B.A Sociology Notes 2nd Semester 2022 Pdf || Gour Banga University
❥ আরো পড়ুন ❥
❐ বি.এ সমাজবিদ্যা জেনারেল সেকেন্ড সেমিস্টার নোটস
❐ গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় নতুন সিলেবাস ও নতুন প্রশ্নরীতি অনুযায়ী নোটস
❐ বি.এ সমাজবিদ্যা জেনারেল
❐ মোট - ২২ টি কোশ্চেন প্র্যাকটিস সেট
❐ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর নোটস
প্রশ্নঃ ১ আত্মীয়তার সংজ্ঞা দাও। আত্মীয়তার ব্যবহারিক আচরণবিধির উপর একটি টীকা লেখ।
অথবা, আত্মীয়তার সংজ্ঞা দাও। উদাহরণসহ আত্মীয়তার ধরণগুলি আলোচনা করো।
অথবা, আত্মীয়তা প্রথা কি? আত্মীয়তার শ্রেণীবিভাগ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, আত্মীয়তা বা জ্ঞাতিত্ব সম্পৰ্ক বলতে কী বোঝ? বিভিন্ন ধরণের জ্ঞাতিত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে উপযুক্ত উদাহরণসহ আলোচনা করো।
❑ ভূমিকা : আত্মীয়তার বন্ধন একটি বিশ্বজনীন ধারণা, যা মনুষ্য সমাজকে একে অপরের সঙ্গে আত্মীয় তার বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে। সমাজকে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে বিরত রেখেছে। নারী ওপুরুষের সম্পর্কের বাঁধনের মধ্যে দিয়ে অর্থাৎ সমাজ স্বীকৃত নিয়মানুযায়ী নারী পুরুষের সহজাত চাহিদায় সৃষ্টি হয় নতুন প্রজন্মের। এক প্রজন্মের সঙ্গে আরেক প্রজন্মের বাঁধনের ক্ষেত্রে এই আত্মীয়তার সম্পর্কে ব্যবহৃত শব্দ আমরা ব্যবহার করি। অর্থাৎ পিতার সঙ্গে পুত্রের বাঁধন এইভাবে এক প্রজন্মের সঙ্গে আরেক প্রজন্মের বাঁধন রয়েছে। এক অজানা ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক সম্পর্কের বাঁধন। যে সকল সমাজে পুরুষ প্রাধান্য রয়েছে সেই ধরনের সমাজকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বলা হয়ে থাকে। আবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়ের দিকের সম্পর্ক অধিক প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
(ii) বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আত্মীয়তার সম্পর্ক (Affinal kinship): সাধারণত রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে ও বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে আত্মীয়তার বা জ্ঞাতি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে সম্পর্ক বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তাকে Affinal kinship বলা হয়। সাধারণত Consanguineous kinship রা একত্রে রক্তের বন্ধনে থাকে এবং একত্রে বসবাস করে। অনেক সময় রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্ক ও রক্তের সম্পর্কে আত্মীয়রা একই হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের পরিবারের লোকেরা বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আত্মীয়তার সম্পর্কে সম্পর্কিত থাকে। কেবলমাত্র ব্যতিক্রম দেখা যায় নায়ার সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। এই পরিবারে ভাই, বোন, বোনের ছেলে-মেয়ে, তাদের মা সকলে একত্রে বসবাস করে। স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বিবাহের পর মাত্র তিনদিন একত্রে থাকে তারপর একত্রে বসবাস করে না। এই ধরনের পরিবারকে non residential family বলা হয়।
অধিকাংশ সমাজেই আত্মীয়তার সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করা হয় রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে। উদাহরণ -
▻ স্বামী, ▻ স্ত্রী, == বিবাহ । — বংশধর । দুটি পৃথক পরিবারের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিবাহের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে Affinal relationship. পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি প্রভৃতি নিয়ে গড়ে ওঠে Consanguineous
kinship অর্থাৎ রক্তের সম্পর্ক।
প্রশ্নঃ ২ জাতির সংজ্ঞা দাও। জাতিব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
অথবা, জাতির সংজ্ঞা দাও। ভারতে জাতি গঠনের মূখ্য বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
❑ ভূমিকা : ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য হল জাতিভেদ প্রথা। ভারতীয় সমাজ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না। ভারতে প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে আর্যদের আগমনের সাথে সাথে ধারাবাহিক ভাবে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এই সুদীর্ঘকাল ধরে জাতিভেদ প্রথা ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি রাজনীতি এমন কি অর্থনীতির আদান প্রদানের প্রকৃতিকেও প্রভাবিত করেছে। এমনকি সাম্প্রতিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটেও ভারতীয় সমাজ এবংরাজনৈতিক কাঠামো জাতিভেদ প্রথায় বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিকতা করেছে।
জাতিভেদ প্রথা সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা শুরু হয় মূলতঃ ব্রিটিশরা এদেশে আসার পর থেকে। এই প্রসঙ্গে যাঁদের আলোচনা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন Nestield, Riseley, Senart, G.S. Ghura, Hutten, M.N. Shrinivas, S. C. Boss । এঁরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই সকল ব্যাখ্যা থেকে একটি বিষয় একমত হওয়া সম্ভব যে জাতিভেদ প্রথার উদ্ভব ঘটেছে আর্যসমাজের বর্ণভেদের সাথে প্রাক্ আর্য সমাজে পেশা ভিত্তিক বিন্যাসের সমন্বয়ের মধ্য
দিয়ে। Risclyc এর মতে ,"জাতিগোষ্ঠী হল এমন কতকগুলি পরিবার বা পরিবার সমূহের মিলিত দল যারা একটি নির্দিষ্ট ধরণের বৃত্তিমূলক সংগঠনের সাথে জড়িত একই বংশধারা এবং পৌরাণিক সাধারণ পূর্ব -পুরুষ থেকে উদ্ভূত বলে দাবী করে। একই ধরণের সাধারণ জীবন যাত্রা অনুসরণ করে এবং একটি একক সমজাতীয় সমষ্টি হিসাবে বসবাস করে।" E.A.H. Bulunt এর মতে জাতি হল এমন একটি আন্ত বিবাহকারী গোষ্ঠী সমূহ যারা একটি সাধারণ নাম বা পদবী বহন করে। উত্তরাধিকার সূত্রে নির্ধারিত বৃত্তি এবং বিধিনিষেধ মেনে চলে এবং সমজাতীয় সমষ্টি হিসাবে বসবাস করে।
❑ বৈশিষ্ট্য : উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে জাতিভেদ প্রথার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি পরিলক্ষিত হয়—
🅐 স্তরবিন্যাস। 🅑 বংশানুক্রমিক বৃত্তি। 🅒 অন্তঃ-বিবাহকারী সংগঠন। 🅓 সমপাংক্তেয়তা এবং 🅔 নিশ্চল ব্যবস্থা।
🅐 স্তরবিন্যাস। 🅑 বংশানুক্রমিক বৃত্তি। 🅒 অন্তঃ-বিবাহকারী সংগঠন। 🅓 সমপাংক্তেয়তা এবং 🅔 নিশ্চল ব্যবস্থা।
❑ বিভিন্ন স্তরগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক বৈষম্য : 🅐 অস্পৃশ্যতা। 🅑 পদবী দ্বারা জাতীর মর্যাদা নির্ধারিত। 🅒 ধর্ম এবং কর্মের দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত। 🅓 সার্বজনীন একটি ব্যবস্থা।
❶ বর্ণভিত্তিক স্তর বিন্যাস
❷ জাতি বা পেশাভিত্তিক স্তর বিন্যাস
❸ বিভিন্ন স্তরগুলির মধ্যে সামাজিক মেলামেশা ও দৈনন্দিন আচরণের ক্ষেত্রে স্তর বিন্যাস।
❍ জাতি বা পেশাভিত্তিক স্তর বিন্যাস : পবিত্রতা এবং অপবিত্রতার ভিত্তিতে বিভিন্ন পেশাধারী জাতিগুলির উঁচু নীচু অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। যেমন- অধ্যাপনা বৃত্তি পবিত্র বৃত্তি হিসাবে গণ্য হওয়ায় এই সব পেশাধারী জাতির স্থান উচুঁতে আবার চামড়া ছাড়ানো বা পাকানো, মদ তৈরী করা, শবদেহ
দাহ করা প্রভৃতি কাজ অপবিত্র বলে বিবেচিত হওয়ায় এই সব পেশাধারী জাতির স্থান নীচুতে। এছাড়াও পোশাকের পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যাভাস, বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার, পূজোপাঠ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে উচুঁ এবং নীচু জাতিগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট বৈষম্য এবং ভেদাভেদ পরিলক্ষিত হয়। এই সকল বিধি-নিষেধগুলি লঙ্ঘন করলে সমাজচ্যুত হওয়ারও ভয় থাকে।
❷ বংশানুক্রমিকতা : বংশানুক্রমিকতা জাতিপ্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। জাতির সদস্যপদ বংশানুক্রমিক ভাবে আরোপিত হয়ে থাকে। জাতি নির্ধরিত বা নিয়ন্ত্রিত হয় জন্মসূত্রে অর্থাৎ জাতি ব্যবস্থা জন্ম ভিত্তিক। ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হবে ব্রাহ্মণ, তেমনি আবার কর্মকার পরিবারে কোন শিশু ভূমিষ্ট হলে সেই শিশু হবে কর্মকার।
❸ আন্তর্বিবাহ : জাতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল আন্তর্বিবাহ বা endogamy, কোন একটি জাতির কোন একজন সদস্য ভিন্ন জাতির কোন সদস্যকে বিবাহ করে না। এই কারণে সকল ব্রাহ্মণ তনয়কে অবশ্যই কোন ব্রাহ্মণকন্যার পাণিগ্রহণ করতে হয়। তবে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে
স্বজাতির গণ্ডীই শেষ কথা নয়। বিবাহের ব্যাপারে স্বজাতির সীমানার মধ্যেই স-গোত্র, স-পিন্ড প্রভৃতি শাস্ত্রীয় বিধি নিষেধ মেনে চলতে হয়। অবশ্য আধুনিক সমাজে বিধি বিধানের কঠোরতা বড় একটা পরিলক্ষিত হয় না। তা ছাড়া সাম্প্রতিক কালের সমাজ ব্যবস্থার অনুলোম বিবাহ (hypergamy) ও প্রতিলোম বিবাহ (hypogamy) এর অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হতে দেখা যায় ৷
❹ সমপাংক্তেয়তা : জাতি প্রথার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সমপাংক্তেয়তা (commensality)। বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে কতকগুলি ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু বিধি ব্যবস্থা প্রচলিত থাকে। সাধারণত খাদ্যাখাদ্য এবং জলচল ও জল অচল প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই সমস্ত বিধি ব্যবস্থা বা নিষেধাজ্ঞা প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। এগুলিকেই বলে সমপাংক্তেয়তা। প্রতিটি জাতিই মনে করে যে তার নিজস্ব এই সমস্ত বিধি-নিষেধকে মেনে চলা অপরিহার্য। অন্যথায় জাতির শুদ্ধতা সংরক্ষণ সম্ভব হবে না। উচ্চবর্ণের মানুষ নিচু জাতির রান্না করা বা ছোঁয়া খাবার খাবে না। কারণ তা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে জাতিভ্রষ্ট বা পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই সমস্ত বিধি নিষেধের কঠোরতা বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত হয় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতির মধ্যে।
❺ জাতিমূলক পদবী : অনেক সময় পদবীর পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিভেদের বিষয়টি সু-স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বন্দোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের; সেন, সেনগুপ্ত, দাস, দাসগুপ্ত প্রভৃতি ব্যক্তিদের জাতি সূচক পদবীর কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। অনুরূপভাবে আবার বৃত্তি-সূচক পদবী পরিলক্ষিত হয়। এ রকম পদবীর দৃষ্টান্ত হিসাবে কর্মকার, বণিক, গোপ প্রভৃতি পদবীর কথা উল্লেখ করা আবশ্যক।
❻ অস্পৃশ্যতা : জাতিভেদ প্রথার সবচেয়ে অমানবিক বৈশিষ্ট্যটি হল অস্পৃশ্যতা ও ছোঁয়া ছুঁয়ির বিধি-নিষেধ। জাতিভেদ প্রথার উঁচু স্তরে রয়েছে ব্রাহ্মণ। তাদের পূজা আর্চায় নিযুক্ত থাকতে হয় বলে শুদ্ধা চারে চলতে হয়। এই কারণে ব্রাহ্মণ যে কোন জাতির হাত থেকে জল গ্রহণ করবে না। অস্পৃশ্য জাতি গুলির সাথে ছোঁয়া ছুঁয়ির প্রথম বিধি নিষেধ লক্ষ্য করা যায়। আক্ষরিক অর্থে এমনকি তাদের ছায়া মাড়ালে শুদ্ধ হতে হয়। অথবা প্রায়শ্চিত্য করতে হয়।
❼ ধর্ম এবং কর্মের : জাতিভেদ প্রথায় ধর্ম এবং কর্মের সমন্বয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বর্ণের জন্য যে নির্ধারিত দায় দায়িত্ব বা কর্ম অনুসরণ করতে বলা হয় তা পালন করাকেই স্বধর্ম বলে মনে করা হত। এবং এই স্বধর্ম পালনের মধ্যেই সুখলাভ করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা হয়। এই ভাবে জাতিভেদ প্রথায় কর্ম বিভাজনের মাধ্যমে একদিকে সমাজের প্রয়োজন অন্যদিকে আধ্যাত্মিক দার্শনিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল।
❽ সার্বজনীন : ভারতবর্ষে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ভারতবর্ষে সর্বত্র যে বিষয়ে সমজাতীয়তা লক্ষ্য করা যায় তা হল জাতি ধর্ম, বর্ণ নিরপেক্ষ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্য গ্রহণ করা হলেও এমনকি সরকারী প্রতিষ্ঠানেও জাতির পরিচয় আবশ্যক করা হয়েছে। সুতরাং একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা হিসাবে জাতিভেদ প্রথা সুদীর্ঘ কাল ধরে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে।
❑ উপসংহার : জাতিভেদ প্রথায় উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হলেও একদিকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং অন্যদিকে যুক্তিবাদী ধ্যান ধারণা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসারের ফলে সাম্প্রতিক কালে জাতিভেদ প্রথার বা বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণে জাতিভেদ প্রথার ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। তবে সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে জাতিভেদ প্রথা নতুন রূপে প্রসঙ্গিকতা অর্জন করেছে।
প্রশ্নঃ ৩ আত্মীয়তার সম্পর্কে ব্যবহৃত আচরণবিধি সম্পর্কে লেখ।
❑ ভূমিকা : সমাজ জীবনে আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি নিয়ন্ত্রিত প্রথা। মানব সমাজ ছাড়া অন্য কোন সমাজে এই প্রথার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয় না। সাধারণত সামাজিক জীবনে জ্ঞাতি বা কুটুম্ব বা আত্মীয়বোঝাতে স্বগোত্রীয় বা রক্তের সম্পর্ককে বোঝায়। আত্মীয় শব্দটির শব্দগত অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আত্মীয় বলতে তাদের বোঝায়, যাদের সাথে আত্মার বন্ধন সম্পর্ক বর্তমান।
❍ আত্মীয়তার সম্পর্ক : কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান এবং নৃতত্ত্বে আত্মীয়তার বা kinship এর ধারণাটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। র্যাডক্লিফ ব্রাউন এর মতে— “যখন আমরা জ্ঞাতি কুটুম্ব বা আত্মীয়তার গোষ্ঠীর কথা বলি, তখন এমন একটি ধারণা জাগে যে জ্ঞাতির সাথে আমরা কোন বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ । সুতরাং তার মতে পারস্পরিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য যে অসংখ্য রক্তের সম্পর্ক, বৈবাহিক সম্পর্ক সমাজে গড়ে ওঠে, তাকেই বলা হয় আত্মীয়তার সম্পর্ক।” Lowie-এর মতে রক্তের সম্পর্ক ও বংশ তালিকার যোগসূত্র ছাড়াও মানুষ কৃত্রিমভাবে জ্ঞাতি সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। তার মতে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের ফলে বিভিন্ন জনপদের মানুষ নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করার ফলে জ্ঞাতি এ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া সাংস্কৃতিক জীবনে স্বীয় কর্মক্ষেত্রে গড়ে উঠতে পারে কৃত্রিম জ্ঞাতি সম্পর্ক।
❍ আত্মীয়তার সম্পর্কে ব্যবহৃত আচরণবিধি : পৃথিবীর সব সমাজেই আত্মীয়তার আচরণবিধি (kingship usages) মূলত দুটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত । (i) পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কিত আচরণ বিধি।
(ii) আদব কায়দা সংক্রান্ত আচরণ বিধি।
(i) পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তব্য সম্পর্কিত আচরণ বিধিঃ এক্ষেত্রে দেখা যায় যে সংশ্লিষ্ট সমাজে বংশাবতারণ এবং উত্তরাধিকারের ধরণ অনুযায়ী পারস্পরিক অধিকার কর্তব্যের বিষয়টি নির্ধারিত হয়। যেমন— প্রতিটি সমাজেই পুত্র কন্যাকে লালন পালন এবং ভরণপোষণের কর্তব্য পিতা-মাতার উপর
বর্তায়। এই কারণে বৃদ্ধাবস্থায় পিতা মাতার ভরণপোষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ পুত্র কন্যার দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়। এছাড়া প্রতিটি সমাজই স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পর পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব পালন সমাজ স্বীকৃত আত্মীয়তার বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
কেবলমাত্র স্বামী স্ত্রী এবং পিতামাতার সাথে পুত্রকন্যার সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয় অন্যান্য আত্মীয় পরিজন দের প্রতি দায়িত্ব পালনের রীতিও আত্মীয়তার আচরণবিধির (kingship usages) অন্তর্গত। যেমন পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক সমাজেই মনে করা হয় যে পারিবারিক বিপদ আপদে সাহায্যের জন্য প্রথম আত্মীয় পরিজন দের কাছেই যাওয়া উচিত। এর ব্যতিক্রম সমাজের কাছে নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়। আত্মীয় পরিজনদেরও দায়িত্ব হল বিপদগ্রস্ত আত্মীয়কে সাহায্য করা।
(ii) আদব কায়দা সংক্রান্ত আচরণ বিধি : আদব কায়দা সংক্রান্ত আচরণবিধিকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা— (ক) সশ্রদ্ধ আচরণ বিধি (Rules of deference), (খ) পরিহার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার নীতি (Rules of avoidance) (গ) ঠাট্টা বা রসিকতার নীতি (Rules of joking)।
(ক) সশ্রদ্ধ আচরণ বিধি (Rules of deference) : আত্মীয়দের মধ্যে পদমর্যাদায় যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তাদের বিশেষ সম্মান প্রদর্শনের রীতি সব সমাজেই আত্মীয়তার আচরণবিধির অন্তর্গত। যেমন— ভারতীয় সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠদের পদধূলি গ্রহণ এবং তাদের সামনে ধূমপান না করা।
(খ) পরিহার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার নীতি (Rules of avoidance) : কিছু কিছু এড়িয়ে যাওয়ার নীতি লক্ষ্য করা করা যায়। যেমন— ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজে শ্বশুর এবং ভাসুরকে নববিবাহিত বধূ এড়িয়ে যাওয়ার রীতি। Murdock এর মতে অজাচার সম্পর্কে সামাজিক নিষেধ যেন লঙ্ঘিত না হয় তার জন্য কিছু কিছু আত্মীয়কে এড়িয়ে যাওয়ার নীতির প্রচলন ঘটেছে। অনেকেই অবশ্য এই মতকে সমর্থন করেন না।
(গ) ঠাট্টা বা রসিকতার নীতি (Rules of joking) : আত্মীয় কুটুম্বদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের মধ্যে রসিকতা করার নীতি প্রচলিত। যেমন— দেবর-বৌদির সম্পর্ক, ভগ্নীপতি-শ্যালিকার সম্পর্ক, দাদু দিদিমার সঙ্গে নাতি- নাতনির সম্পর্কের কথা বলা যায়। অবদমিত সত্য বাসনা সমাজ অনুমোদিত
পন্থায় চরিতার্থ করার জন্য এইরূপ রীতির প্রচলন ঘটেছে বলে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন। এছাড়াও আত্মীয়তার আচরণবিধির ক্ষেত্রে techonimy, avuncolate, anitate এবং couvade প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়।
এইরূপ প্রথায় একজন আত্মীয় নাম নিতে বাধা থাকে অন্য আত্মীয় সেই নাম ব্যবহার করে। যেমন— ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সমাজে স্ত্রী স্বামীর নাম উচ্চারণ করে না। কোন কোন সমাজে পিতা-মাতার তুলনায় মামার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ফলে মামার প্রতি পিতা-মাতার মতো দায় দায়িত্ব এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন— দক্ষিণ ভারতে নায়ার সমাজ। কোন কোন সমাজে বাবার বনের প্রতি বিশেষ আচরণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন— দক্ষিণ ভারতে টোড়া সমাজ। কোন কোন আদিবাসী সমাজে যেমন - খাসি এবং টোডা স্ত্রীরা যখন সন্তান পোষণ করে তখন স্বামীরাও কোন ভারী কাজ করে না। তারা স্ত্রীর মতোই কতকগুলি বিশেষ বিধিনিষেধ মেনে চলে। এই প্রথাকে বলা হয় couvade.
❑ আত্মীয়তার আচরণবিধির ভিত্তি (Bases of kinship usages) : Johnson এর মতে আত্মীয়তার আচরণবিধি কতখানি কার্যকরী হবে তা মূলত দুটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। যথা— (ক) বাস্থানের নৈকট্য এবং (খ) বিবাহের ধরণ।
(ক) বাসস্থানের নৈকট্য : বাসস্থানের নৈকট্য থাকলে যাতায়াত এবং মেলামেশার ফলে আচরণবিধির কঠোরতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এক্ষেত্রে আচরণবিধি না মানলে তিরস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(খ) বিবাহের ধরণ : অন্যদিকে দেখা যায় যে, বাঞ্ছনীয় বা আত্মীয় বিবাহের আচরণগুলি সাধারণ বিবাহের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন ধরণের।
উপসংহারঃ বর্তমানে আত্মীয়তা সম্পর্কের বিস্তৃতি ক্রমশ সঙ্কুচিত হওয়ায় ভৌগোলি সচলতা এবং সামাজিক সচলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথাগত আচরণবিধিগুলি সর্বদা অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। যেমন— মূল্যবোধ এবং মানসিকতা এবং বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে পরিহার করার নীতির
ক্ষেত্রে ব্যাপক পরির্তন পরিলক্ষিত হয়।
প্রশ্নঃ ৪ সামাজিক পরিবর্তন বলতে কি বোঝ? সামাজিক পরিবর্তনের উপাদানগুলি আলোচনা করো।
অথবা, সামাজিক পরিবর্তন কাকে বলে? সামাজিক পরিবর্তনের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো।
❑ ভূমিকা : সমাজের অস্তিত্বের সঙ্গে সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি সার্বজনীন ঘটনা। কেননা মানুষের মর্যাদাগত বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করেই সামাজিক স্তরবিন্যাস আহ্বান করে। সমাজজীবন স্তরবিন্যাসের অন্যতম কারণ হল বৈষম্য, বৈষম্যহীনতা সমাজ দেখা যায় না সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক স্তরবিন্যাস যেমন অপরিহার্য তেমনি সমাজ তত্ত্বের পর্যালোচনা এক্ষেত্রে অপরিহার্য রূপ লাভ করেছে।অধ্যাপক জিসবার্ট বলেন, সামাজিক স্তরবিন্যাস হল প্রাধান্য ও বশ্যতার সূত্রে পরস্পর সম্পর্কিত স্থায়ী গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ভিত্তিতে সমাজের স্তরবিভাগ। তিনি আরো বলেন স্তরবিন্যাসহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা নিছক কল্পনামাত্র। অধ্যাপক বটোমোর বলেন, মর্যাদা ও ক্ষমতার ভিত্তিতে বিভক্ত কতকগুলি শ্রেণী বা স্তরের উর্দ্ধাধ অবস্থিতিকে সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে। অধ্যপক ট্যালকট পারসানস্ এর মতে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চনীচ বিবেচনার ভিত্তিতে প্রভেদমূলক পদবিন্যাস সৃষ্টি করলে তাদের সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে। সামাজিক স্তরবিন্যাস এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতি, যার মধ্যে সম্পর্কের গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়।
❑ সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য : সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়- ❶ সামাজিক স্তরবিন্যাসের অস্তিত্বের সঙ্গে রয়েছে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক। এর ফলে মর্যাদাগত দিক থেকে উন্নততর স্তরে মানুষের উত্তরণের স্পৃহা আছে, যা সমাজ উন্নয়নে সহায়ক। ❷ সামাজিক অমান্যতার প্রকৃতি হতে পারে জন্মগত, পুরুষানুক্রমিক, আবার কখনও আরোপিত অথবা অর্জিত। ❸ স্তরবিন্যাস বলতে ঊর্ধ্বাধঃবিন্যাস বোঝায়। অর্থাৎ উচ্চ-নীচ পর্যায়ে বিভক্ত। মানব সমাজে শ্রেণীবিন্যাস ঊর্ধ্বাধঃ বা উল্লম্বী হতে পারে। আবার অনুভূমিকও হতে পারে। কে কোন স্তরের মানুষ তা সামাজিক মূল্যায়ন দ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে এই মূল্যবোধ সমাজ থেকে সমাজ পৃথক প্রকৃতির হয়। ❹ সমাজে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের মান মর্যাদার নির্ণয়ক হল স্তরবিন্যাস। মানব সমাজের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সমাজে এর অবস্থান চিরকালের মূলতঃ মানবিক প্রকৃতির ফলশ্রুতি। ❺ সমাজে স্তরবিন্যাস এমনভাবে অবস্থান করে থাকে যে ব্যক্তিবর্গের পক্ষে তা এড়িয়ে চলা সম্ভবপর হয় না। সামাজিক স্তরবিন্যাসের ফলে উঁচু নীচু বৈষম্য প্রায় সব সমাজেই লক্ষ্য করা যায়। কারণ এটি একটি সার্বজনীন ঘটনা। ❻ সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তির অন্তর্মুখী বা মনোভাবগত দিক আছে। এর উপলব্ধি অনেকটা অপরের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। তাই সামাজিক স্তরবিন্যাস সামাজিক মূল্য নিরূপণের নির্দেশকও বটে। ❼ বদ্ধ সমাজের তুলনায় উন্মুক্ত সমাজে স্তরবিন্যাস কিছুটা উন্মুক্ত। কিন্তু স্তরবিন্যাস পুরোপুরি মুক্ত সমাজের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
উপসংহার : আধুনিক সমাজে চরম অর্থনৈতিক অসম বন্টনের ফলে স্তরবিন্যাস ভিন্ন পথে পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে অসম প্রকৃতি আরো ঊর্ধ্বমুখী হয়। মূলত মানুষের প্রকৃতিতেই এই অসাম্য বিরাজমান, সমাজের উচিত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী স্থান নির্ণয় করা।
প্রশ্নঃ ৫ সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কিত তত্ত্বটি আলোচনা করো।
❑ ভূমিকা : সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি সার্বজনীন ও সুপ্রাচীন ব্যবস্থা রূপে পৃথিবীর সব সমাজেই লক্ষ্য করা গেলেও স্তরবিন্যাসের প্রকৃতিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে একাধিক মতবৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। সমাজতাত্ত্বিক চিন্তাধারার প্রথম পর্ব থেকেই Classical Sociologist গণও স্তরবিন্যাসের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করেন। প্লেটো সামাজিক স্তরবিন্যাসকে স্বাভাবিক এবং ন্যায় সম্মত ব্যবস্থা হিসেবে সমর্থন করেছিলেন। তিনি এমন এক সমাজের কল্পনা করেছিলেন।যেখানে ন্যায় বিচারের সাথে সাথে থাকবে স্থায়িত্ব এবং যোগ্যতম ব্যক্তির হাতে শাসনকার্য পরিচালনার ভার থাকবে।অ্যারিস্টটলও বুদ্ধি, শারীরিক উৎকর্ষতা, মেধা প্রভৃতির দিক থেকে যোগ্যতমের অধিকারকে সমর্থন করেছেন।
সেন্ট টমাস (Saint Tomas) এবং অগাস্টাইন (Augustine) ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে সামাজিক স্তরবিন্যাসকে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মেকিয়াভেলি যোগ্যতমের শাসনের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এমন এক মুক্ত সমাজের কথা বলেন যেখানে প্রত্যেকের সামনে সুযোগ সুবিধা উন্মুক্ত থাকবে, ফলে যোগ্যতমেরাই স্তরবিন্যাসের শীর্ষে অবস্থান করবে। আধুনিক কালে বেশ কিছু সমাজবিজ্ঞানী স্তরবিন্যাসকে কেবল অপরিহার্য বলে সমনে করেছেন তাই নয়, সমাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় বলেও অভিহিত করেছেন। এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—
❶ Talcott Parsons
❷ Kingsley Davis
❸ Melvin M.Tumin
❹ Michel Young
❺ Rosenfield
❶ Talcott Parsons : এর মতে প্রত্যেক সমাজেই উচিত, অনুচিত, ভালোমন্দ সাধারণ কতকগুলি মূল্যবোধ রয়েছে। এই মূল্যবোধ অনুযায়ী প্রত্যেক সমাজে কারো সামাজিক মর্যাদা উঁচুতে এবং কারো সামাজিক মর্যাদা নীচুতে পরিলক্ষিত হয়। যতদিন পর্যন্ত সমাজে গুরুত্বপূর্ণ, অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ থাকবে, ততদিন পর্যন্ত স্তরবিন্যাসও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করা যাবে। কেবল তাই নয়, এই ধরণের উঁচু নীচু বিশাল প্রয়োজনীয় এই কারণে যোগ্য দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তির দ্বারাই পূরণ করা সম্ভব হবে।
এছাড়া শিল্পভিত্তিক জটিল সমাজে বিশেষ চাহিদা মেটানোর বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা গোষ্ঠীগুলি পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সামাজিক ভারসাম্য এবং স্থিতিবস্থা বজায় থাকে। এইরূপ অবস্থায় leadership এবং othority এর ভূমিকা গ্রহণ করেন যারা এবং যারা তা পালন করে (follower) তাদের মধ্যে ক্ষমতা ও মর্যাদার বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। leadership pattern এর সাথে বৈধ ক্ষমতা যুক্ত হওয়ায় তা আরো সুদৃঢ় হয় । এইরূপ ব্যবস্থাকেই Talcott Parsons functional বলে মনে করেছেন। এই কারণে যার মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা নির্ভরশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়।
❷ Kingsley Davis : ১৯৪৫ সালে আমেরিকান Sociological Review পত্রিকায় 'Some Principal's of Stratification' প্রবন্ধে সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রয়োজনীয় ভূমিকার প্রতি আলোকপাত করেন।
🅐 তিনি দেখান যে প্রত্যেক সমাজেই দক্ষতার সাথে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। 🅑 এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা প্রয়োজন। 🅒 নিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। 🅓 প্রত্যেকটি দায়িত্ব পালন করতে হবে বিবেক, বুদ্ধি এবং দক্ষতার মাধ্যমে। Davis এবং Moore এর মতে সমাজে দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতা বিন্যাসের প্রকৃতিকে সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্তরবিন্যাস অপরিহার্য এবং প্রয়োজনীয়।
🅐 তিনি দেখান যে প্রত্যেক সমাজেই দক্ষতার সাথে কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। 🅑 এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা প্রয়োজন। 🅒 নিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। 🅓 প্রত্যেকটি দায়িত্ব পালন করতে হবে বিবেক, বুদ্ধি এবং দক্ষতার মাধ্যমে। Davis এবং Moore এর মতে সমাজে দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতা বিন্যাসের প্রকৃতিকে সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে স্তরবিন্যাস অপরিহার্য এবং প্রয়োজনীয়।
❸ Melvin M.Tumin : সমাজ জীবনে কাজের গুরুত্ব এবং প্রকৃতিভেদে সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে তারতম্য -কে নিতান্তই স্বাভাবিক বলে মনে করলেও Davis এবং Moore এই মতের সমালোচনা করেছেন। তবে তিনি কিছুটা ভিন্নভাবে সামাজিক স্তরন্যিাসের উপযোগিতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে বিশেষ বিশেষ ভূমিকা পালনের উপযোগী বৈশিষ্ট্যগুলি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলে সামাজিক স্তরন্যিাস লক্ষ্য করা যায়। এই
বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলতে তিনি বুদ্ধিবৃত্তি, সৌন্দর্য, সামর্থ্য, যোগ্যতা, দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ, কর্মকুশলতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার বৈষম্যের কারণে সকল ব্যক্তি সমান মেধা বিকাশের সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে। ফলে সমাজে সচল সৃজনীমূলক শক্তিকে প্রগতির স্বার্থে সমান ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয় না।
এছাড়াও পার্থিব এবং মানসিক অনুপ্রেরণা অর্থাৎ Reward সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অসমভাবে বন্টিত হওয়ায় সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণে সকলের সমান আগ্রহ থাকে না। Tumin এর মতে এমন কি মুক্ত সমাজও স্তরবিন্যাসের কারণে শিক্ষা এবং অন্যান্য অর্জিত মর্যাদা সমানভাবে ভোগ করা সম্ভব হয় না। সুতরাং এদিক থেকে তিনি স্তরবিন্যাসকে Disfunctional বলেও অভিহিত করেছেন। যেমন তাঁর মতে গণতান্ত্রিক সমাজে কেবলমাত্র ক্ষমতা এবং সুযোগ সুবিধার তারতম্যের কারণে অনেক অযোগ্য ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকে।
❹ Michel Young : তাঁর ‘Rise of Meritocracy' গ্রন্থে ভবিষ্যৎ ব্রিটেনের এমন এক সমাজের কল্পনা করেছেন, যেখানে সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিরা সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদ ব্যবহার করবে
সমর্থনকারী এবং অনুগত কর্মীদের মধ্যে পদ বন্টন করে। এক্ষেত্রে স্তরবিন্যাস সামাজিক প্রগতিকে বিশেষভাবে ব্যাহত হয়। কার্যনির্বাহী তত্ত্বে ধরে নেওয়া হয়েছে সামাজিক স্তরভেদ প্রায় প্রতিটি সমাজে একই রকম কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্তরবিন্যাস প্রচলিত সামাজিক মূল্যায়নের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়, যা কার্যনির্বাহী তত্ত্বে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। এই তত্ত্বে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য এবং স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন মাপকাঠিগুলিকে (ক্ষমতা, মর্যাদা, সম্পত্তি) পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি। প্রচলিত স্তরবিন্যাসকে অব্যাহত রাখতে সুবিধাভোগী শ্রেণী যে বলপ্রয়োগ এবং শক্তি (Power) প্রয়োগ করে, কার্যানির্বাহী তত্ত্বে তা সম্পূর্ণ বিশ্লেষিত হয়নি।
❺ Conflict Theory or Marxian Theory : কার্যনির্বাহী তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত তত্ত্ব হল স্তরবিন্যাস সম্পর্কে দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব (Conflict theory)। এই তত্ত্বে স্তরবিন্যাসকে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় (Dysifunctional) বলে মনে করা হয়েছে। কারণ এই তত্ত্বে মনে করা হয় স্তরবিন্যাস কেবলমাত্র বিভিন্ন স্তরের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয়, উপরিস্তরভুক্ত সদস্যগণ নিম্নস্তরভুক্ত সদস্যদের ক্রমাগত শোষণ করেচলেছে। এই তীব্র বৈষম্য এবং শোষণ সামাজিক শৃঙ্খলা এবং সংহতি বিশেষভাবে বিনষ্ট করে। এই তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য প্রবক্তারা হলেন কার্ল মার্কস, সরোকিন, Dehrendron .
