ইতিহাস কাকে বলে উত্তর এবং আমরা ইতিহাস পড়ি কেন?


Q. ইতিহাস পাঠের প্রয়ােজনীয়তা? ইতিহাস শব্দের অর্থ কি? ইতিহাস কেন পড়বাে?

ロ আমরা ইতিহাস কেন পড়ি? এর উত্তর দেবার আগে প্রথমেই আমাদের জানতে হয় ইতিহাস’ শব্দটি কীভাবে তৈরি হল ইতিহ+আস=ইতিহাস এর আক্ষরিক অর্থ হল উপদেশ পরম্পরার আধার, অর্থাৎ যাতে পরম্পরাগত উপদেশ আছে । একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, ইতিহাস হচ্ছে পূর্ববৃত্তান্ত বা পুরাবৃত্ত বা প্রাচীন কথা। একে অতীতের হিনিও বলা চলে। যা হয়ে গিয়েছে তার ঠিক ঠিক ছবিটি এখানে তুলে ধরা হয়।

সেই জন্য ইতিহাসকে বলা হয় ইতিবৃত্ত। অতীত ঘটনার ফলাফল দেখে বর্তমানকে কীভাবে। আয়ত্ত করলে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়া যাবে, ইতিহাস আমাদের সে কথা জানায়। বাস্তবিকই বর্তমানকে বুঝতে হলে অতীতকে জানতে হয়, নইলে বর্তমানের পুরাে অর্থ স্পষ্ট হয় না। কিন্তু এই ইতিহাস কাদের ইতিহাস? এ কি শুধু রাজা-বাদশাদের যুদ্ধ কালিনি? না; তা নয়। আসলে ইতিহাস তৈরি করে সাধারণ মানুষ। তাই মানুষ কোথা থেকে এল কবে এল, কীভাবে সমাজ গড়ে উঠল—এসবও ইতিহাসের বিষয়। শুধু কি তাই? মােটেওনয়। একেবারে গােড়ার দিকে মানুষ কী অবস্থায় ছিল, কেমন ছিল, সেই অবস্থাকে কেমন করে জয় করল, কীভাবে সমাজ ও সভ্যতার বদল ঘটল, উন্নতি দেখা দিল তার ধারাবাহিক কাহিনীও হয়ে উঠল ইতিহাসের অন্তর্গত। বরং বলতে পারি, মানব সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তন ও উন্নতির ধারাবাহিক কাহিনি হল মানুষের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রতি যুগ আনে না আপন অবসান,সম্পূর্ণ করে না তার গান। ধারাবাহিকতা ইতিহাসের ভেতরের কথা। অতীত আমাদের সবসময়েই শিক্ষিত করে, সচেতন করে। সেজন্য কবিগুরু অন্যত্র বলেছেন, “হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে,/কাজ করে যাও গােপনে গােপনে।" বাস্তবিকই, ইতিহাস কোথাও থমকে দাঁড়ায় না। যদি তার কোনাে দাম একালে না থাকত তাহলে ইতিহাস পড়ার তেমন কোনাে মানে আমরা খুঁজে পেতাম না। তাই আমরা ইতিহাস পড়ি মানব সভ্যতার অতীত ও বর্তমানকে জানতে, আর ভবিষ্যতের উন্নতির পথ খুঁজে নিতে

আগেই বলেছি, ইতিহাস হল সাধারণ মানুষের ইতিহাস। সেখানে রাজা-বাদশা, তাদের শাসন-শােষণ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, যেমন থাকতে পারে তেমনি থাকবে সাধারণ মানুষের কথা, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা, সভ্যতা গড়ে তােলা ও তার উন্নতি সাধনে তাদের ভূমিকার কথাও। কাজে কাজেই যে ইতিহাস মানুষকে নিয়েই মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা তৈরি, সেই মানুষ এই পৃথিবীতে কবে এল তা জানা আমাদের খুবই জরুরি। হ্যা, জীবজগতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে আজ থেকে প্রায় বিশ লক্ষ বছর আছে। তবে সে-সময়ে মানুষের চেহারা ঠিক আজকের মতাে ছিল না। তাদের জীবনধারণের ধরনটাও
ছিল আজকের থেকে বেশ আলাদা। তার ওপর সেই সময়কার মানুষের ছিল প্রতিকূল পরিবেশ। ফলে ছিল অসহায়। প্রতিটি মুহূর্তে ছিল তার হিংস্র জীব-জন্তুর আক্রমণের ভয়। ছিল খাদ্যেরও অভাব, তবু মানুষ বেঁচে রইল।

এগিয়ে গেল বাধা-বিপত্তিকে হার মানাল। এসব করতে মানুষ তাঁর শ্রমকে লাগাল কাজে, শিখল দল বাঁধার প্রয়ােজনীয়তা, বের করল আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রামের নানা উপায়। মানুষ টেক্কা দিল জীব-জগতের অন্য সব প্রাণীকে। মানুষের জীবনে এল পরিবর্তনের ছোঁয়া। হাতিয়ার বানাল। ফসল বুনতে শিখল। বুনাে পশুকে পােষ মানাতে লাগল, নিজেদের প্রয়ােজনে লাগাল তাদের কাজে। পোশাক তৈরি, চাষ-আবাদ, বাড়িঘড় বানাতেও শিখে ফেলল মানুষ। পরিবেশকে বদলাল। আকৃতি-প্রকৃতি হল পরিবর্তিত। এল ভাষা, করল লিপির ব্যবহার। একসময় মানব সমাজের অঙ্গ হয়ে উঠল কারিগরি শিল্প, ধন, আইন-কানুন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আমােদ-প্রমােদ, উৎসব ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এগিয়ে চলল মানব সভ্যতার রথ। মানব সমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক এই এগিয়ে চলার কাহিনিই হল ইতিহাস

সেই অগ্রগতি কীভাবে হল, কেমন করে মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি সাধন করল সে সব জানার জন্যই আমরা ইতিহাস পড়ব। হ্যা, প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল এই পৃথিবীতে। জীবজগতের মধ্যে মানুষই এসেছে সবার পরে। আর মানুষ যেদিন থেকে পৃথিবীতে আসে সেদিন থেকে মানুষের ইতিহাস তৈরি হতে থাকে। সেই ইতিহাসের উপাদানগুলাে একালে হুবহু পাওয়া যায় না। তবু একালের মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রাচীন মানব সভ্যতার ছবিটিকে ঠিক ঠিক জানতে। এর জন্য অসীম ধৈর্য ও যত্ন নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন নৃ-বিজ্ঞানী, প্রত্ন-বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকেরা।

                                            --------------

Q. ইতিহাসের ধারণা?

ロ গল্পের মতাে যদি ইতিহাস বই পড়া যায় তবে তা সহজেই মুখস্থ হয়ে যায়। ইতিহাস শব্দের মানে পুরােনাে দিনের কথা। আর পুরােনাে দিনের এই কথাই থাকবে দিনে দিনে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। একদিনে এই পরিবর্তন হয়নি। ধাপে ধাপে এই পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে তারা পাথরের ব্যবহার শিখেছে, তারপর শিখেছে ধাতুর ব্যবহার বিদ্যুতের ব্যবহার শিখেছে অনেক বছর পর। ইতিহাস জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে কোন জিনিস আগে এসেছে,কোন জিনিস পরে এসেছে। আগে পরে আসার কারণ কী?

পুরােনাে দিনের কথা জানা যায় পুরােনাে দিনের লেখা পড়ে, ছবি দেখে। পুরােনাে দিনের ঘটনা সঠিকভাবে জানা যায় না কারণ সমস্ত কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত। প্রত্নবিজ্ঞানীরা অর্থাৎ যাঁরা মাটি খুঁড়ে পুরােনাে জিনিস সংগ্রহ করেন তারা বিভিন্ন ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করেন এবং তার দ্বারা অনুমান করা হয়। প্রত্নবিজ্ঞানীরা টুকরাে টুকরাে উপাদান জুড়ে একটা ছবি বানান। যেখানে টুকরাে পাওয়া যায় না বা হারিয়ে যায় সেখানে ফাঁক থেকে যায়। ইতিহাস বােঝার সুবিধার জন্য সময়কে অনেক যুগে ভাগ করা হয়েছে।

হাজার হাজার বছরকে বােঝাতে একটা শব্দ ব্যবহার করা হয় সেটাই হল যুগ। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবী যখন বরফে ঢাকা ছিল তখন তাকে তুষার যুগ বলা হয়। আবার যখন মানুষ তামা, ব্রোঞ্জ, লােহা প্রভৃতি ধাতুর ব্যবহার শিখল তখন সেই সময়টাকে বােঝাতে ধাতুর যুগ বলা হয়। লােহার ব্যবহার শিখল যখন, তখন থেকে লােহার যুগ শুরু। লােহার ব্যবহার বেশি সুবিধা হওয়ায় ব্যবহার দিনে দিনে বাড়তে থাকে। ইতিহাস বুঝতে হলে ভূগােলও জানতে হয়। ইতিহাস ও ভূগােল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রােত-ভাবে জড়িত। মানুষের অনেক কাজই তার পরিবেশ ও ভূগােল দিয়ে গঠিত হয়। যারা নদীর পাশে থাকেন তাদের রােজকার কাজকর্মে নদীর গুরুত্ব যেমন আবার যারা মরুভূমি অঞ্চলে থাকেন তাদের সেখানে নদীর গুরুত্ব কম। তারা উঠে চড়ে যাতায়াত করে। যেমন রাজস্থানের লােকেরা আবার অঞ্চলের প্রকার ভেদে খাবার, পােশাক, যানবাহন, ব্যবসা-বাণিজ্য কাজকর্মের নানান তফাত। সমতল অঞ্চলে ধান চাষ বেশি হওয়ায় ভাত খাওয়ার বেশি প্রচলন আবার রাজস্থানে রুটি খাওয়ার চল বেশি। তাই ইতিহাস জানতে হলে ভূগােল জানাও প্রয়ােজন।

প্রাচীন সভ্যতা বেশিরভাগই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। এগুলিকে নদীমাতৃক সভ্যতা বলা হয়। উপমহাদেশ মানে প্রায় একটা মহাদেশের মতােই বড়াে অঞ্চল। ভারতের বিরাট অঞ্চলকে একসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশ বলা হয়। সেখানে নানারকম পরিবেশ ও মানুষ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সব মিলিয়ে এই উপমহাদেশ। এই মহাদেশের উত্তরদিকে পাহাড়ি অঞ্চল। সিন্ধু ও গঙ্গা নদীর দুপাশে বিরাট সমভূমি অঞ্চল। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণ দিকে তিনকোণা অঞ্চল। বিন্ধ্যপর্বত ভারতবর্ষকে উত্তর ও দক্ষিণ অংশে ভাগ করেছে। উত্তর অংশের অঞ্চলকে বলা হয় আর্যাবত এবং দক্ষিণভাগকে বলে দাক্ষিণাত্য। বিন্ধ্য-পর্বত থেকে কন্যাকুমারিকা হল দাক্ষিণাত্য অঞ্চল। দ্রাবিড় জাতির বাস থাকায় কাবেরী নদীর দক্ষিণ অংশকে দ্রাবিড় দেশও বলা হয়। ভরত নামে একটি পুরােনাে জনগােষ্ঠী ছিল। ওই জনগােষ্ঠীর নাম অনুসারেই ভারতবর্ষ নাম হয়।

 ভারত শব্দের অর্থ হল ভরতের বংশধর। তবে ভারতবর্ষ বলতে সবসময় পুরাে ভারতীয় উপমহাদেশকে বােঝাত না। একসময় মানুষ লিখতে পারত না, সেই সময়ের কথা আমরা অনুমান করি। সেই সময়কে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগ বলে। যখন মানুষ লিখতে শিখল কিন্তু সেই সময়ের পাওয়া সব লেখা আজও পড়া যায়নি সেই সময়টাকে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগ বলে। আর যে সময়ের লেখা পাওয়া যায় ও পড়া যায় তা হল ঐতিহাসিক যুগ। মানুষ লিখতে শেখার পর থেকেই সহজ হলাে পুরােনাে দিনের কথা জানা। আনুমানিক কথার দরকার কমে এল। সময় বােঝাতে সাল ও অব্দের ব্যবহার শুরু হল। বিভিন্ন রাজাদের শাসন ধরে অব্দ গােনা চালু হল যেমন—কণিষ্কাব্দ, গুপ্তাব্দ, হাব্দ, যিশুখ্রিস্টের জন্মকে ধরে যে অব্দ  সাল গােনা হয় তা হল খ্রিস্টাব্দ। আর যিশুর জন্মের আগে কে বলে খ্রিস্টপূর্বাব্দ। খ্রিস্টাব্দ গােনা হয় ছােটো থেকে বড়াে হিসাবে আর, খ্রিস্টপূর্বাব্দ গোেনা হয় বড়াে থেকে ছােটোর দিকে। খ্রিস্টীয় শতক গােনার সময় একধাপ এগিয়ে গােনা হয়। যেমন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ হল খ্রিস্টীয় বিংশ শতক একটা বড়াে অঞ্চল জুড়ে অনেক সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা খোঁড়ার কাজ চালান। ওই অঞ্চলটাকে প্রত্নক্ষেত্র বলা হয়। প্রত্নক্ষেত্র থেকে নানারকম প্রত্নবস্তু পাওয়া যায়। কখনও ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগরের চিহ্ন, কখনও বা নানা পাত্র, সিলমােহর, মূর্তি। পুরােনাে মুদ্রা,গয়না, অস্ত্র-শস্ত্র, মূর্তি এইসব জিনিস থেকে পুরােনাে দিনের কথা জানা যায় এগুলিই ইতিহাসের উপাদান। এই মাটির নীচে চাপা পড়া নানা প্রত্নবস্তু যত্ন করে রাখা থাকে জাদুঘরে, কলকাতা শহরে বিরাট একটা জাদুঘর রয়েছে।

ইতিহাসের উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লেখমালা। পাথরে খােদাই লেখাগুলিকে শিলালেখ বলে। আবার শাসকের গুণগান লেখ হিসাবে খােদাই করালে প্রশস্তি বলে। যেমন—সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানর জন্য মুদ্রাও কাজে লাগে। মুদ্রায় শাসকের নাম, ছবি প্রভৃতি খােদাই করা থাকে। অব্দও পাওয়া যায় মুদ্রায়। শক ও কুষাণদের ইতিহাস তাে
তাদের মুদ্রা থেকে জানা যায়। শিল্পবস্তু থেকেও ইতিহাসের নানা কিছু জানা যায়। পাথর, ধাতু ও পােড়ামাটির উপর খােদাই করা দেব-দেবী, মানুষ ও পশুর মূর্তি, গুহার দেওয়ালগুলােতে আঁকা ছবি ও বাড়িঘর, প্রাসাদ, মন্দির থেকেও ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়াও দেশি ও বিদেশি লেখকদের
রচনা থেকেও ইতিহাস জানা যায়। দেশীয় সাহিত্য ধর্মভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। রাজনীতি, ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, কাব্য, নাটক, অভিধান, চিকিৎসা বিষয়ক বই থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। বৈদিক সাহিত্য থেকে ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের ইতিহাস জানা যায়।

গ্রিক, রােমান ও চিনা দূত ও পর্যটকদের বিবরণ থেকেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। তবে বিদেশি সাহিত্যগুলির কয়েকটি সমস্যা আছে। বিদেশিরা ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি বুঝতেন না। ফলে অনেক কিছুর মানে বুঝতে তাদের ভুল হয়েছিল। এছাড়াও অনেক লেখার মধ্যে, পক্ষপাতিত্ব ছিল। তবুও প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস জানার জন্য সাহিত্য উপাদানগুলাের গুরুত্ব রয়েছে।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন