Q. ইতিহাস পাঠের প্রয়ােজনীয়তা? ইতিহাস শব্দের অর্থ কি? ইতিহাস কেন পড়বাে?
সেই জন্য ইতিহাসকে বলা হয় ইতিবৃত্ত। অতীত ঘটনার ফলাফল দেখে বর্তমানকে কীভাবে। আয়ত্ত করলে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়া যাবে, ইতিহাস আমাদের সে কথা জানায়। বাস্তবিকই বর্তমানকে বুঝতে হলে অতীতকে জানতে হয়, নইলে বর্তমানের পুরাে অর্থ স্পষ্ট হয় না। কিন্তু এই ইতিহাস কাদের ইতিহাস? এ কি শুধু রাজা-বাদশাদের যুদ্ধ কালিনি? না; তা নয়। আসলে ইতিহাস তৈরি করে সাধারণ মানুষ। তাই মানুষ কোথা থেকে এল কবে এল, কীভাবে সমাজ গড়ে উঠল—এসবও ইতিহাসের বিষয়। শুধু কি তাই? মােটেওনয়। একেবারে গােড়ার দিকে মানুষ কী অবস্থায় ছিল, কেমন ছিল, সেই অবস্থাকে কেমন করে জয় করল, কীভাবে সমাজ ও সভ্যতার বদল ঘটল, উন্নতি দেখা দিল তার ধারাবাহিক কাহিনীও হয়ে উঠল ইতিহাসের অন্তর্গত। বরং বলতে পারি, মানব সমাজ ও সভ্যতার পরিবর্তন ও উন্নতির ধারাবাহিক কাহিনি হল মানুষের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, প্রতি যুগ আনে না আপন অবসান,সম্পূর্ণ করে না তার গান। ধারাবাহিকতা ইতিহাসের ভেতরের কথা। অতীত আমাদের সবসময়েই শিক্ষিত করে, সচেতন করে। সেজন্য কবিগুরু অন্যত্র বলেছেন, “হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে,/কাজ করে যাও গােপনে গােপনে।" বাস্তবিকই, ইতিহাস কোথাও থমকে দাঁড়ায় না। যদি তার কোনাে দাম একালে না থাকত তাহলে ইতিহাস পড়ার তেমন কোনাে মানে আমরা খুঁজে পেতাম না। তাই আমরা ইতিহাস পড়ি মানব সভ্যতার অতীত ও বর্তমানকে জানতে, আর ভবিষ্যতের উন্নতির পথ খুঁজে নিতে।
আগেই বলেছি, ইতিহাস হল সাধারণ মানুষের ইতিহাস। সেখানে রাজা-বাদশা, তাদের শাসন-শােষণ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, যেমন থাকতে পারে তেমনি থাকবে সাধারণ মানুষের কথা, তাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা, সভ্যতা গড়ে তােলা ও তার উন্নতি সাধনে তাদের ভূমিকার কথাও। কাজে কাজেই যে ইতিহাস মানুষকে নিয়েই মানুষের জন্য মানুষের দ্বারা তৈরি, সেই মানুষ এই পৃথিবীতে কবে এল তা জানা আমাদের খুবই জরুরি। হ্যা, জীবজগতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে আজ থেকে প্রায় বিশ লক্ষ বছর আছে। তবে সে-সময়ে মানুষের চেহারা ঠিক আজকের মতাে ছিল না। তাদের জীবনধারণের ধরনটাওছিল আজকের থেকে বেশ আলাদা। তার ওপর সেই সময়কার মানুষের ছিল প্রতিকূল পরিবেশ। ফলে ছিল অসহায়। প্রতিটি মুহূর্তে ছিল তার হিংস্র জীব-জন্তুর আক্রমণের ভয়। ছিল খাদ্যেরও অভাব, তবু মানুষ বেঁচে রইল।
এগিয়ে গেল বাধা-বিপত্তিকে হার মানাল। এসব করতে মানুষ তাঁর শ্রমকে লাগাল কাজে, শিখল দল বাঁধার প্রয়ােজনীয়তা, বের করল আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রামের নানা উপায়। মানুষ টেক্কা দিল জীব-জগতের অন্য সব প্রাণীকে। মানুষের জীবনে এল পরিবর্তনের ছোঁয়া। হাতিয়ার বানাল। ফসল বুনতে শিখল। বুনাে পশুকে পােষ মানাতে লাগল, নিজেদের প্রয়ােজনে লাগাল তাদের কাজে। পোশাক তৈরি, চাষ-আবাদ, বাড়িঘড় বানাতেও শিখে ফেলল মানুষ। পরিবেশকে বদলাল। আকৃতি-প্রকৃতি হল পরিবর্তিত। এল ভাষা, করল লিপির ব্যবহার। একসময় মানব সমাজের অঙ্গ হয়ে উঠল কারিগরি শিল্প, ধন, আইন-কানুন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আমােদ-প্রমােদ, উৎসব ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এগিয়ে চলল মানব সভ্যতার রথ। মানব সমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক এই এগিয়ে চলার কাহিনিই হল ইতিহাস।
সেই অগ্রগতি কীভাবে হল, কেমন করে মানুষ তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতি সাধন করল সে সব জানার জন্যই আমরা ইতিহাস পড়ব। হ্যা, প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল এই পৃথিবীতে। জীবজগতের মধ্যে মানুষই এসেছে সবার পরে। আর মানুষ যেদিন থেকে পৃথিবীতে আসে সেদিন থেকে মানুষের ইতিহাস তৈরি হতে থাকে। সেই ইতিহাসের উপাদানগুলাে একালে হুবহু পাওয়া যায় না। তবু একালের মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রাচীন মানব সভ্যতার ছবিটিকে ঠিক ঠিক জানতে। এর জন্য অসীম ধৈর্য ও যত্ন নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন নৃ-বিজ্ঞানী, প্রত্ন-বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকেরা।
--------------
Q. ইতিহাসের ধারণা?ロ গল্পের মতাে যদি ইতিহাস বই পড়া যায় তবে তা সহজেই মুখস্থ হয়ে যায়। ইতিহাস শব্দের মানে পুরােনাে দিনের কথা। আর পুরােনাে দিনের এই কথাই থাকবে দিনে দিনে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। একদিনে এই পরিবর্তন হয়নি। ধাপে ধাপে এই পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে তারা পাথরের ব্যবহার শিখেছে, তারপর শিখেছে ধাতুর ব্যবহার বিদ্যুতের ব্যবহার শিখেছে অনেক বছর পর। ইতিহাস জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে কোন জিনিস আগে এসেছে,কোন জিনিস পরে এসেছে। আগে পরে আসার কারণ কী?
তাদের মুদ্রা থেকে জানা যায়। শিল্পবস্তু থেকেও ইতিহাসের নানা কিছু জানা যায়। পাথর, ধাতু ও পােড়ামাটির উপর খােদাই করা দেব-দেবী, মানুষ ও পশুর মূর্তি, গুহার দেওয়ালগুলােতে আঁকা ছবি ও বাড়িঘর, প্রাসাদ, মন্দির থেকেও ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়াও দেশি ও বিদেশি লেখকদের
রচনা থেকেও ইতিহাস জানা যায়। দেশীয় সাহিত্য ধর্মভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। রাজনীতি, ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, কাব্য, নাটক, অভিধান, চিকিৎসা বিষয়ক বই থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। বৈদিক সাহিত্য থেকে ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ের ইতিহাস জানা যায়।
গ্রিক, রােমান ও চিনা দূত ও পর্যটকদের বিবরণ থেকেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। তবে বিদেশি সাহিত্যগুলির কয়েকটি সমস্যা আছে। বিদেশিরা ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি বুঝতেন না। ফলে অনেক কিছুর মানে বুঝতে তাদের ভুল হয়েছিল। এছাড়াও অনেক লেখার মধ্যে, পক্ষপাতিত্ব ছিল। তবুও প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস জানার জন্য সাহিত্য উপাদানগুলাের গুরুত্ব রয়েছে।