভার নিম্নকক্ষ (Lower House) জনগণের ভােটে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। এজন্য নিম্নকক্ষকে জনপ্রিয় কক্ষও (Popular Chamber) বলা হয়।
উচ্চকক্ষের গঠন কাঠামাে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকেন না। উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিত্বের নীতি সব দেশে সমান নয়। যেমন, ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়, ভারতের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা জনগণের দ্বারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটের
প্রতিনিধিরা সরাসরি জনগণের ভােটের দ্বারা নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটে সমপ্রতিনিধিত্ব নীতি অনুসারে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ২ জন করে প্রতিনিধি প্রেরণের ক্ষমতা রয়েছে। ভারতে অবশ্য রাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের নীতি উচ্চকক্ষে স্বীকৃত হয়নি। ক্ষমতা ও পদমর্যাদা গত প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের উচ্চকক্ষের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন - ব্রিটেনের আইনসভা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভার ক্ষমতা নিম্নকক্ষ কমন্সসভার চেয়ে অনেক কম পদমর্যাদাগত প্রশ্নেও কমন্সসভা বেশি ক্ষমতাশালী। ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার ক্ষমতা অনুরূপ না বলা গেলেও নিম্নকক্ষ লােকসভার চেয়ে অনেক কম এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
❑ এককক্ষ আইনসভার পক্ষে যুক্তি :
❍ সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন : দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় সুচিন্তিত ভাবে আইন প্রণীত হয়। আইনসভা
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হওয়ায় প্রতিটি বিলকে দুটি কক্ষে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে
বিচারবিবেচনা করার সুযােগ পাওয়া যায়। এতে বিলের দুটিবিচ্যুতি ধরা পড়ে।
এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার মতাে তড়ি ঘড়ি সাময়িক আবেগ ও উত্তেজনার বশে অথবা জনমতের
চাপে অবিবেচনা প্রসূত আইন প্রণয়নের আশঙ্কা এখানে কম থাকে।
❍ জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সমন্বয়সাধন :
আইনসভায় একটিমাত্র কক্ষ থাকলে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের সামগ্রিক
প্রতিনিধিত্ব সম্ভব নয়। অন্যদিকে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকলে সেক্ষেত্রে
নিম্নকক্ষ এবং উচ্চকক্ষের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্বার্থের
সার্থক
সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। এই কারণে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আবশ্যিক বলে মনে করা হয়।
সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। এই কারণে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আবশ্যিক বলে মনে করা হয়।
❍ স্বৈরাচারী প্রবণতা রােধ: লর্ড অ্যাক্টন আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষকে ব্যক্তিস্বাধীনতার নিরাপত্তার পক্ষে প্রয়ােজনীয় বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, একটিমাত্র কক্ষ নিয়ে আইনসভা গঠিত হলে স্বৈরাচারের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, কারণ সেক্ষেত্রে কোনাে নিয়ন্ত্রণকারী থাকে না। অন্যদিকে, আইন সভার দুটি কক্ষ থাকলে প্রথম কক্ষের স্বৈরাচার অতি সহজেই দ্বিতীয় কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
❍ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থের সুরক্ষা: এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার নির্বাচন জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটের ভিত্তিতে হওয়ায় সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের অভাব দেখা যায়। কিন্তু দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় পরােক্ষ নির্বাচন ও মনােনয়নের ব্যবস্থা থাকায় সংখ্যালঘু স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
❍ রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তারের সহায়ক বলে অনেকে মনে করেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নের সময় যেসব আলােচনা ও বিতর্ক হয় তা গণমাধ্যম মারফত প্রচারিত হওয়ায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার প্রসার ঘটে। বলা বাহুল্য, এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় এই সুযােগ সীমিত।
❑ এককক্ষ আইনসভার বিপক্ষে যুক্তি :
❍ অগণতান্ত্রিক গঠনকাঠামাে : গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুযায়ী, জনগণের ভােটে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা গঠিত হয়। কিন্তু কোনাে কোনাে দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট
আইন সভায় মনােনয়ন প্রথায় প্রতিনিধি নিয়ােগের ব্যবস্থা থাকায় গণতান্ত্রিক
রীতিনীতি লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ব্রিটেনের উচ্চকক্ষ
লর্ডসভায় উত্তরাধিকারসূত্রে লর্ডদের মনােনয়নের কথা বলা যেতে পারে।
❍ অনাবশ্যক: আইনসভার দুটি কক্ষকে অনেকে অনাবশ্যক বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, দুটি কক্ষেই যদি একই রাজনৈতিক দলের গরিষ্ঠতা থাকে তাহলে দ্বিতীয় কক্ষের অস্তিত্ব অনাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবে সিঁয়ের মতে প্রথম কক্ষ দ্বিতীয় কক্ষের সঙ্গে সহমত পােষণ করলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনাবশ্যক, অন্যদিকে দুটি কক্ষ যদি সম্পূর্ণ ভিন্নমত পােষণ করে তবে তা ক্ষতিকারক।
❍ প্রকৃত জ্ঞানীগুণীদের উপেক্ষা : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় জ্ঞানীগুণীদের জায়গা দেওয়া যায়, এই যুক্তি ঠিক নয় বাস্তবে দেখা যায়, যে দল নিম্নকক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলের প্রতিনিধিরাই এ ধরনের সুযােগ পেয়ে থাকেন। এর ফলে প্রকৃত জ্ঞানীগুণীরা বঞ্চিত হন।
❍ দায়িত্ব এড়ানাের প্রবণতাসম্পন্ন : অনেকে মনে করেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় গৃহীত কার্যাবলির ব্যাপারে কোনাে প্রশ্ন উঠলে এককভাবে কোনাে একটি কক্ষকে দায়ী করা যায় না | সেই ক্ষেত্রে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রবণতা দুটি কক্ষেই দেখা যায়।
❍ আশু আইন প্রণয়নের অনুপযুক্ত : দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়নে দুটি কক্ষের ভূমিকা থাকায় জরুরি প্রয়ােজনে দ্রুত আইন প্রণয়ন এখানে কোনােভাবেই সম্ভব নয়। যে দ্রুততায় এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় আইন প্রণয়ন করা হয়, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভায় তা হয় না।
❍ ব্যয়বহুল : অনেকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্বকে ব্যয়বহূল বলে মনে করেন। তাঁদের মতে যেহেতু একটি কক্ষ অপ্রয়ােজনীয়, তাই সদস্যদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযােগসুবিধার জন্য অহেতুক অর্থের অপচয় ঘটে।
❑ উপসংহার: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিরুদ্ধে উপরােক্ত সমালােচনা সত্ত্বেও দেখা যায় যে, বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার কাঠামাে গৃহীত হয়েছে । বস্তুত, প্রথম কক্ষের প্রণীত আইন দ্বিতীয় কক্ষে সংশােধিত হওয়ার সুযােগ থাকায় তা আরও পূর্ণতা লাভ করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সংশােধনী কক্ষরূপে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার দ্বিতীয় কক্ষের গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না।
❑ সপ্তম অধ্যায়ঃ ভারতের শাসন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ভারতের যেকোনো একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী লেখ?
▢ ক্ষমতা ও পদমর্যাদার দিক দিয়ে বিচার করা হলে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্য সরকারের
প্রকৃত কার্যকর প্রধান রূপে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে
নিয়ােগ করেন এবং এক্ষেত্রে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিন্তু উল্লেখ করা না হলেও আইনসভার
সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতাকেই রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীরূপেপ্রশ্ন ১. ভারতের যেকোনো একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী লেখ?
নিযুক্ত করে থাকেন।
❑ মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি : মুখ্যমন্ত্রী হলেন রাজ্যপালের প্রধান উপদেষ্টা ও রাজ্যপাল ও মন্ত্রী পরিষদের মধ্যে যােগসূত্র। রাজ্যপাল ও মন্ত্রীপরিষদের মধ্যে অবিরত যােগাযােগ রাখার জন্য সংবিধানে রাজ্যপালকে তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর তিনটি কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে।
❍ প্রথমত, রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা সম্পর্কে মন্ত্রীপরিষদের সকল সিদ্ধান্ত এবং আইন প্রণয়নের প্রস্তাবসমূহ রাজ্যপালকে জানানাে মুখ্যমন্ত্রীর একটি দায়িত্ব। ❍ দ্বিতীয়ত, রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা ও আইন প্রণয়নের প্রস্তাবসমূহ সম্পর্কে রাজ্যপাল যদি কোনাে তথ্য চান তা হলে মুখ্যমন্ত্রীকে তা সরবরাহ করতে হবে। ❍ তৃতীয়ত, রাজ্যপাল যদি অনুজ্ঞা করেন, তা হলে যে বিষয়ে কোনাে মন্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, অথচ যা মন্ত্রীপরিষদে বিবেচনা করা হয়নি, এরূপ কোনাে বিষয় ঐ পরিষদে বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত করতে বাধ্য থাকেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজ্য বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হলেন মুখ্যমন্ত্রী। এইজন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আইনসভায় সরকারের নীতি ও কার্যকলাপ সমর্থন করতে হয় এবং বিরােধী দলের প্রশ্ন ও সমালােচনার যথাযথ উত্তর দিতে হয়। আইনসভায় শাসক দলের নেতা হিসাবে তার ব্যক্তিত্ব ও কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণের ওপরেই অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারের ভাবমূর্তি। আইনসভায় তার দলকে পরিচালনা করার দায়িত্বও তার এবং তার সুদক্ষ পরিচালনার জন্যই শাসকদল আইনসভায় ঐক্যবদ্ধভাবে বিরােধী দলের বিরােধিতার মােকাবিলা করতে পারে।
সর্বোপরি, রাজ্য শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ নির্বাহী পদাধিকারী হিসাবে মুখ্যমন্ত্রীকে জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতে হয়। বস্তুত, তিনি শাসক দলের নেতাই শুধু নন, তিনি প্রকৃতপক্ষে জনগণেরও নেতা। এই ভূমিকায় তিনি কতটা সফল ও জনপ্রিয় তার ওপরেই নির্ভর করে সরকারের জনপ্রিয়তা। মুখ্যমন্ত্রী শুধু বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ট দলেরই নেতা নন, তিনি বিধানসভারও নেতা। তারই পরামর্শে রাজ্যপাল বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করেন অথবা অধিবেশন স্থগিত রাখেন। বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শও রাজ্যপালকে তিনি দেন সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার প্রচলিত প্রথা অনুসারে তার এই পরামর্শ রাজ্যপাল মেনে চলতে বাধ্য। বিধানসভার কার্যক্রম তৈরি হয় তাঁরই নির্দেশে। বিধানসভার অধিকার ও মর্যাদা। রক্ষার ব্যাপারেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এছাড়া বিরােধী দলগুলির সঙ্গে নিয়মিত
যােগাযােগ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার দায়িত্বও প্রধানত মুখ্যমন্ত্রীর। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই বিধানসভার কার্যধারা আবর্তিত হয়। তিনিই বিধানসভার সবচেয়ে বড়াে আকর্ষণ।
❑ উপসংহার: শুধু যােগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একই সঙ্গে এই নানা ধরনের ভূমিকায় সফল হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য যা প্রয়ােজন তা হলাে উচু মাপের ব্যক্তিত্ব, কল্পনাশক্তি, দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতা। আবার রাজ্য সরকার যদি বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার হিসাবে কাজ করে তা হলে এই কোয়ালিশনকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত রেখে তাকে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসাবে সক্রিয় রাখার ব্যাপারেও প্রয়ােজন হয় এক অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুখ্যমন্ত্রীর যাঁর ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা কোয়ালিশনকে অটুট রাখার ব্যাপারে এক রক্ষাকবচের কাজ করে।
প্রশ্ন ২. ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা আলোচনা করো?
❑ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি :
সংবিধানের ৫৩ (১) নং ধারা অনুসারে, কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে যে প্রকৃত ক্ষমতা
দেওয়া হয়েছে তা কয়েকটি ভাগে আলোচনা করা যেতে পারে। সেই ভাগগুলি নীচে আলোচনা
করা হল ---
(i) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা (ii) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা (iii) অর্থ
সংক্রান্ত ক্ষমতা (iv) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা (v) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত
ক্ষমতা (vi) অন্যান্য ক্ষমতা
(i) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা: ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসক হিসেবে অভিহিত করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনা করতে পারেন। এই শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
🅐 নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা
🅑 সামরিক ক্ষমতা
🅒 কূটনৈতিক ক্ষমতা
🅓 তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত ক্ষমতা
🅐 নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা: ভারতের প্রকৃত
শাসক প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্য, ভারতের অ্যাটর্নি
জেনারেল, ব্যয়- নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক, নির্বাচন কমিশনার, কেন্দ্রীয়
রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য, অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল প্রমুখ উচ্চপদাধিকারীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। এদের অনেককে তিনি অপসারণ করতে পারেন।
রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য, অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল প্রমুখ উচ্চপদাধিকারীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। এদের অনেককে তিনি অপসারণ করতে পারেন।
🅒 কূটনৈতিক ক্ষমতা: বিদেশে ভারতের যাবতীয় সরকারি কাজকর্ম রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়।ভারতের বৈদেশিক কূটনীতিকদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি। অন্যান্য দেশ থেকে আসা কূটনীতিকদের
তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি হলেন জাতির প্রতিনিধি। সব ধরনের আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তি রাষ্ট্রপতির নামে সম্পাদিত হয়।
ক্ষমতা রয়েছে ,উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির বিষয়েও রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন গঠন করে থাকেন।
(ii) আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা : ভারতের রাষ্ট্রপতি আইনসভা বা সংসদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হন। রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল—
🅐 অধিবেশন সংক্রান্ত ক্ষমতা
🅑 মনোনয়ন প্রদান
🅒 যৌথ অধিবেশনে ভাষণদান
🅓 বিলে সম্মতিদান
🅐 অধিবেশন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয়কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে কিংবা অধিবেশন স্থগিত রাখতে পারেন। রাষ্ট্রপতি লোকসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তা ভেঙ্গে দিতেও পারেন। লোকসভা ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিল অনুমোদনের ক্ষেত্রে সংসদের উভয়কক্ষের মতবিরোধে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন ডেকে তার অবসান ঘটাতে পারেন।
🅑 মনোনয়ন প্রদান : সংসদের উচ্চকক্ষ
রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি ১২ জন কৃতী ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারেন। এ
ছাড়া লোকসভায় ইঙ্গ-ভারতীয় (Anglo-Indian) সম্প্রদায়ের যথোচিত সংখ্যক
প্রতিনিধি নেই মনে করলে, রাষ্ট্রপতি ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে অনধিক দুজনকে
লোকসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করতে পারেন।
🅒 যৌথ অধিবেশনে ভাষণদান : সংসদের যে-কোনো কক্ষে বা উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। তার এই ভাষণে মন্ত্রীসভার নীতি ও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় তা ছাড়া কোনো বিল বা অন্য কোনো বিষয়ে রাষ্ট্রপতি বার্তা পাঠাতে পারেন।
বিলটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদের কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিলটি সংসদের উভয়কক্ষে পুনরায় দ্বিতীয়বার গৃহীত হলে রাষ্ট্রপাত তাতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন (১১১ নং ধারা)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সংবিধানের সংশোধন সংক্রান্ত কোনো বিল সংসদের উভয়কক্ষে গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি তাতে অসম্মতি জানাতে পারেন না।
(iii) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতাগুলি হল
🅐 অর্থবিল অনুমোদন
🅑 বাজেট প্রস্তাবনা
🅒 আপৎকালীন ব্যয়নির্বাহা
🅓 অর্থ কমিশন গঠনা
প্রয়োজন হয়।
🅑 বাজেট প্রস্তাবনা: প্রত্যেক আর্থিক বছরের জন্য সরকারের আনুমানিক আয়ব্যয়ের বিবরণী বা বাজেট অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সংসদে উত্থাপন করেন।
🅒 আপৎকালীন ব্যয়নির্বাহা : আপৎকালীন ব্যয়নির্বাহের জন্য ভারতে যে আকস্মিক ব্যয়সংকুলান তহবিল (Contingency Fund of India) রয়েছে, তার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
🅓 অর্থ কমিশন গঠনা : কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্ব বণ্টনের জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি অর্থ কমিশন গঠন করার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির রয়েছে।
(iv) বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে—
🅐 বিচারপতি নিয়োগ
🅑 দণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদান
🅐 বিচারপতি নিয়োগ : সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করার ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। সংসদের সুপারিশে এই বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতির আছে।
🅑 দণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদান : ফৌজদারি মামলায় দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখা বা হ্রাস করা অথবা দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদান করার ব্যাপারেও রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতি মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদান করতে বা মৃত্যুদণ্ড রদ করে অন্য দণ্ড দিতে পারেন।
(v) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা : সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তিন ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন—
🅐 জাতীয় জরুরি অবস্থা (৩৫২ নং ধারা)
🅑 রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা (৩৫৬নং ধারা)
🅒 আর্থিক জরুরি অবস্থা (৩৬০ নং ধারা)
🅐 জাতীয় জরুরি অবস্থা (৩৫২ নং ধারা) : রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহের ফলে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, তাহলে তিনি সমগ্র দেশে বা দেশের
কোনো অংশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
🅑 রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা (৩৫৬নং ধারা) : কোনো রাজ্যের রাজ্যপালের প্রতিবেদন বা অন্য কোনো সূত্র থেকে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে ওই
রাজ্যে সংবিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে তিনি ওই রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।
🅒 আর্থিক জরুরি অবস্থা (৩৬০ নং ধারা) : যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে ভারতের বা ভারতের কোনো অংশের আর্থিক স্থায়িত্ব বা সুনাম বিনষ্ট হয়েছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে তিনি আর্থিক জরুরি
অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।
❑ উপসংহার: ভারতের সংসদীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোকসভায় কোনো দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতি যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তা তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতায় এক নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে।
❑ অষ্টম অধ্যায়ঃ ভারতের আইন বিভাগ
প্রশ্ন ১. ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো?
প্রশ্ন ১. ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো?
ভূমিকাঃ ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভাকে
পার্লামেন্ট বা সংসদ বলে। রাষ্ট্রপতি এবং দু'টি কক্ষ নিয়ে ভারতীয় পার্লামেন্ট
গঠিত। কক্ষ দু'টির মধ্যে উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিম্নকক্ষ লোকসভা নামে পরিচিত।
❑ পার্লামেন্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি :
❍ আইন-সংক্রান্ত : সংবিধান অনুসারে পার্লামেন্ট কেন্দ্রীয় তালিকাভুক্ত এবং যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করে। যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে অঙ্গরাজ্যের আইনসভাগুলিও আইন প্রণয়ন করতে পারে। তবে রাজ্যের আইনের সঙ্গে যদি কেন্দ্রের আইনের বিরোধ বাধে তা হলে রাজ্যের আইন বাতিল হয়ে যায় এবং কেন্দ্রের আইন বলবৎ হয়।
❍ সংবিধান সংশোধন : সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের দু'টি কক্ষের সমান ক্ষমতা রয়েছে। সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারা অনুসারে কতকগুলি ক্ষেত্রে সাধারণ পদ্ধতিতে এবং কতকগুলি ক্ষেত্রে বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে একক ক্ষমতাসম্পন্ন।
❍ নির্বাচন-সংক্রান্ত : পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সদস্যগণ রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁরা বিধানসভার সদস্যদের সঙ্গে একযোগে নির্বাচক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পার্লামেন্টের দুই কক্ষের সদস্যগণ নির্বাচক হিসেবে কাজ করেন।
❍ কমিশন নিয়োগ : দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন তথ্যের জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট বিভিন্ন কমিশন নিয়োগ করে, যেমন বর্তমানে শেয়ার কেলেঙ্কারির জন্য পার্লামেন্ট ‘মেধা কমিশন’ নিয়োগ করেছে। এছাড়াও ‘সারকারিয়া কমিশন’, ‘শাহ কমিশন’ প্রভৃতির নামও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়।
❍ বিচার ও অপসারণ-সংক্রান্ত : পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতির বিশেষ বিচার করে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনার প্রমুখ ব্যক্তিকে পার্লামেন্ট নির্দিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অপসারণ করতে পারে।
❍ অর্থ-সংক্রান্ত কাজ : ভারতীয় পার্লামেন্ট সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে। পার্লামেন্ট বাজেট প্রণয়ন, কর ধার্য, কর বিলোপ বা সংশোধন অনুমোদন করে থাকে। তবে অর্থ-সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যসভার ক্ষমতা খুবই কম। এক্ষেত্রে লোকসভাই যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে।
❑ উপসংহার: তত্ত্বগত দিক থেকে ভারতীয় পার্লামেন্ট প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হলেও কার্যত আজ ক্যাবিনেটের নির্দেশে পার্লামেন্টের সকল ক্ষমতা পরিচালিত হয়। আর সেই ক্যাবিনেটের একনায়কত্বের কাছে ভারতীয় পার্লামেন্ট হারিয়ে ফেলেছে তার সার্বভৌম চরিত্র।
অথবা,
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি লেখো।
ভূমিকাঃ পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে একটি করে আইনসভা রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও রাজ্য বিধানসভা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা গঠিত। এই
আইনসভা প্রথমে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ছিল। ১৯৬৯ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে
উচ্চকক্ষ বিধান পরিষদের বিলোপ সাধন করা হয়। সংবিধান অনুসারে রাজ্য বিধানসভার
সদস্যসংখ্যা সর্বাধিক ৬০০ এবং সর্বনিম্ন ৬০ হতে পারে।
❑ ক্ষমতা ও কার্যাবলি : পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভার মতো নিম্নলিখিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যাবলি রয়েছে।
❍ আইন প্রণয়ন : বিধানসভা সংবিধানের রাজ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত যে কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এছাড়া যুগ্ম তালিকায় উল্লেখিত কোনো বিষয়েও আইন প্রণয়ন করতে পারে। রাজ্যপাল প্রণীত অধ্যাদেশগুলি বিধানসভার অনুমতি সাপেক্ষ এবং এই সভা ঐগুলি যে কোনো সময় বাতিল করতে পারে।
❍ অর্থ-সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিধানসভা
রাজ্যের অর্থব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজ্য সরকারের যাবতীয় ব্যয়,
করধার্য ও ঋণগ্রহণের জন্য বিধানসভার আইনগত অনুমোদন আবশ্যক। সরকারের বাৎসরিক
ব্যয়বরাদ্দের হিসাব বা বাজেট বিধানসভায় পেশ করতে হয়। বিধানসভা ব্যয়বরাদ্দের
দাবি অনুমোদন করে এবং অর্থবিল পাশ করে।
❍ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ : বিধানসভায় সদস্যগণ মন্ত্রীদের প্রশ্ন করতে পারেন, মন্ত্রীপরিষদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা ও প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেন এবং মন্ত্রীপরিষদের বিরুদ্ধে অনাস্থাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করে সরকারকে পদচ্যুত করতে পারেন।
❍ সংবিধান সংশোধ: সংবিধান সংশোধনের মূল ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে অর্পিত হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের ৩৬৮ ধারা অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় স্বার্থ সম্পর্কিত কতকগুলি বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের জন্য পার্লামেন্ট ছাড়াও অন্তত অর্ধের অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সম্মতি প্রয়োজন।
❍ সর্বসাধারণের স্বার্থজড়িত যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক : বিধানসভার সদস্যগণ সংবিধান ও সভার কার্যাবলি পরিচালনা-সংক্রান্ত
বিধিনিষেধগুলি মান্য করে সর্বসাধারণের স্বার্থজড়িত যে কোনো প্রশ্ন আলোচনা করার
জন্য পূর্ণ বাক্ স্বাধীনতা ভোগ করেন।
❑ অন্যান্য ক্ষমতাঃ
(১) বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যগণ রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচক সংস্থার অংশরূপে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। (২) বিধানসভা তার সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ ও অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষরূপে নিযুক্ত করে। (৩) বিধানসভা সংবিধানের ব্যবস্থা অনুসারে তার কাজ পরিচালনা-সংক্রান্ত পদ্ধতি প্রণয়ন করে।
❑ উপসংহার: ভারতে কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় আধুনিক কালে পার্লামেন্ট অপেক্ষা কেন্দ্রীয় সরকার যেমন প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে, তেমনি রাজ্যেও বিধানসভা অপেক্ষা সরকারই বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
❑ নবম অধ্যায়ঃ ভারতের বিচার বিভাগ
প্রশ্ন ১. সুপ্রিম কোর্টের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো।
ভূমিকা : ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
হলো দেশের সর্বোচ্চ বিচার সংস্থা। এই আদালত ভারতের অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার
শীর্ষে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয় রূপে, মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক
রূপে, সংবিধানের অভিভাবক রূপে ও দেশের সর্বোচ্চ আপিল আদালত রূপে ভারতের সুপ্রিম
কোর্ট ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাই বলা
যায় যে
(“This court will play a great and singular role and establish itself in
the consciousness of the Indian people”)।
❍ গঠন : সংবিধানের ১২৪ (১) ধারায় বলা হয়েছিল পার্লামেন্ট আইন করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সংখ্যা স্থির না করা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ও অনধিক ৭ জন বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে। ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টের আইন অনুসারে ১জন প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য ২৫ জন সহকারী বিচারপতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হয়। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি রয়েছেন ২৯ জন।
❑ সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি :
সুপ্রিম কোর্টের কার্যাবলিকে প্রধানত মূল, আপিল,
পরামর্শদান এবং নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি - এই চারটি এলাকায় ভাগ
করে আলোচনা করা যায়।
❶ মূল এলাকা : কেন্দ্রীয় সরকার এবং এক
বা একাধিক রাজ্য সরকারের মধ্যে অথবা দুই বা ততোধিক রাজ্য সরকারের মধ্যে আইনগত
অধিকার নিয়ে বিরোধ বাধলে কিংবা রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন-সংক্রান্ত
যে কোনো প্রশ্ন বা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের মূল এলাকার
অর্ন্তভুক্ত।
❷ আপিল এলাকা : সুপ্রিম কোর্ট ভারতের সর্বোচ্চ আপিল আদালত। সুপ্রিম কোর্টে চার ধরনের আপিল করা যায়, যথা – (১) সংবিধানের ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত আপিল, (২) দেওয়ানি আপিল, (৩) ফৌজদারি আপিল এবং (৪) বিশেষ অনুমতির মাধ্যমে আপিল।
❸ পরামর্শদান এলাকা : সুপ্রিম কোর্টের প্রধান কাজ রাষ্ট্রপতিকে সাংবিধানিক পরামর্শ দেওয়া। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন যে দেশে সাংবিধানিক সংকট দেখা দিয়েছে, তা হলে তিনি সেই প্রশ্নটিকে বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠাতে পারেন। এ পর্যন্ত বহুবার সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় মন্দির, মসজিদ বিতর্কে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চেয়েছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ করতে বাধ্য নন।
❹ নির্দেশ-আদেশ ও লেখ জারির এলাকা : কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার খুন্ন হলে তিনি সুপ্রিম কোর্টের নিকট আবেদন করেতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট এই অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য পাঁচ রকম নির্দেশ, আদেশ বা লেখ জারি করতে পারে। এগুলি হলো- (১) বন্দিপ্রত্যক্ষীকরণ, (২) পরমাদেশ, (৩) প্রতিষেধ, (৪) অধিকার পৃচ্ছা এবং (৫) উৎপ্রেষণ। অবশ্য দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত থাকলে সুপ্রিম কোর্টের এই ক্ষমতা সংকুচিত হয়।
❑ উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার পরিপেক্ষিতে বলা যায় যে এই আদালত একাধারে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত, সর্বোচ্চ আপিল আদালত, সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষক এবং রাষ্ট্রপতির আইনগত পরামর্শদাতা। এই এক্তিয়ারগত বিচারে সংবিধান বিশেষজ্ঞ কৃষ্ণস্বামী আয়ার যথার্থই মন্তব্য করেছেন। (“The Supreme Court in the Indian union has more powers than any supreme court in any part of the world.")
প্রশ্ন ২. ভারতের বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য লেখ?
ভূমিকা : ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য :
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিচার ব্যবস্থার একটি স্বাধীন,
স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ ভূমিকা স্বীকৃত হয়েছে। ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার
লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যগুলি হলো –
❍ এক ও অখণ্ড বিচার ব্যবস্থা :
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে দ্বৈত বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তে সারা দেশের জন্য এক ও
অখণ্ড বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এই অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে
রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
❍ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের উপস্থিতি :
ভারতীয় বিচার ব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের
উপস্থিতি। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টকে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বলা
হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধারে সংবিধানের অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা
কর্তা এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা।
❍ অভিন্ন বিধিব্যবস্থার প্রচলন :
ভারতের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো সারা দেশের জন্য অভিন্ন
বিধিব্যবস্থার প্রচলন।
❍ বিশেষ আদালতের অস্তিত্ব :
ভারতের বিচার ব্যবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য
বিশেষ আদালতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ শিল্পক্ষেত্রে
শ্রমিক-মালিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শিল্প আদালত, সামরিক বাহিনীর জন্য সামরিক
আদালত, সরকারি কর্মচারী, স্থানীয় সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের
চাকরি সম্পর্কিত যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক আদালত ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য।
❍ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা : ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় বিচারপতিরা যাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ
সম্পাদন করতে পারেন সেজন্য সংবিধানে কয়েকটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া
হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত
বিধিব্যবস্থা, অবসরগ্রহণের পর কোনো আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার ওপর
নিষেধাজ্ঞা, বিচারপতিদের রায়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে
পার্লামেন্টের ক্ষমতার বাইরে রাখা ইত্যাদি।
❍ বিশেষ আইনি সাহায্য : ভারতের
মতো দেশে দরিদ্র জনসাধারণের পক্ষে অনেক সময় মামলার বিপুল ব্যয়ভার বহন করা
সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনগণ যথাযথ
ন্যায়বিচার লাভ থেকে বঞ্চিত হন। ভারতে বর্তমানে এই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল
শ্রেণির জন্য সরকারি আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ক্রেতা বা কনজিউমার বলা হয়। এই ক্রেতা কোনো জিনিস বা পরিসেবা কিনতে গিয়ে প্রতারিত হলে আইনগত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিকার পেতে পারেন, তাকে বলা হয় ক্রেতা আদালত (Consumer Court) । ভারতে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন' (Con- sumer Protection Act, 1986) অনুসারে ক্রেতা আদালত গঠন করা হয়।
❍ ক্রেতা আদালতের উদ্দেশ্য ও গঠনঃ : ক্রেতা আদালতের প্রধান উদ্দেশ্য হল ক্রেতাদের সুরক্ষা প্রদান। ক্রেতার স্বার্থ দেখাই তার মূল কাজ । প্রবঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতার অভিযোগ বা নালিশের আইনসম্মত সুষ্ঠু প্রতিকার বা নিষ্পত্তিবিধানই এর উদ্দেশ্য। দেশের ক্রেতা সাধারণের উপকার ও সুরক্ষার মহৎ উদ্দেশ্যে ই গঠিত হয় ক্রেতা আদালত। ক্রেতা আদালতের তিনটি স্তর রয়েছে এগুলি হল- ❶ জেলা স্তরের ক্রেতা আদালত
❷ রাজ্য স্তরের ক্রেতা আদালত
❸ জাতীয় স্তরের ক্রেতা আদালত।
ক্রেতা সুরক্ষা আইনে অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে আদালতের পরিবর্তে ‘কনজিউমার
ডিসপিউটস রিড্রেসাল এজেন্সিজ’ ক্রেতা বিরোধ নিষ্পত্তির এজেন্সি বলে অভিহিত করা
হয়েছে। যাই হোক, বর্তমানে সারা ভারতে জেলাস্তরে ক্রেতা আদালত রয়েছে ৪৫০টিরও
বেশি । রাজ্যস্তরে প্রতি রাজ্যে আছে রাজ্য ক্রেতা আদালত বা রাজ্য কমিশন ও
জাতীয় স্তরে রয়েছে জাতীয় ক্রেতা আদালত বা জাতীয় কমিশন।
❍ ক্রেতা আদালতের বৈশিষ্ট্য :
ক্রেতা আদালত একেবারে ভিন্ন। ক্রেতা আদালতের কতকগুলি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
❶ শুধু ক্রেতাদের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত: ক্রেতা আদালত শুধুমাত্র ক্রেতাদের স্বার্থরক্ষার জন্য গঠিত।এই আদালতে ক্রেতা বা
উপভোক্তা ছাড়া অন্য কেউ এখানে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন না। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে
যে আইনে ক্রেতা আদালতের জন্ম হয়, সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এই আইনের
লক্ষ্য হল শুধুমাত্র ক্রেতার সুরক্ষা, বিক্রেতার নয়। বিক্রেতা বা পরিসেবা
প্রদানকারী তার নিজের অভিযোগ নিয়ে ক্রেতা আদালতে আসতে পারেন না এবং ক্রেতা
আদালতও ওই নালিশ গ্রহণ করতে বা বিচার করতে পারেন না।
❷ তিনটি স্তরে বিন্যস্ত: ক্রেতা আদালত তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। শীর্ষে রয়েছে জাতীয় ক্রেতা আদালত বা জাতীয় কমিশন, তার পরবর্তী ধাপে রয়েছে রাজ্য ক্রেতা আদালত বা রাজ্য কমিশন এবং সর্বনিম্ন ধাপে রয়েছে জেলা ক্রেতা আদালত। এই আইনে ক্রেতা-বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য গঠিত এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘এজেন্সি’ বলা হয়ে থাকে।
❸ শুধুমাত্র বাদী পক্ষ বা অভিযোগকারীর নালিশ: ক্রেতা আদালতের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এখানে শুধুমাত্র বাদী পক্ষ অর্থাৎ ক্রেতার অভিযোগের ভিত্তিতে নালিশ গ্রহণ করা হয়। অন্যান্য আদালতে বাদী ও বিবাদী দু-পক্ষেরই নালিশ বা অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা রয়েছে।
❹ শুধু জিনিস নয়, পরিসেবাও অন্তর্ভুক্ত: ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ক্রেতাদের ক্রয় করা জিনিস নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির সাথে ক্রেতারা অর্থের বিনিময়ে যে সমস্ত পরিসেবা গ্রহণ করেন তাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। চিকিৎসা পরিসেবাও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে চলে এসেছে। সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুসারে মূল্যের বিনিময়ে যে চিকিৎসা পরিসেবা দেওয়া হয় তা এবং কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে বিনামূল্যে দেওয়া চিকিৎসা পরিসেবাও এই আইনের আওতায় আসবে। অনুরূপভাবে, একজন আইনজীবী তার মক্কেলকে মূল্যের বিনিময়ে যে আইনি পরিসেবা দেন তাও এই আইনের আওতায় পড়ে।
❺ স্বল্প ব্যয়ে নালিশ জানানোর সহজ পদ্ধতি:
ক্রেতা আদালতে ক্রেতারা অত্যন্ত অল্প খরচে সহজ সরল পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নালিশ
বা অভিযোগ জানাতে পারেন। স্ট্যাম্প ছাড়া সাদা কাগজে ইংরেজি বা বাংলায়
পরিষ্কার হস্তাক্ষরে বা টাইপ করে অভিযোগপত্র সরাসরি জমা দেওয়া যায়।
দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থিত অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার কার্ডধারীদের অভিযোগপত্রের
সঙ্গে কোনোরকম ফি দিতে হয় না।