ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর আলোচনা পর্ব - ২

Related Tags : ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর,ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর আলোচনা,মাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর,বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদের প্রশ্ন উত্তর,মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় প্রশ্ন উত্তর,চর্যাপদের প্রশ্ন উত্তর,মাধ্যমিক ইতিহাসের 4 নম্বর প্রশ্নের সাজেশন উত্তরসহ#,চর্যাপদ প্রশ্ন ও উত্তর,ইতিহাস,ইতিহাস নোটস গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন,প্রাচীন যুগের চর্যাপদের প্রশ্ন ও উত্তর,ইতিহাস প্রশ্ন-উত্তর,কমন প্রশ্ন,ক্লাস 9এর মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক/অনলাইন প্রশ্ন উত্তর,বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

ইতিহাসের প্রশ্ন উত্তর মার্ক - ৫ ইতিহাস মেনু ❝ অ ❞

প্রশ্নঃ ১. অমৃতসরের সন্ধি ১৮০৯ টীকা লেখ?
প্রশ্নঃ ২. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি
প্রশ্নঃ ৩. অবশিল্পায়ন কাকে বলে ও তার ফলাফল লেখ?
প্রশ্নঃ ৪. আর্য সমস্যা কি?
প্রশ্নঃ ৫. অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলতে কী বোঝো?
প্রশ্নঃ ৬. অর্থশাস্ত্র টীকা লেখ?
প্রশ্নঃ ৭. অশোকের ধম্ম বলতে কী বোঝো?
প্রশ্নঃ ৮. অস্ত্র আইন ১৮৭৮?
প্রশ্নঃ ৯. আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ?
প্রশ্নঃ ১০. আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে মধ্য-এশিয়া তত্ত্ব/ ইউরােপীয় তত্ত্ব’ কী?
প্রশ্নঃ ১১. অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ?
প্রশ্নঃ ১২. আটলান্টিক চার্টার বা আটলান্টিক সনদ?
প্রশ্নঃ ১৩. আফ্রিকার দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের পটভূমি আলোচনা করো?
প্রশ্নঃ ১৪. আফ্রিকার জনগণের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করো?
প্রশ্নঃ ১৫. অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে টীকা লেখ?
প্রশ্নঃ ১৬. আরবের সিন্ধু জয় এর কারণ ও ফলাফল লেখ?
প্রশ্নঃ ১৭. আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার গুলির বিবরণ দাও?
প্রশ্নঃ ১৮. আকবরের রাজপুত নীতি আলোচনা করো?
প্রশ্নঃ ১৯. আকবরের রাজসভার বিবরণ দাও?
প্রশ্নঃ ২০. আবুল ফজল কি জন্য খ্যাত টীকা লেখো?
প্রশ্নঃ ২১. আলিগড় আন্দোলন বলতে কি বোঝায় এর গুরুত্ব লেখ?
প্রশ্নঃ ২২. অমোঘবর্ষ কে ছিলেন?
প্রশ্নঃ ২৩. অভিজাত বিদ্রোহের গুরুত্ব লেখ?
প্রশ্নঃ ২৪. আঁতাত কোর্দিয়াল টীকা লেখো?
প্রশ্নঃ ২৫. অষ্টপ্রধান কী?
প্রশ্নঃ ২৬.আই. এন. এর গুরুত্ব চারটি আলােচনা করো?
প্রশ্নঃ ২৭. অন্ধকূপ হত্যা টীকা লেখ?

প্রশ্নঃ ১. অমৃতসরের সন্ধি ১৮০৯ টীকা লেখ?
✏ অখিল শিখ সাম্রাজ্য স্থাপনের আদর্শ নিয়ে রণজিৎ সিংহ শতদ্রু নদীর পূর্ব তীরের শিখ মিসল গুলি জয়ের চেষ্টা শুরু করেন। এতে মিসল গুলির সর্দাররা ভীত হয়ে পাতিয়ালার সর্দার সাহেব সিংহের নেতৃত্বে ইংরেজ দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু সেই সময়ে ফরাসি আক্রমণের সম্ভাবনা থাকায় ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টো রণজিৎতের বিরােধিতার সাহস করেনি। লর্ড মিন্টো রণজিৎতের সঙ্গে আলােচনার জন্য চার্লস মেটকাফকে লাহােরে রণজিতের দরবারে পাঠান। আলােচনার পর রণজিৎ সিংহ ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে অমৃতসরের সন্ধি’ (১৮০৯ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হয়।

ロ অমৃতসরের সন্ধির শর্ত : (i) শতদ্রু নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত রণজিৎ সিংহের রাজ্যসীমা নির্দিষ্ট হয়। (ii) শতদ্রুশতদ্রু পূর্ব তীরের শিখ মিসল গুলি ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করলে সেখানে ইংরেজ সৈন্য মােতায়েন করা হয়। (iii) স্থির হয় উভয়পক্ষ স্থায়ী মৈত্রী বজায় রাখবে।

অমৃতসরের সন্ধি ইংরেজদের কূটনৈতিক সাফল্য এবং রণজিৎ সিংহের চরম ব্যর্থতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। এর ফলে রণজিৎ সিংহের অখিল শিখ সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন চিরতরে বিনষ্ট হয়; ইংরেজরা বিনা যুদ্ধে শতদ্রু ও যমুনা নদীর মধ্যবর্তী শিখ রাজ্যগুলির ওপর আধিপত্য স্থাপনে সক্ষম হয়। অমৃতসরের চুক্তি ছিল শিখ সামরিক জাতীয়তাবাদের বিয়ােগান্তক পরিণতি। ড. নরেন্দ্রকৃষ সিংহ বলেছেন—“এই চুক্তিতে
ইংরেজ ছিল অশ্বারােহী, আর রণজিৎ সিংহ ছিলেন অশ্ব।”

প্রশ্নঃ ২. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি?
 অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিরতে শর্ত : (i) বলা হয় যে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাজ্যগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব কোম্পানি বহন করবে (ii) চুক্তিবদ্ধ রাজ্যগুলি নিজেদের অর্থে ইংরেজ সেনা মােতায়েন করবে এবং সেই সেনাবাহিনীর প্রধান হবেন একজন ইংরেজ সেনাপতি (iii) কোম্পানির অনুমতি ছাড়া চুক্তি বদ্ধ রাজ্য, অন্য কোনাে রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন বা যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারবে না (iv) প্রতিটি মিত্র রাজ্যে একজন করে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট নিযুক্ত থাকবেন।

ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের লক্ষ্যে লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি প্রয়ােগ করেন। এই মিত্ৰতা নীতিতে প্রথম সম্মতি জ্ঞাপন করেন হায়দ্রাবাদের নিজাম ; তারপর একে একে অযযাধ্যা, তাঞ্জোর, সুরাট, পুনা প্রভৃতি রাজ্য এই নীতিতে আবদ্ধ হয়। অধীনতামূলক মিত্রতা ব্যবস্থা ছিল—ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্য বিস্তারের একটি সুচতুর পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার ফাঁদে দেশীয় রাজ্যগুলিকে জড়িয়ে ইংরেজ তার সাম্রাজ্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত করে। মিত্রতাবদ্ধ রাজ্যগুলি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যাপারে ইংরেজের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়। এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্যের খরচে সেই রাজ্যে ইংরেজ বাহিনী মােতায়েন রেখে একদিকে কোম্পানি প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করে, অপরদিকে ওই রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। শেষের দিকে মিত্ৰতাবদ্ধ রাজ্যের দেশীয় সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়ার ফলে সেই বাহিনীতে কর্মরত বহু সৈনিক বেকার হয়ে পড়ে।

প্রশ্নঃ ৩. অবশিল্পায়ন কাকে বলে ও তার ফলাফল লেখ?
✏ অবশিল্পায়নের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ থাকলেও মােটামুটিভাবে বলা যায়—অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটিশের অবাধ বাণিজ্য ও অসম শিল্পনীতির জন্য ভারতের চিরাচরিত ও ঐহিত্যশালী কুটিরশিল্পের যে ধ্বংসসাধন ঘটে তা ‘অবশিল্পায়ন’ নামে পরিচিত।

ロ অবশিল্পায়নের ফলাফল : (i) বাংলা তথা ভারতের অর্থনীতির ওপর অবশিল্পায়ন অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলে। কোম্পানির বিমাতৃসুলভ নীতির ফলে বাংলার ঐতিহ্যশালী তাঁতশিল্পের নাভিশ্বাস ওঠে এবং এই বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ মানুষ চরম দুর্দশার মুখােমুখি হয়। (ii) অবশিল্পায়নের ফলে ভারতে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। শুধু বাংলা দেশেই ১০ লক্ষ লােক জীবিকাচ্যুত হয়। (iii) সুরাট, আমেদাবাদ, পুনা, বেলারী, আর্কট, মাদুরা প্রভৃতি বস্ত্রশিল্পকেন্দ্রের তাঁতশিল্পীরা চরম দুর্দশার মুখােমুখি হয়। হাতের কাজ ছেড়ে অনেকেই কৃষিকাজে ফিরে আসতে শুরু করে। এর ফলে কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণভাবে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে পড়ে। (iv) বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের একটা বড়াে অংশ, যেমন রঞ্জক, সুতা কাটুনি ইত্যাদি পেশার লােকেরা কোনাে কাজ না পেয়ে অনাহারে মারা যায়। (v) অবশিল্পায়নের ফলে কুটিরশিল্পের ধ্বংস সম্পূর্ণ হয়। কুটির শিল্পের জায়গায় গড়ে ওঠে যন্ত্রনির্ভর কলকারখানা।

প্রশ্নঃ ৪. আর্য সমস্যা কি?
✏ আর্য একটি ভাষা না জাতি তা নিয়ে ইতিহাসে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তাকে আর্য সমস্যা’ বলা হয়।
জাতিগত অর্থে  “আর্য’ এই শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে, যথাসজ্জন, শ্রেষ্ঠ, গুণবান, পূজ্য, অভিজাত, মহান, মান্য, সভার্ন্ত  ইত্যাদি। ঋগবেদের অভিধান রচয়িতা ষাস্ক বলেছেন যে আর্য শব্দের অর্থ হল আর্যের ঈশ্বর বা প্রভু পুত্র। প্রাচীন পারসিকরাও আর্য কথাটি জাতিবাচক অর্থে ব্যবহার করত। পারসিক সম্রাট প্রথম দারায়ুস তাঁর একটি শিলালিপিতে নিজেকে আর্য বংশােদ্ভূত প্রধান আর্য’ বলে দাবি করেছেন। 'আর্য’ শব্দটিকে জাতিবাচক অর্থে প্রয়ােগ। করে হিটলার ও তার নাৎসি দল নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছিল। ভাষাগত অর্থে ইউরােপীয় পণ্ডিত স্যার উইলিয়াম জোন্স, ম্যাক্সমুলার প্রমুখের মতে ‘আর্য’ হল আদি ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষার নাম। গ্রিক, লাতিন, সংস্কৃত, পারসিক, জার্মান, গথিক,ইত্যাদি আর্যভাষার অন্তর্গত। এই ভাষাগুলির যে-কোনাে একটিতে যাঁরা কথা বলতেন তাঁরাই আর্য ও. জেমেরেনি, ফিলিপ্পো সসেটি প্রমুখ পণ্ডিত ভাষাগত অর্থে 'আর্য’ শব্দটি ব্যবহারের তত্ত্বকেই সমর্থন করেন। জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলারের মতে—“আর্য বলতে বৈজ্ঞানিকভাবে ভাষাকেই বােঝায়, কখনােই জাতিকে নয়” “Aryan, in scientific language, is utterly inapplicable to race."

প্রশ্নঃ ৫. অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলতে কী বোঝো?
✏ দুঃখের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য বুদ্ধদেব যে আটটি মার্গ বা পথ অনুসরণের কথা বলেছেন সেগুলি অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত। বুদ্ধদেব বলেছে,দুঃখের প্রধান কারণ হল মানুষের আসক্তি,
আর এই আসক্তি যতদিন থাকে ততদিন দুঃখভােগও অনিবার্য।

ロ অষ্টাঙ্গিক মার্গ:- অষ্টাঙ্গিক মার্গগুলি হল - (i) সৎবাক্য (ii) সৎকর্ম (iii) সৎজীবিকা (iv) সৎচেষ্টা (v) সৎচেতনা (vi) সৎসংকল্প (vii) সৎদৃষ্টি (viii) সৎচিন্তা

(i) সৎবাক্য : সৎবাক্য বলতে বুদ্ধদেব পরিমিত কথা বলার কথা বলেছেন। (ii) সৎকর্ম : সৎকর্ম বলতে এমন কর্ম বােঝানাে হয়েছে যার দ্বারা অন্যের উপকার বা সমাজের উপকার হয়। (iii) সৎজীবিকা : মদ বা মাংসের ব্যাবসা বুদ্ধের মতে সমাজের পক্ষে হানিকর। (iv) সৎচেষ্টা : অন্যের প্রতি সভাব বজায় রেখে নিজের উন্নতির চেষ্টা করা উচিত। (v) সৎচেতনা : দেহ ও মনে পবিত্র থাকার ইচ্ছা রাখা উচিত। (vi) সৎসংকল্প : অন্যের ক্ষতি না করে নিজের উন্নতির সংকল্প গ্রহণ। (vii) সৎদৃষ্টি : সত্য, প্রেম ও অহিংসার সঙ্গে সবকিছুকে দেখা; এর প্রকৃত অর্থ হল চারটি আর্যমতের যথার্থ জ্ঞান অর্জন। (viii) সৎচিন্তা : মন থেকে কুচিন্তাকে দূর করে সুচিন্তাকে গ্রহণ করা, সদিচ্ছার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে হবে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের বন্ধন থেকে মনের মুক্তির জন্য সর্বদা চিন্তা করতে হবে। আমাদের দেহ কয়েকটি অপবিত্র ও নশ্বর পদার্থের সমন্বয়ে তৈরি, তাই তা সতত ইন্দ্রিয়সুখের ফাঁদে আবদ্ধ হতে চায়; অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলনের মাধ্যমে এই ইন্দ্রিয়বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নির্বাণ লাভ সম্ভব।

প্রশ্নঃ ৬. অর্থশাস্ত্র টীকা লেখ?
✏ অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা নিয়ে মতভেদ থাকলেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী কৌটিল্য বা চাণক্যকেই (আসল নাম বিয়ুগুপ্ত) অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা বলা হয়। অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও বহু ঐতিহাসিক মনে করেন অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি খ্রিস্টীয় ১ম থেকে ৪র্থ শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে কৌটিল্য লিখেছেন—'পৃথিব্যা লাভপালনােপায়ঃ শাস্ত্রমর্থশাস্ত্রমিতি।' অর্থাৎ
যে শাস্ত্রে পৃথিবী ভূমি ও সম্পদর লাভ ও পালনের উপায় রয়েছে তা হল অর্থশাস্ত্র।

অর্থশাস্ত্র মােট ১৫টি অধিকরণে বিভক্ত; প্রতিটি অধিকরণ আবার কিছু প্রকরণে বিভক্ত। এই গ্রন্থে মােট প্রকরণ ১৮০টি, যাতে সূত্র ও ভাষ্যের আকারে রয়েছে ৬০০টি শ্লোক। অর্থশাস্ত্রের মূল কথা হল, রাষ্ট্রনীতিতে কোনাে ধরনের নৈতিকতার স্থান নেই। অর্থশাস্ত্রে আলােচিত বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- (i) মন্ত্রীদের শিক্ষার যােগ্যতা ও রাজার নৈতিক কর্তব্য, (ii) দেওয়ানি ও ফৌজদারি নিয়মকানুন,
(iii) রাজ্যের ছটি অঙ্গের বিবরণ, (iv) রাজার ছ'টি নীতি, (v) যুদ্ধজয়ের কৌশল এবং সামরিক অভিযান, (vi) জনসমষ্টির সাতটি শ্রেণির বিভাজন,(viii) অর্থশাস্ত্রের সামগ্রিক পরিকল্পনা,(viii)বিজিত দেশগুলিতে জনপ্রিয়তা অর্জনের উপায়, (ix) নগর ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলির শাসনপ্রণালী, (x) বণিকবৃত্তির পরিচালনা, (xi) রাজকোশে অর্থাগম পদ্ধতি ও রাজকর্মচারীদের বেতন প্রদান, (xii) রাজার অযােগ্যতা ও তার পরিণাম ইত্যাদি। অর্থশাস্ত্রের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতা লক্ষণীয়, এই গ্রন্থটিতে কোনাে পরস্পরবিরােধী বক্তব্য নেই এবং গ্রন্থটিতে রাজনীতি ও অর্থনীতির আলােচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি রয়েছে।

প্রশ্নঃ ৭. অশোকের ধম্ম বলতে কী বোঝো?
✏  হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাবধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত 'ধম্ম' ছিল সম্রাট অশােকের নিজস্ব উদ্ভাবন, যা অশােক সর্বপ্রথম মাস্কিলিপিতে ব্যবহার করেন। প্রাচীন পালি ও সংস্কৃত সাহিত্যে 'ধম্ম’ শব্দটির নানান অর্থ পাওয়া যায়, যথা— নৈতিক বিচারে 'ধম্ম' হল কিছু সুনির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক আচরণবিধি; এবং দার্শনিক বিচারে ধম্ম হল বুদ্ধদেবস্বীকৃত পার্থিব অস্তিত্বের বিভিন্ন উপাদান। অশােক তাঁর ধম্মের প্রবর্তন ঘটিয়ে মানুষের ব্যক্তি
ও সমাজজীবন, দুই-ই পরিশুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কারণ অশােক বিশ্বাস করতেন, মানুষের ব্যক্তি কেন্দ্রিক পারিবারিক জীবন উন্নত হলে, সমাজজীবনও উন্নত হবে।

ব্যক্তিজীবনের পরিশুদ্ধির জন্য অশােকের ‘ধম্মে’– 
  1. দয়া
  2. দান
  3. সত্য
  4. শুচি
  5. ভদ্রতা
  6. সৎকাজ 
  7. সংযম
  8. কৃতজ্ঞতা
এই আটটি গুণ অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া, (i) প্ৰাণীহত্যা থেকে বিরত থাকা, (ii)  প্রাণীর ক্ষতি না করা, (iii) বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, (iv) বয়ােজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, (v) গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, (vi) ব্রাক্ষ্মণ, শ্ৰমণ, আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার,(vii)স্ব ল্প ব্যয় ও (viii) স্বল্প সঞয়—এই আটটি কর্তব্যকর্ম পালনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সমাজজীবনে সংহতি ও ঐক্য রক্ষায় অশােক পরধর্মসহিষ্ণুতার অনুশীলনের ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। 'আর্যসত্য’, ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ, ‘নির্বাণ ‘বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন’—বৌদ্ধধর্মের এই মূলনীতিগুলির কোনােটিরই উল্লেখ
অশােকের ধম্মে নেই। এটি ছিল নৈতিক ও সামাজিক আচরণবিধির সমন্বয়, যাতে প্রাণীজগতের প্রতি করুণা প্রদর্শনের নীতিও যুক্ত ছিল। ড. ভাণ্ডারকর অশােক প্রচারিত 'ধম্ম’কে লৌকিক বৌদ্ধধর্ম বললেও ইতিহাসবিদ রামশরণ শর্মা মনে করেন, 'অশােকের ধম্ম’ কোনাে সংকীর্ণ ধর্ম ছিল না, সামাজিক ব্যবস্থার
সুরক্ষা ছিল তাঁর ধম্ম প্রচারের লক্ষ্য।”

প্রশ্নঃ ৮. অস্ত্র আইন ১৮৭৮?
✏ ভারতে আগত ব্রিটিশ গভর্নর-জেনারেলদের মধ্যে অন্যতম নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন লর্ড লিটন। ভারতবাসীর প্রতিবাদ করার ক্ষমতাকে হরণ করার লক্ষ্যে তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে অস্ত্র আইন (Arms Act, 1878) জারি করেন। এই আইন প্রবর্তনের পেছনে লর্ড লিটনের যে উদ্দেশ্য ছিল তা হল ইউরােপীয়দের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও সুরক্ষিত করা; এবং ভবিষ্যতে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মতাে ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার ব্যবস্থা করা।

 অস্ত্র আইনের নিয়মাবলি :- (i) এই আইনে বলা হয় যে কোনাে ভারতীয় বা অ-শ্বেতকায় ব্যক্তি সরকারের অনুমতি ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলাচল করতে কিংবা বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র মজুত রাখতে পারবে না; (ii) অস্ত্র আইন শুধুমাত্র ভারতীয়দের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে, শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিরা এই আইনের আওতার বাইরে থাকবেন। এই আইনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত ভারতবাসী তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যো-পাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা অস্ত্র আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সমাবেশের আয়ােজন করে। কল-কাতার টাউন হলে কৃষ্ণ মােহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এই প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।লিটন এই বৈষম্য-মূলক আইন জারি করে জাতিগত সংকীর্ণতারই পরিচয় দেন। এই আইন ভারতীয়দের মনে প্রবল ক্ষোভ ও ঘৃণার সঞ্চার করে।

প্রশ্নঃ ৯. আমেদাবাদ সত্যাগ্রহ?
✏ গান্ধিজির রাজনৈতিক আন্দোলনের দ্বিতীয় কেন্দ্র ছিল গুজরাতের আমেদাবাদ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় শ্রমিকরা আর্থিক সংকটে পড়ে। আমেদাবাদের সুতাকলের শ্রমিকরা শতকরা ৫০ ভাগ মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছিল, কিন্তু মালিকরা শতকরা ২০ ভাগের বেশি মজুরি বৃদ্ধি করতে রাজি ছিল না। গান্ধিজি আমেদাবাদে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানাের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শ্রমিকদের হয়ে মিল মালিকদের কাছে মজুরিবৃদ্ধির দাবি জানালেও তা ব্যর্থ হয়। অবশেষে গান্ধিজির নির্দেশে আমেদাবাদে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। শ্রমিকদের দাবির সমর্থনে
গান্ধিজি অনশন শুরু করেন।

আমেদাবাদের সুতাকল শ্রমিকদের আন্দোলন কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ (i) এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে শ্রমিকশ্রেণির সুখ-দুঃখের সঙ্গে গান্ধিজির ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ঘটে; (ii) এই আন্দোলনের ফলে শহরাঞ্চলে গান্ধিজির নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে ; (iii) রাজনৈতিক আন্দোলনের অস্ত্র হিসেবে অনশনের গুরুত্ব বােঝা যায়। অতঃপর একাধিক ক্ষেত্রে গান্ধিজি এই অস্ত্র প্রয়ােগ করে সাফল্য পান ; (iv) এই আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে গান্ধিজি শ্রমিকশ্রেণির পাশাপাশি মালিকপক্ষেরও আসা
অর্জন করেছিলেন। গান্ধিজির অনশনের চতুর্থ দিনের মাথায় মালিকপক্ষ শ্রমিকদের শতকরা ৩৫ ভাগ মজুরি বাড়াতে রাজি হন।

প্রশ্নঃ ১০. আর্যদের আদি বাসভূমি সম্পর্কে মধ্য-এশিয়া তত্ত্ব/ ইউরােপীয় তত্ত্ব’ কী?
ロ মধ্য-এশিয়া এশিয়া তত্ত্ব :- জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার মনে করেন যে, আর্যদের আদি নিবাস ছিল মধ্য-এশিয়া। পরবর্তী সময়ে আর্যদের একটি শাখা কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ পথ ধরে, এশিয়া মাইনরের মধ্যে দিয়ে গ্রিসের দিকে অগ্রসর হয়। অন্য একটি শাখা পশ্চিমের পথ ধরে ভারতে উপস্থিত হয়। জার্মান পণ্ডিত ব্রান্ডেনস্টাইনও ম্যাক্সমুলারের বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। এ. এল. ব্যাসামের মতে, পশ্চিমে পােল্যান্ড থেকে পূর্বে মধ্য-এশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ তৃণভূমি অঞ্চলেই আর্যদের বাস ছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২,০০০ থেকে ১,৫০০ অব্দের মধ্যে কোনাে এক সময় আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে ও বসতি স্থাপন করে। কিন্তু ড. ত্রিবেদী, গঙ্গানাথ ঝা প্রমুখ পণ্ডিতগণ ভারতবর্ষকে আর্যদের আদিবাসভূমি বলে চিহ্নিত করেছেন।

ロ ইউরােপীয় তত্ত্ব :- স্যার জন মার্শাল, ব্র্যান্ডেনস্টাইন, জ্যাকব, বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখ মনে করেন আর্যরা ভারতের আদি অধিবাসী নয়। এঁরা মনে করেন, আর্যরা ইউরােপ থেকে ভারতে এসে নতুন বসতি স্থাপন করে ও সভ্যতা বিস্তার করে। এঁরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে আর্যদের অভিবাসন তত্ত্ব প্রমাণ করেছেন। এঁদের যুক্তি হল ব্রান্ডেনস্টাইনের মতে, “ইন্দো-ইউরােপীয়দের আদি বাসভূমি ছিল উরাল পর্বতের দক্ষিণে রাশিয়ার কিরঘিজ স্তেপ বা তৃণভূমি।” ইউরােপে গ্রিক, লাতিন, জার্মান প্রভৃতি আর্যভাষার যেরূপ ঘনসন্নিবেশ দেখা যায়, ভারতে তা দেখা যায় না। যেহেতু ইউরােপে আর্যভাষাগােষ্ঠীর সংখ্যা বেশি, তাই পণ্ডিতদের ধারণা ইউরােপই আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল। ঋগবেদে উল্লিখিত হরিযূপীয়ার যুদ্ধ’ থেকে পণ্ডিতদের অনুমান এই যুদ্ধ আর্য এবং হরপ্পাবাসীর মধ্যে সংঘটিত হয়। এর থেকে প্রমাণিত হয়, আর্যরা ছিল বহিরাগত আক্রমণকারী।

ভারতবর্ষই যদি আর্যদের আদি বাসভূমি হয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম সারাদেশকে আর্য-সংস্কৃতি ভুক্ত করার চেষ্টা করত। কিন্তু দেখা যায়, দক্ষিণ ভারতে অনার্য ভাষা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল। ড.
আর. সি. মজুমদারের মতে—এই ঘটনাই প্রমাণ করে ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসভূমি ছিল না। বৈদিক সাহিত্যে বাঘের উল্লেখ নেই এবং হরিণকে মৃগহস্তিন’বলা হয়েছে। আর্যরা ভারতীয় হলে বাঘ বা হরিণ সম্পর্কে অজ্ঞতা দেখাতেন না। এডওয়ার্ড আনিক ২,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ পামির অঞ্চলে চলে আসে এবং সেখান থেকে তারা ২ ভাগে ভাগ হয়ে ইরানে এবং ভারতে প্রবেশ করে।

আদিযুগে আর্যরা ইউরোপে বাস করলেও ইউরোপের ঠিক কোন স্থানে তাদের বাসভূমি ছিল, এই নিয়ে বিতর্ক আছে। ভাষাতাত্ত্বিক ব্রান্ডেনস্টাইন-এর মতে ইন্দো-ইউরােপীয় ভাষা ব্যবহারকারী জনগােষ্ঠীর আদি বসতি ছিল কিরঘিজ তৃণভূমি (রাশিয়া) অঞ্চলে। এই কিরঘিজ তৃণভূমি অল থেকেই ইন্দো- ইউরােপীয় ভাষাগোষ্ঠী দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম দলটি চলে যায় এশিয়া মাইনর হয়ে ইউরােপের দিকে, দ্বিতীয় দলটি চলে যায় পশ্চিম দিকে ইরানে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর দ্বিতীয় দলটি পুনরায় দু দলে ভাগ হয়ে এর প্রথম অংশটি ইরান থেকে আফগানিস্তান হয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে, আর অবশিষ্ট অংশ 'ইরানেই থেকে যায়। এই মতটিই বর্তমানে অধিকাংশ পণ্ডিত ইতিহাসবিদের কাছে গ্রহণযোগ্য।

প্রশ্নঃ ১১. অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ?
✏ অসহযােগ আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। গান্ধিজি কর্তৃক ঘােষিত, এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতি শেষপর্যন্ত সফল হয়নি। তাই সুভাষচন্দ্র বসু 'দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল' গ্রন্থে বলেছেন “এক বছরের মধ্যে স্বরাজ আনার প্রতিশ্রুতি শুধুমাত্র অবিজ্ঞচিতই নয়, তা ছিল শিশুসুলভ কল্পনামাত্র।”

ロ ব্যর্থতার কারণ :- গান্ধিজির একক নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন শুরু ও শেষ হয়। যখন আন্দোলন চরম সীমায় উপনীত, তখন গান্ধিজি কর্তৃক আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেশবাসীকে আশাহত করে এবং আন্দোলনের অকাল সমাধি ঘটায়। বড়ােলাট লর্ড রিডিং-এর নির্দেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী যে তীব্র দমননীতির আশ্রয় নেয়, তার জন্যই অসহযােগ আন্দোলন তেমন দানা বাঁধতে পারেনি। এর ওপর ব্রিটিশ গান্ধিজি-সহ শীর্ষস্থানীয় জাতীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন দিশাহীন হয়ে পড়ে।ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি ও অটুট সংঘশক্তির অভাব শেষপর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলনকে ব্যর্থতায়
পর্যবসিত করে। এ প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহরু বলেছেন—“আন্দোলনকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার জন্য যে জনশক্তির প্রয়ােজন ছিল বা ব্রিটিশবিরােধী রােষকে কাজে লাগানাের জন্য যে সংঘশক্তির দরকার ছিল তা সে সময়ে পাওয়া যায়নি।”

ভারতে খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে অসহযােগ আন্দোলনের মিলন ঘটানাের সিদ্ধান্ত গান্ধিজি তথা
জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে এক চরম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কেননা কামাল পাশা তুরস্কে ক্ষমতালাভ করে খলিফাপদ তুলে দিলে ভারতে খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে খিলাফৎ আন্দোলনের সূত্রে যেসব মুসলমান অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন, তারাও দূরে সরে গেলে এই আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রশ্নঃ ১২. আটলান্টিক চার্টার বা আটলান্টিক সনদ?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল নিউফাউন্ডল্যান্ডের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ‘প্রিন্স অব ওয়েস’ নামক জাহাজে মিলিত হয়ে আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর করেন (১৯৪১ খ্রি.)। চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য উভয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসমান জাহাজে মিলিত হন বলে এই চুক্তির নাম হয় ‘আটলান্টিক সনদ’ বা ‘আটলান্টিক চার্টার। জাতিসংঘ বা লিগ অব নেশন্‌সের ব্যর্থতার কারণে বিশ্ববাসী পুনরায় আর একটি বিশ্বযুদ্ধের মুখােমুখি হয়। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মতাে দুই শক্তিশালী দেশ বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য এই সনদ স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে পুনরায় এক শক্তিশালী বিশ্বসংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেন।

ロ সনদের শর্ত :- আটলান্টিক সনদে মােট আটটি নীতি ঘােষণার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জাতিপুঞ্জের বীজ বপন করা হয়। এই নীতিগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চারটি নীতি হল— 
  1. সাম্রাজ্যবিস্তার রােধ : ভবিষ্যতে আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিশ্বের কোনাে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবিস্তার নীতি গ্রহণ করবে না! 
  2. ভৌগােলিক সীমানা: কোনাে রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই রাষ্ট্রের জনমতকে মানা হবে। 
  3. সরকার গঠনের অধিকার: পরাধীন জাতিগুলি স্বাধীন সরকার গঠন করতে পারবে।
  4. নিরস্ত্রীকরণ: বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করে, বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্বশান্তি ও বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কিত ঘােষণাপত্র ছিল আটলান্টিক সনদ। আটলান্টিক সনদ প্রকৃতিগত দিক থেকে কোন যুক্তি নয় এটি হলো বিশ্বের বৃহৎ শক্তিধর দুই দেশের কিছু উঁচু আদর্শের ঘোষণা।

ロ আটলান্টিক চর্টিারের গুরুত্ব :- সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (U.N.O.) গড়ে তােলার পেছনে আটলান্টিক চার্টারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। জাতিপুঞ্জের সনদের বিভিন্ন ধারায় আটলান্টিক চার্টারের ধারাগুলির প্রভাব স্পষ্ট। সুস্থ, সুন্দর মানবজাতি গড়ে তােলার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে আটলান্টিক চার্টার নবযুগের
সম্ভাবনা সূচিত করে। কিন্তু অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মধ্য এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সংঘাত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি বিশ্বশান্তিকে বিঘ্নিত করেছে। আটলান্টিক চার্টারে প্রত্যেকটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও ভারত-সহ এশিয়া, আফ্রিকার অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এই নীতি প্রযুক্ত হয়নি। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রকে সমান অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবক্ষেত্রে অনুন্নত দেশগুলিকে প্রয়ােজনমতাে অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি। এই কারণে সমগ্র বিশ্ব উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত এই তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তবে পিছিয়ে-পড়া দেশগুলির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটানাের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। সর্বোপরি একথা অনস্বীকার্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এখনও পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা যায়নি।

প্রশ্নঃ ১৩. আফ্রিকার দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদ উদ্ভবের পটভূমি আলোচনা করো?
 উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আফ্রিকার বেশিরভাগ অঞলে ইউরােপীয় উপনিবেশ স্থাপিত হয়। বিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই মূলত শােষিত, নিপীড়িত আফ্রিকাবাসীর মনে জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটতে শুরু করে। সামাজিক পরিবর্তন ও বিশ্বরাজনীতির রূপান্তর আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের পটভূমি প্রস্তুত করে দেয়। দীর্ঘকাল ইউরােপীয় উপনিবেশ হিসেবে থাকার ফলে আফ্রিকায় আধুনিক শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসার ঘটে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিগণ জাতিগত স্বাতন্ত্র ও মর্যাদার জন্য দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেন। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসীদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরােপীয় শাসকদের বৈষম্য ও অমর্যাদা কর আচরণ আফ্রিকানদের ক্ষুদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম প্রভৃতি ঔপনিবেশিক দেশ দুর্বল হয়ে পড়লে আফ্রিকাবাসীর স্বাধীনতার দাবি জোরদার হয় এবং আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নতুন জোয়ার আসে।

প্রশ্নঃ ১৪. আফ্রিকার জনগণের মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করো?
✏ ঊনবিংশ শতকের গােড়ার দিকেও আফ্রিকা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশরূপে পরিচিত ছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আফ্রিকার প্রায় নয়-দশমাংশ অঞ্চলে ইউরােপের উপনিবেশ স্থাপিত হয়ে যায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পাের্তুগাল, জামনি, ইতালি-সহ বহু ইউরােপীয় রাষ্ট্র আফ্রিকার নানা অঞ্চল দখল করে শাসন ও শােষণ শুরু করে দেয়। আফ্রিকার এই পরাধীন দেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আফ্রিকার উনচল্লিশটি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে।



  • কঙ্গো:-  আফ্রিকার খরস্রোতা কণা নদীর অববাহিকা অঞ্চলের নাম কঙ্গো। হাতির দাঁত, সােনার খনি, মুল্যবান কাঠ ইত্যাদিতে কঙ্গো সমৃদ্ধ।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পর কঙ্গোবাসী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তােলে। কঙ্গোর জাতীয় নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা দেশের স্বাধীনতার দাবি তােলেন। সাম্যবাদী সােভিয়েত রাশিয়া, স্বাধীন ভারতবর্ষ  প্রভৃতি দেশ কঙ্গোর দাবি সমর্থন করে। অবশেষে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুন কঙ্গো স্বাধীনতা লাভ করে।
  • কেনিয়া :- ব্রিটেন অধিকৃত (১৮৮৬ খ্রি.) পূর্ব আফ্রিকাকে ভেঙে কেনিয়া, উগান্ডা ও জাঞ্জিবার রাজ্য গঠিত হয়। কেনিয়ার আদি অধিবাসীদের জমি কেড়ে নিয়ে শ্বেতাঙ্গদের খামার গড়ে ওঠে। হ্যারি ঠাকু-এর নেতৃত্বে কেনিয়ার জনগণ প্রতিবাদে সােচ্চার হলে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে জোমাে কেনিয়াট্টার নেতৃত্বে কেনীয় জাতীয়তাবাদী দল গঠিত হলে জাতীয় আন্দোলনে গতি আসে।পাশের দশকে শ্বেতাঙ্গ-বিরােধী মাও-মাও আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কেনিয়াট্টার নেতৃত্বে পঞ্চাশের দশকে শ্বেতাঙ্গ-বিরােধী মাও-মাও আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কেনিয়াট্টার নেতৃত্বে কেনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
  • উগান্ডা :- উগান্ডার জাতীয় জাগরণের নেতা ছিলেন মাইকেল ওবােটো। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস গঠন করে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন। ওই বছরেই উগান্ডার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়।
  • রোডেসিয়া :- আফ্রিকায় আর-একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল রােডেসিয়া ও নিয়াসাল্যান্ড। রােডেসিয়া উত্তর ও দক্ষিণ—এই দু-ভাগে বিভক্ত ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকাবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উত্তর ও দক্ষিণ মিলিয়ে রােডেসিয়া যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হয়।
  • অ্যাঙ্গোলা ও মােজাম্বিক :- আফ্রিকার দক্ষিণ অংশের পশ্চিম উপকূলে অ্যাঙ্গোলায় এবং পূর্ব উপকূলের মােজাম্বিকে পাের্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে অ্যাঙ্গোলায় বিদ্রোহ ঘটে। মােজাম্বিকবাসীও গেরিলা আক্রমণ করতে থাকে। শেষপর্যন্ত পের্তুগালের সামরিক শাসক স্পিনােলা ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যাঙ্গোলার স্বাধীনতা মেনে নেন। ওই বছরে মােজাম্বিকও স্বাধীনতা লাভ করে।
  • নাইজেরিয়া ও ঘানা :- উনবিংশ শতকের আটের দশকে নাইজেরিয়া ও গােল্ডকোস্টে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়। নাইজেরীয় জাতীয়তাবাদের উদ্যোগতা ছিলেন ড. আজিকুইয়ী। গােল্ডকোস্টে নকুমা জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। গােল্ডকোস্ট ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ও নাইজেরিয়া ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করে। গােল্ডকোস্টের নতুন নামকরণ হয় ঘানা।।
  • মরক্কো:- উত্তর আফ্রিকার মরক্কোয়, ফ্রান্স ও স্পেনের উপনিবেশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মরক্কোর সুলতান ফ্রান্সের কাছে স্বাধীনতার দাবি তােলেন (১৯৫০ খ্রি.)। মরক্কোর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলিও এই দাবিকে সমর্থন জানায় এবং সেখানে গণ- আন্দোলন শুরু করে। ফরাসি সরকার কঠোর দমনপীড়ন দ্বারা মরক্কোবাসীর আন্দোলন ব্যর্থ করতে চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত ফ্রান্স নতিস্বীকার করে এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ এপ্রিল মরক্কোর স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। ফরাসি ও স্পেনীয় অঞ্চল মিলিত হয়ে স্বাধীন মরক্কো রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। 
  • আলজিরিয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আলজিরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। যুদ্ধাবসানের পর ফ্রান্স আলজিরিয়াতে একটি উদার সংবিধান প্রবর্তন করে। নির্বাচনে ফ্রান্স-বিরােধীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়। ফ্রান্স এতে শঙ্কিত ও ক্ষুদ্ধ হয়ে নির্বাচন বাতিল করে দেয়। ক্রমে আলজিরিয়াবাসীর আন্দোলন ব্যাপক ও শক্তিশালী হয়। শেষপর্যন্ত, দ্য গল ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ফ্রান্স আলজিরিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেয় (১৯৬২ খ্রি.)। আলজিরিয়ার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চরিত্র সম্পর্কে রেনাল্ড সেগ্যাল বলেছিলেন—“এটি আবেদন থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে সংগ্রাম, সংগ্রাম থেকে যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং এর উদ্দেশ্য সংস্কার থেকে বিপ্লবে পরিবর্তিত হয়েছিল।” কালক্রমে আফ্রিকার অন্য উপনিবেশগুলিও স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। আফ্রিকার নবজাগরণ ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে নতুন রূপদান করেছিল। সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামে আফ্রিকা মহাদেশে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তারই ফলশ্রুতি হল প্যান-আফ্রিকান আন্দোলন (Pan-Africanism)।

প্রশ্নঃ ১৫. অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে টীকা লেখ?
✏ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন প্রখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত তাঁর উদ্যোগে তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের বজ্রযােগিনী গ্রামের এক রাজবংশে (অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাল্যনাম আদিনাথ) চন্দ্রগর্ভ জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে ওদন্তপুরী বিহারের আচার্য শীলভদ্রের কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তাঁর নতুন নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি লাভ করে দীপঙ্কর প্রথমে ব্রহ্মদেশ এবং পরে সুবর্ণদ্বীপে বেশ কিছুদিন থাকার পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য সিংহলে যান।

 সিংহলে বৌদ্ধ ধর্মপ্রচার শেষ করে পাল রাজা মহিপালের সময় তিনি বিক্রমশীলা বিহারে আসেন এবং
রাজা নয়পাল তাঁকে আচার্যপদে নিয়ােগ করেন। নয়পালের আমলেই তিনি তিব্বতে গমন করেন। তিব্বতে থাকাকালীন দীপঙ্কর মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রচার চালান এবং মােট ২০০টি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে অন্যতম হল ব্রজযান সাধন’, ‘বােধীপথ প্রদীপ’, ‘ পিণ্ডাৰ্থ-প্রদীপ, প্রজ্ঞাপারমিতা’ ও কুঞ্জুর। তিনি গেলুক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে
লাসার কাছে লােহাঙ-এ দেহরক্ষা করেন।

প্রশ্নঃ ১৬. আরবের সিন্ধু জয় এর কারণ ও ফলাফল লেখ?
✏ আরবরা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সিন্ধুদেশ জয় করে। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কাহিনি জানা যায় আবু- বকর-কুফি অনূদিত চাচনামা’, মির মহম্মদ-মাসুদ রচিত ‘তারিখ-ই-
সিন্ধ , জনৈক লেখকের অল-তারি’ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে।)

ロ আরবদের সিন্ধুবিজয়ের কারণ :-
  1. সিংহলের রাজা স্বয়ং ইসলামধর্ম গ্রহণ করার পর সিন্ধু-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলামধর্মের প্রসারের লক্ষ্যে আরবরা সিন্ধুবিজয়ে অগ্রসর হয়। ড. এ. এল. শ্রীবাস্তব বলেছেন—“ইসলামধর্মের বিস্তারের উদ্দেশ্যেই আরবরা সিন্ধুদেশ আক্রমণ করে।”
  2. ইউরােপের বাজারে ভারতীয় মশলা, রেশম, অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর চাহিদা দেখে আরব বণিকরা সিন্ধুবিজয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চেয়েছিল।
  3. হজরত মহম্মদের মৃত্যুর কুড়ি বছরের মধ্যেই আরবরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরােপের বিস্তীর্ণ অঞলে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। সাম্রাজ্যবিস্তারের অঙ্গ হিসেবেই আরবরা সিন্ধুদেশ আক্রমণ ও অধিকার করে
  4. সিংহলের রাজা, ইরাকের শাসনকর্তা অল হজ্জাজের উদ্দেশ্যে কিছু উপঢৌকনসহ কয়েকটি জাহাজ পাঠালে, সেগুলি দেবল (করাচি) বন্দরের কাছে, সিন্ধুর জলদস্যুরা লুণ্ঠন করে। এই লুণ্ঠনের ঘটনা শুনে ইরাকের শাসনকর্তা সিন্ধুরাজ দাহিরকে এক চরমপত্র পাঠিয়ে ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। কিন্তু সিন্ধুরাজ দাহির লুণ্ঠনের দায় অস্বীকার করে ক্ষতিপূরণের দাবি নস্যাৎ করলে অল হজ্জাজ সিন্ধুদেশে অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন।
ロ আরবদের সিন্ধুজয়ের ফলাফল :- আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের শাসন কর্তা অল- ইজ্জাজের সেনাপতি মহম্মদ-বিন কাশিম রাওর-এর যুদ্ধে সিন্ধুরাজ দাহিরকে পরাজিত ও নিহত করে সিন্ধু জয় করেন।
  1. সিন্ধুবিজয়ের পর সুদীর্ঘ তিনশত বছর ধরে আরবরা সিন্ধুপ্রদেশে শাসন করলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের ইতিহাসে আরবদের প্রভাব ছিল নগণ্য। ড. এ. এল. শ্রীবাস্তবের মতে—“রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে আরবদের সিন্ধুবিজয় ইসলামের প্রসার এবং ভারতের দিক থেকে ছিল একটি গুরুত্ববিহীন ঘটনা।”
  2. সিন্ধুজয়ের অনেক আগে থেকেই আরবদের সঙ্গে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তা সিন্ধু বিজয়ের পর আরও সুদৃঢ় হয়। সিন্ধুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রী ইউরােপের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করে আরব বণিকরা প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে ওঠে।
  3. সিন্ধুবিজয়ের পর ভারতের সঙ্গে সংযােগের ফলে আরবীয় দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ভেষজ -বিদ্যা, রসায়ন, সংগীত ও চিত্রকলা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়। আরবদের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি ইউরােপের বুকে ছড়িয়ে পড়ে।
  4. সিন্ধুবিজয়ের মধ্যে দিয়েই ভারতের মাটিতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বলা যায়। সিন্ধি বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞান ইসলামিক ধর্মীয় জ্ঞানকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
প্রশ্নঃ ১৭. আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার গুলির বিবরণ দাও?
✏ সুলতানি শাসনব্যবস্থায় শাসক আলাউদ্দিন খলজি সর্বপ্রথম অর্থনীতির আমূল সংস্কার সাধন করেন। তিনি রাজস্ব নীতি ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ নীতি—এই দুইয়ের ওপর ভিত্তি করে আর্থিক সংস্কারে হাত দেন। ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব ও কে. এ. নিজামি বলেছেন—“সুলতানি যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রশাসনিক কৃতিত্ব ছিল আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।”

আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক সংস্কার

ロ আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কার :- আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল কয়েকটি উদ্দেশ্য হল—(i) অভিজাতরা অতিরিক্ত অর্থ পেয়ে যাতে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে না পারে সেদিকে লক্ষ রেখে আলাউদ্দিন বিবিধ করের বােঝা চাপিয়ে অভিজাতদের কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ করায়ত্ত করে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে নির্মুল করেন।(ii) বিশাল সৈন্যবাহিনী স্বল্প বেতনে যাতে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে সে কারণে আলাউদ্দিন। নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসমূহের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেন।(iii) সুলতানের বিশাল সাম্রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনা, প্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন, বিদ্রোহ দমন ইত্যাদির জন্য অর্থের দরকার ছিল। এই অর্থের সুষ্ঠু জোগান দেওয়ার লক্ষ্যে আলাউদ্দিন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।(iv) দিনের পর দিন বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রাস্ফীতি যাতে বাড়তে না পারে তার জন্য সুলতান উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। এই মুদ্রাস্ফীতি রােধ করার জন্য আলাউদ্দিন কর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তােলেন।

আলাউদ্দিন খলজির অর্থনৈতিক সংস্কারের দুটি রূপ যা -  (a) রাজস্ব ব্যবস্থা : এই ব্যাবস্থার মধ্যে  ছিলো 
(i) খাস জমির পরিমাণ বৃদ্ধি (ii) রাজস্বদপ্তর গঠন (iii) অসৎ রাজস্ব কর্মচারীদের শাস্তিদান (iv) বিভিন্ন কর আদায়। (v) জমি জরিপ (vi) রাষ্টের আয় বৃদ্ধি (vii) কেন্দ্রীয় শাসনের সুদৃঢ়ীকরণ  (b) বাজারদর নিয়ন্ত্রণ : (i) কৃষি পণ্য বাজার মান্ডি (ii) বস্ত্র ও নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার  সেরা -ই -আদল (iii) সাধারণ বাজার (iv) দাস ও পশু বাজার ইত্যাদি। আলাউদ্দিন বাজারের পণ্যের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেন। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর নাম নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করেন, লােহার বাটখারার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেন। শাহনাই-মান্ডিকে বাজার-পরিদর্শক নিযুক্ত করেন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রত্যেকটি পরিবারকে রেশন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অর্থনীতিকে সুসংহত করবার জন্য আলাউদ্দিন খলজি যে অভিনব পদক্ষেপ নেন সে প্রসঙ্গে ড. বি.পি. সাকসেনা বলেছেন, “সুলতানি যুগের প্রশাসনিক কৃতিত্বগুলির মধ্যে আলাউদ্দিনের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।”

প্রশ্নঃ ১৮. আকবরের রাজপুত নীতি আলোচনা করো?
ロ সম্রাট আকবর উপলব্ধি করেছিলেন রাজপুতদের সহযােগিতা ছাড়া মােগল সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করা সম্ভব নয়। তাই তিনি সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাজপুতদের আনুগত্য লাভ করে মুঘল শাসনকে ভারতীয় চরিত্র দিতে চান।

ロ আকবরের রাজপুত নীতি :- (i) আকবর রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি নিজে অম্বররাজ বিহারীমলের কন্যাকে এবং নিজপুত্রের সঙ্গে ভগবান দাসের কন্যার বিবাহ দেন। ধীরে ধীরে মারওয়াড়, বিকানির, বুন্দি, রণথম্বাের প্রভৃতি রাজ্যগুলিও আকবরের বশ্যতা মেনে নেয়। (ii) মেবারের শিশােদীয় বংশের রানা উদয়সিংহ এবং তাঁর পুত্র রানা প্রতাপ আকবরের বশ্যতা স্বীকারে রাজি ছিলেন না। মেবারের রাজধানী চিতাের দখলের জন্য
১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে উদয়সিংহের সঙ্গে এবং ১৫৭৬ সালে রানা প্রতাপের সঙ্গে আকবরের হলদিঘাটের যুদ্ধ হয়। (iii) মােগল সেনাবাহিনী ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার জন্য আকবর রাজপুতদের সামরিক ও
অসামরিক উচ্চপদে নিয়ােগ করেন। (iv) রাজপুতদের মিত্রতা লাভের উদ্দেশ্যে আকবর জিজিয়া ও তীর্থকর সম্পূর্ণ বাতিল করার পাশাপাশি রাজপুতদের নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যােগ দিতেন।

আকবরের রাজপুত নীতির ফলশ্রুতি হিসেবে রণনিপুণ রাজপুত জাতি মােগল সাম্রাজ্যের দিকে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে মােগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়। সর্বোপরি
আকবরের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জাতীয় নীতি রাজপুত নীতির মাধ্যমে সূচিত হয়।

প্রশ্নঃ ১৯. আকবরের রাজসভার বিবরণ দাও?
 পারসিক রাজসভা বা দরবারের ঐতিহ্য অনুসারে মােগল শাসকরাও ভারতে দরবারি আদবকায়দা প্রচলন করেন। আকবরের রাজসভাও সেদিক থেকে ব্যতিক্রমী ছিল না। তাঁর রাজসভা একদিকে ছিল রাজকীয় ক্ষমতা, মর্যাদা ও সমৃদ্ধির প্রতিবিম্ব অন্যদিকে ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

আকবরের রাজসভা : - (i) প্রত্যহ তিনবার আকবরের দরবার বসত এবং সম্রাট সকালে প্রাসাদের পূর্বদিকের বারান্দায় এসে সমবেত দর্শকদের ‘ঝরােখা দর্শন’ দিতেন। (ii) ঝরােখা দর্শনের পর সম্রাট
দেওয়ান-ই-আম-এ উপস্থিত হতেন। সেখানে তিনি যুবরাজ, মনসবদার, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, পর্যটক ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সাথে সভা করতেন। (iii) সম্রাটের শেষ সভা বসত দেওয়ান-ই- খাস-এ, যেখানে তিনি উচ্চপদস্থ কর্মীদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় বিষয়ে গােপন শলাপরামর্শ করতেন। এই আভিজাত্যপূর্ণ দরবারে যােগদানকারীদের বিশেষ পােশাক পরিধান করতে হত।(iv) আকবর রাজদরবারে কয়েকটি উৎসবের প্রচলন করেন। পারস্যের অনুকরণে প্রবর্তিত হয় 'নওরােজ’ বা নববর্ষের উৎসব। এ ছাড়া রাখিবন্ধন, দশেরা, হােলি, বসন্তপঞ্চমী প্রভৃতি উৎসবকে তিনি জাতীয় উৎসবে পরিণত করেন। (v) বিক্রমাদিত্যের সভার মতাে আকবরের রাজসভা, আবুল ফজল, বিহারীমল, টোডরমল, আবদুর রহিম, রসিক বীরবল, সংগীতজ্ঞ তানসেন, হাকিম হুমায়ুন, মােল্লা-দোপিয়াজি প্রমুখ নয়জন পণ্ডিত অলংকৃত করেন।

প্রশ্নঃ ২০. আবুল ফজল কি জন্য খ্যাত টীকা লেখো?
✏ আবুল ফজল ছিলেন মুঘল যুগের শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও বিদগ্ধ পন্ডিত। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের মিএ সচিব। এবং শেখ মোবারক এর দ্বিতীয় পুত্র ও কবি ফৈজির ছোট ভাই। তিনি১৫৫১ খ্রিস্টাব্দে ১৪ এ জানুয়ারি আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন শেখ মুবারক সে যুগের একজন বিশিষ্ট পারসিক পন্ডিত এবং উদার প্রকৃতির মানুষ। বাল্যকাল থেকেই আবুল ফজলের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। ছোট থেকেই তিনি ইসলাম শাস্ত্রে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ৩ খন্ড রচিত আবুল ফজলের আকবরনামা গ্রন্থটি কে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এইচ. বিভারিচ। প্রথম খন্ড রয়েছে তৈমুর লং এর সময় থেকে হুমায়ুনের সময় পর্যন্ত মুঘল রাজপরিবারের ইতিহাস। দ্বিতীয় খন্ড রয়েছে আকবরের রাজত্বকাল এর সমস্ত কথা।

আবুল ফজল ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আকবরের সভায় প্রবেশ করেন এবং আকবর তার পাণ্ডিত্য ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে থাকে কয়েক বছর পর পাঁচ হাজার মনসবদার পদে উন্নীত করেন। তিনি যে শুধু পাণ্ডিত্য ছিলেন তা নয় যুদ্ধবিদ্যায় তিনি যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেন এবং দাক্ষিণাত্য অভিযানে তিনি কর্তৃত্ব প্রদর্শন করেন। যুবরাজ সেলিম আবুল ফজলকে তার ব্যক্তিগত শত্রু বলে মনে করতেন। সেলিম তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে হন এবং সেলিমের প্ররোচনায় সম্রাটের প্রিয় আবুল ফজলের মৃত্যু ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে হয়। সেলিমের আদেশে বীরসিংহ বুন্দেলা আবুল ফজল কে হত্যা করেন। এর ফলে আবুল ফজলের মৃত্যু গোটা মুঘল রাজপরিবারের অন্ধকারের বাতাবরণ সৃষ্টি করে। আবুল ফজলের রচিত গ্রন্থ টির মধ্যে আইন-ই-আকবরী, আকবর-নামা, ইন্সা-ই-আবুল ফজল ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখ  -যোগ্য। এইসব গ্রন্থগুলিতে আবুল ফজলের জ্ঞান গভীরতার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় । এজন্য তিনি আলামি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

প্রশ্নঃ ২১. আলিগড় আন্দোলন বলতে কি বোঝায় এর গুরুত্ব লেখ?
✏ ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে মুসলিম সমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষাগ্রহণ না করে শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এই অবস্থায় মুসলিম সমাজের ত্রাণকর্তা ছিলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-৯৮ খ্রি.)। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে সায়েন্টিফিক সােসাইটি এবং ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড় অ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই আলিগড় কলেজকে কেন্দ্র করে মুসলমান সমাজে যে সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল, তাকে আলিগড় আন্দোলন বলা হয়।

আলিগড় আন্দোলনের গুরুত্ব :- (i)  এই আন্দোলনের দুটি লক্ষ্য ছিল— ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। ধর্মীয় দিক থেকে সৈয়দ আহমদ ছিলেন উদারপন্থী ও যুক্তিবাদী। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাধারা রক্ষণশীল ও ঘাের সাম্রাজ্যবাদী থিওডাের বেকের ধ্যানধারণার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। (ii) স্বাধীন ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের লক্ষ্য কী হবে, তার কোনাে যথাযথ ব্যাখ্যা সৈয়দ আহমদ দিতে পারেননি। তিনি কেবল ব্রিটিশদের অনুগ্রহ লাভ ও তাদের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্য প্রদর্শনের কথাই বলেছিলেন।
(iii) সৈয়দ আহমদ রাজনৈতিক আন্দোলনকে ‘বিপজ্জনক আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক তগ্রগতির প্রাথমিক শর্ত হিসেবে শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। এর ফলস্বরূপ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় তার সময়ে মুসলমানদের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়।

সৈয়দ আহমদ খান আধুনিক বিজ্ঞান ও চিন্তাধারার সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে ছিলেন। সম সাময়িক বিজ্ঞানচর্চা ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কোরানের ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হন তিনি।
সকল প্রকার সংকীর্ণতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মুসলমানদের সতর্ক করে দেন সৈয়দ আহমদ। মুসলমান দের সামাজিক উন্নয়নের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি আলীগড় আন্দোলন কে এক অন্যমাত্রা প্রদান করেন ।

প্রশ্নঃ ২২. অমোঘবর্ষ কে ছিলেন?
✏ তৃতীয় গােবিন্দের পর অমােঘবর্ষ (৮১৪ -৮৭৭ খ্রিঃ) রাষ্ট্রকূট রাজ্য শাসন করেন। তিনি পূর্ব চালুক্য রাজ বিজয়াদিত্যের বিদ্রোহ দমন করে রাষ্ট্রকুট সিংহাসনে তার অধিকার বজায় রাখেন। তবে মহীশূরের গঙ্গ বংশের বিরুদ্ধে একাদি ক্রমে ২০ বছর যুদ্ধ করেও তিনি বিফল হন। অবশেষে মহীশূর বা গঙ্গাবদি তিনি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। গুজরাটে তার সামন্ত রাজার বিদ্রোহ এবং ভােজ প্রতিহারের আক্রমণ প্রতিহত করে গুজরাটে তিনি তার পৈত্রিক অধিকার বজায় রাখেন। হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সঞ্জন তাম্রলিপি থেকে দেখা যায়, তিনি হিন্দু দেবী মহালক্ষ্মীর প্রতি ভক্তিমান ছিলেন। তার রাজ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দিলে তিনি দেবী মহালক্ষ্মীর সামনে তার একটি আঙুল কেটে দিয়ে দেবীর করুণা ভিক্ষা করেন। তিনি রাজধানী মান্যখেটার শােভা বাড়ান।

প্রশ্নঃ ২৩. অভিজাত বিদ্রোহের গুরুত্ব লেখ?
✏ ফরাসি রাজা ষােড়শ লুই ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে দেশের সমস্ত প্রাদেশিক পার্লামেন্ট মুলতুবি করেন এবং সকল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কর আদায়ের উদ্যোগ নিলে ক্ষুদ্ধ হয়ে সুবিধাভােগী অভিজাত শ্রেণি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।

অভিজাত বিদ্রোহের গুরুত্ব : (i) অভিজাত বিদ্রোহ থেকেই ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়। বিদ্রোহের প্রথম পর্বে অভিজাতদের সহযােদ্ধা ছিল বুর্জোয়ারা। দ্বিতীয় পর্যায়ে বুর্জোয়ারা এবং শেষ পর্যায়ে কৃষকরা বিদ্রোহের নেতৃত্বের আসন দখল করে। (ii) রাজার বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহে শীঘ্রই যাজক ও বুর্জোয়ারা শামিল হয়। ফলে অভিজাত বিদ্রোহ কিছুকাল পরই প্রকৃত গণবিদ্রোহে
পরিণত হয়।(iii) অভিজাত বিদ্রোহের চাপে রাজা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন।
ফলে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের মর্যাদায় আঘাত লাগে। রাজার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।(iv) রাজা ছিলেন ফরাসি পুরাতনতন্ত্র ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের রক্ষক। অভিজাতরা রাজতন্ত্রকে দুর্বল করতে গিয়ে পুরাতনতন্ত্রকেই দুর্বল করে দেয়।

প্রশ্নঃ ২৪. আঁতাত কোর্দিয়াল টীকা লেখো?
✏ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে বিরােধ থাকলেও জার্মান প্রধানমন্ত্রী বিসমার্কের পদচ্যুতির (১৮৯০ খ্রি.)পর জার্মানি যে উগ্র সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে তাতে আতঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স নিজেদের নিরাপত্তার প্রয়ােজনে নিজেদের বিভিন্ন বিরােধ মিটিয়ে নেয় এবং ১৯০৪খ্রিস্টাব্দে (৮ এপ্রিল) ইঙ্গ-ফরাসি মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি আঁতাত কোর্দিয়াল’ (Entente Cordiale') নামে পরিচিত।

আঁতাত কোর্দিয়াল সন্ধির শর্তাবলি : - ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি দ্বারা স্থির হয় যে— [1] ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আলােচনার মাধ্যমে নিজেদের বিরােধ মিটিয়ে নেবে। [2] মিশরে ইংল্যান্ডের অধিকার ফ্রান্স মেনে নেবে। [3] মরক্কোয় ফ্রান্সের অধিকার ইংল্যান্ড মেনে নেবে। [4] ইংলিশ চ্যানেল ও উত্তর সাগরে ব্রিটিশ নৌবহর এবং ভূমধ্যসাগরে ফরাসি নৌবহর প্রতিষ্ঠা করে জার্মানির বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য বজায় রাখা হবে।

আঁতাত কোর্দিয়াল সন্ধির গুরুত্ব :- আতাঁত কোর্দিয়ালের প্রধান গুরুত্বগুলি ছিল— [1] এই চুক্তির দ্বারা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরােধের অবসান ঘটে। [2] এটি কোনাে সামরিক চুক্তি ছিল না। অর্থাৎ, কাউকে আক্রমণ করা এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল না। [3] এই চুক্তির দ্বারা জার্মানির বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স উভয়ের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্নঃ ২৫. অষ্টপ্রধান কী?
✏ ইতিহাসের গতানুগতিক ধারায় অষ্টপ্রধান-এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই অষ্টপ্রধান রাজকার্য
পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এঁরা বিশেষ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা যে কোন পরিস্থিতির মােকবিলা করত। শিবাজীর আমলে রাজার ক্ষমতা ছিল সার্বভৌম। তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার
জন্য (1) পেশােয়া, (2) অমাত্য, (3) ওয়াকেনভিস, (4) দবীর, (5) সামন্ত (6) সেনাপতি, (7) পন্ডিত
রাও, (৮) ন্যায়াধীশ প্রভৃতি। 

প্রশ্নঃ ২৬.  আই. এন. এর গুরুত্ব চারটি আলােচনা করো?
✏ আজাদ হিন্দ বাহিনীর সশস্ত্র সংগ্রাম আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও ভারতের মুক্তি সংগ্রামে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রভাব বা গুরুত্ব নেহাত কম ছিল না।(i) আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম প্রমাণ করেছিল যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র গান্ধীজি নির্দেশিত অহিংস আন্দোলনের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সশস্ত্র সংগ্রামের এক গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। বস্তুতপক্ষে, নেতাজীর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সশস্য সংগ্রাম ছিল জাতীয় বিপ্লববাদী ধারার সর্বোচ্চ পরিণতি। (ii) আজাদ হিন্দ বাহিনীর অমর কীর্তিকথা ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী মনােভাব গড়ে তুলেছিল। শীঘ্রই এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারতীয় নাবিকেরা ও বিমান সেনা বিদ্রোহের পথে ধাবিত হয়।(iii) সেনাবাহিনীর আনুগত্যের উপর ব্রিটিশ শাসন এতদিন নির্ভরশীল ছিল সেই প্রধানতম ভিত্তি এখন নড়বড়ে হয়ে পড়ল।
(iv) আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠন নেতাজীর সাংগঠনিক প্রতিভা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পরিচায়ক ছিল। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়গণ আজাদ হিন্দ ফৌজ ও সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত এই গৌরবময় প্রচেষ্টা অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে প্রতিভাত হয়েছিল।

প্রশ্নঃ ২৭. অন্ধকূপ হত্যা টীকা লেখ?
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন সিরাজ-উদদৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করলে কলকাতার গভর্নর ড্রেক এবং অধিকাংশ ইংরেজ পালিয়ে গেলেও দুর্গের সকল ইংরেজ পালাতে পারেনি, এরা সিরাজের ব্রিটিশ কর্মচারী হলওয়েল-এর বক্তব্য অনুযায়ী, নবাব সিরাজ-উদদৌলা ফোর্ট উইলিয়াম দখল করার পর
১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞি চওড়া একটি ঘরে সারা রাত ১৪৬ জনকে বন্দি করে রেখেছিলেন। সেই কক্ষের একটি ক্ষুদ্র জানালা ছিল। সেখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জন ইংরেজ মারা গিয়েছিলেন হলওয়েল বর্ণিত এই ঘটনা 'অন্ধকূপ হত্যা’ নামে পরিচিত।

বহু ইতিহাসবিদ অন্ধকূপ হত্যা ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে—
উইলিয়ামে শতাধিক ইংরেজ থাকার সম্ভাবনা ছিল না; ঘরের যে বিবরণ হলওয়েল দিয়েছেন সেখানে শতাধিক মানুষকে রাখা যেত না। তাই শ্ৰীমতী বেসান্ত বলেছেন, “জ্যামিতি প্রমাণ করেছে পাটিগণিতের অঙ্কটি ভুল।” (Geometry disproving arithmetic gave a lie to the story.) আসলে সিরাজের চরিত্রে
কলঙ্ক লেপনের জন্যই হলওয়েল এই অলীক কাহিনির অবতারণা করেছিলেন।নােয়েল বার্কার প্রমুখ গবেষকের মতে, অন্ধকূপের ঘটনা সত্যই ঘটেছিল, তবে মৃতের সংখ্যা কম ছিল। স্যার জে. এন.
সরকারের মতে, কলকাতায় তখন ১৪৬ জন ইংরেজ ছিল না, সম্ভবত ৬০/৭০ জন ছিল। তা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে নবাবের কোনাে হাত ছিল না, নবাবের কর্মচারীদের অসাবধানতার জন্য এই ঘটনা ঘটেছিল।
পরদিন সকালে নবাব এই দুর্ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন