প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব :

☐ প্রাচীন ভারতীয়রা জ্ঞান বিজ্ঞানে বিভিন্ন দক্ষতার পরিচয় দিলেও সেখানে কোন লিখিত গ্রন্থ রচিত হয়নি। গ্রীসের ইতিহাসে যেমন লিখিত উপাদান একটা বড় মাধ্যম। মোটামুটিভাবে রাজতরঙ্গিনীকে ভারতের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। হরপ্পা সভ্যতার সূচনা আগে থেকেই ভারতীয় সভ্যতার শুরু। মূলত ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দের আগের সময়কালকে আমরা প্রাচীন যুগ হিসাবে চিহ্নিত করি। এই সময়কালে ইতিহাসের উপাদানকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) সাহিত্যিক উপাদান  (২) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। 

❐ সাহিত্যিক উপাদান আবার দুই ভাগে বিভক্ত। (ক) ভারতীয় সাহিত্য ও বিদেশী সাহিত্য। অন্যদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে তিনভাগে ভাগ করা যায় যথা― (ক) লিপি, (খ) মুদ্রা, (গ) স্থাপত্য-ভাস্কর্য।

১. সাহিত্যিক উপাদান : সাহিত্যিক উপাদান বলতে সেই সময়কালের সাহিত্য গ্রন্থাবলীকে বোঝায়। প্রাচীন ভারতের রচনায় এগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যিক উপাদান মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। (i) দেশীয় উপাদান ও (ii) বিদেশী সাহিত্য উপাদান।
(i) দেশীয় উপাদান : দেশীয় সাহিত্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বেদ, রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ স্মৃতি সমূহ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম গ্রন্থ, সংস্কৃত সাহিত্য, জীবন চরিত এমনকি আঞ্চলিক ইতিহাস। বেদ এবং অপর একটি ভাগ থেকে ঋকবৈদিক যুগ এবং পরবর্তী যুগ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দেয়। পুরাণগুলি থেকে রাজবংশের উৎপত্তি, রাজাদের বংশতালিকা, রাজাদের কার্যকলাপ, ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। স্মৃতি শাস্ত্রগুলি থেকে সামাজিক রীতি-নীতি, সমাজ সংগঠন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক বিভিন্ন রাজাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে জানা যায়। ভারতের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ দ্বাদশ শতকের ব্রাহ্মণ কলহন কর্তৃক রচিত রাজতরঙ্গিনী থেকে কাশ্মীরের ধারাবাহিক রচনায় গুরুত্বপূর্ণ।

(ii) বিদেশী সাহিত্য : প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল অবধি বহু বিদেশী পর্যটক, ব্যবসায়ী, ধর্মপিপাষু ব্যক্তি এবং বিজেতা ভারতে আসেন। এদের মধ্যে প্রাচীন ভারতে এসেছেন গ্রীক, রোমান, চৈনিক, তিব্বতীয় ও মুসলিমরা। তাদের রচিত উপাদানগুলি ভারত ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মেগাস্থিনিসের 'ইন্ডিকা’, টলেমির ‘জিওগ্রাফি’, পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী, প্লিনির ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি’ থেকে ভারত-রোম বাণিজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। ফা-হিয়েনের ফো-কুয়ো কি ও হিউয়েন সাঙের সি-ইউ-কি, ই-সিঙের বিবরণ এবং ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের জন্ম’ থেকে নানা তথ্য পাওয়া যায়। তাছাড়া আল মাসুদি প্রমুখ মুসলিম পর্যটকের রচনা থেকে বহু তথ্য পাওয়া যায়।

২. প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান : প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে ‘প্রাচীন ভারত ইতিহাসের নোঙর’ বলা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয় যথা― (ক) লিপি, (খ) মুদ্রা ও (গ) স্থাপত্য-ভাস্কর্য।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় লিপি ও মুদ্রার গুরুত্ব :

(ক) লিপি : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে লিপির গুরুত্ব সর্বাধিক। লোহা, সোনা, তামা, ব্রোঞ্জ, মাটির তৈরি নানা দ্রব্যাদি ইত্যাদি। মন্দির এমনকি দেবমূর্তির উপর নানা উপাদান পাওয়া গেছে। অধ্যাপক র‍্যাপসন এর মতে প্রাচীন লিপি থেকে একটি দেশ ও যুগের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। সোহগোর তাম্রলিপি ভারতের প্রাচীনতম লিপি। ব্রাহ্মী লিপি, খরোষ্ঠি লিপি, আইহোল প্রশস্তি, গোয়ালিয়র প্রশস্তি এবং ভারতের বাইরে প্রাপ্ত বোঘাজকয় শিলালিপি থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
(খ) মুদ্রা : প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় লিপির পরেই মুদ্রার স্থান। ভারতের প্রাপ্ত প্রাচীনতম মুদ্রাগুলিতে কেবলমাত্র মূর্তি ও প্রতীক চিহ্ন দেখা যায়। অনেক সময় একই মুদ্রার উপর বিভিন্ন যুগ বা রাজার একাধিক প্রতীক চিহ্নের অস্তিত্ব দেখা যায়। এই সময়ে কেবলমাত্র রাজাই নয় অন্যান্য সংঠন ও মুদ্রা প্রকাশ করত। ভারতে গ্রীক আক্রমণের পর মুদ্রার উপর রাজার নাম লেখার পদ্ধতি শুরু হয়। এই মুদ্রাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, শিল্প-নৈপূণ্য অঙ্কিত থাকত। তাছাড়াও মুদ্রাগুলি থেকে বিভিন্ন রাজার রাজার রাজত্বকাল, রাজ্যজয় ও অন্যান্য ধারণা পায় যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে মুদ্রার গুরুত্ব অকিঞ্চিৎকর তা সত্ত্বেও বলা যায় মুদ্রার গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।

(গ) প্রাচীন স্মৃতি সৌধ ও স্থাপত্য ভাস্কর্য : প্রাচীন নগর, মন্দির, দূর্গ, অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ, সমাধি স্তম্ভ, স্মৃতি স্তম্ভ, প্রাচীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত স্থাপত্যের ফলে ভারতীয় সভ্যতার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে খ্রীঃ পূর্ব ৩০০০ অব্দের আগে ভারতের এক উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। বিহারের সারনাথ. পাটলিপুত্র, নালন্দা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের তক্ষশীলার খননকার্যের ফলে বৌদ্ধ ও আর্য সংস্কৃতির নানাদিক উন্মোচিত হয়েছে, তক্ষশীলা থেকে গ্রীক, পল্লব, শক ও কুষাণ যুগের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এবং গুপ্তযুগে আবিষ্কৃত নানা মন্দির, গুহার চিত্রাবলী সে যুগের উন্নত সাংস্কৃতিক দিকের পরিচয় দেয়।

  আরো পড়ুনঃ

মেহেরগড় সভ্যতা :
● ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা হল মেহেরগড় সভ্যতা। 1974 খ্রি. পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে আবিষ্কৃত হয়।
● ফরাসী প্রত্নবিদ জেন ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডৌ (Meadow) এই সভ্যতা আবিষ্কার করেন।
● মেহেরগড় সভ্যতা বর্তমানে পাকিস্তানের কোয়েটা শহর থেকে 150 কিমি দূরে বোলান গিরিপথের কাছে অবস্থিত।
● মেহেরগড় সভ্যতার মূল কেন্দ্রগুলি হল – (i) কিলেগুল মহম্মদ (ii) কোটদিজি (iii) গুমলা (iv) রানা ঘনড়াই (v) আনজিরা (vi) মেহেরগড়।

হরপ্পা সভ্যতা :
● 1921 খ্রি. দয়ারাম সাহানি হরপ্পা নগরী ও 1922 রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদাড়ো নগরী আবিষ্কার করেন।
● হরপ্পা সভ্যতার সময়সীমা হল 3000 খ্রি. পূর্বাব্দ থেকে 1500 খ্রি. পূর্বাব্দ।
● হরপ্পা সভ্যতা ছিল অতি উন্নত এক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা।
● মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্রগুলি বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রে অবস্থিত।
● হরপ্পা কথাটির অর্থ ‘পশুপতির খাদ্য’ ও মহেঞ্জোদারো কথাটির অর্থ ‘মৃতের স্তূপ।
● হরপ্পা সভ্যতা তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা।
● হরপ্পা সভ্যতার প্রধান বন্দর গুজরাটের লোথালে অবস্থিত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দর।
● সিন্ধু বা হরপ্পা লিপি ছিল আসলে চিত্রলিপি। এই লিপি ডানদিক থেকে বামদিকে পড়া হত। এখনও অবধি এটি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

বৈদিক সভ্যতা :
● আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য গ্রন্থ হল—‘বেদ’, ‘বিদ্’ শব্দের অর্থ (জ্ঞান) থেকেই বেদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
● বেদ চার প্রকারের—(i) ঋগ্ (ii) সাম (iii) যজু (iv) অথর্ব।
● ঋগ্‌বেদ হল বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ এবং প্রাচীনতম বেদ।
● পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ হল—ঋগ্‌বেদ।
● প্রতিটি বেদকে চার ভাগে ভাগ করা হত—সংহিতা (পদ্যাংশ), ব্রাহ্মণ (গদ্যাংশ), আরণ্যক, উপনিষদ।
● পরবর্তী বৈদিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল—চতুরাশ্রম (ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্যাস)।
● মহাভারত রচনা করেন—বেদব্যাস।
● রামায়ণ রচনা করেন—বাল্মীকি।
● বিখ্যাত আর্যনারীগণ হলেন—গার্গী, মৈত্রেয়ী, মমতা, অপালা, ঘোষা, বিশ্ববারা ও বিশাখা।
● আর্যসভ্যতা ছিল ‘পিতৃতান্ত্রিক’।
● আর্যসভ্যতায় উল্লেখযোগ্য দেবীগণ হলেন—উষা, অদিতি, অরুন্ধতী, সরস্বতী, সাবিত্রী।
● ‘আর্য’ হল—ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর নাম।

 ◼︎◼︎◼︎ Read More  ◼︎◼︎◼︎ 

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন