টাইটানিক নামক বিশাল জাহাজের নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বিশাল এবং বিলাসবহুল স্বপ্নের জাহাজ। আটলান্টিক মহাসাগরে ১২,৪৬৭ ফুট যা সমাহিত রয়েছে একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে। রহস্যে ঘেরা এই জাহাজ নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। বিশ শতকের গোড়ার দিকের ঘটনা। নতুন একটি জাহাজ নিয়ে সারা পৃথিবীতে তখন হইছই। জাহাজটি এতই বড় ও মজবুত যে এর নির্মাতারা ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরও এই জাহাজকে ডুবাতে পারবেন না! সমুদ্রে একটি পাটকাঠি ডুবে যাবে তবুও এই জাহাজ ডুববে না! সেই জাহাজটির নাম টাইটানিক। অথচ সবার ধারণা ভুল প্রমান করে ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রের ডুবন্ত একটি আইসবার্গের সাথে ধাক্কা লেগে সমুদ্রের নীল জলে তলিয়ে যায় এই টাইটানিক। তাও আবার প্রথম যাত্রাতেই! দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে ১,৫১৩ জন যাত্রীর। ভাগ্যবান ৬৮৭ জন যাত্রীর জীবন বাঁচলেও পরবর্তী জীবনে তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে এই দু:স্বপ্ন। গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা টাইটানের নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয় ‘টাইটানিক’।
টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু করা হয় ১৯০৭ সালে। ৩০০০ শ্রমিককের পাঁচ বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করার পর ১৯১২ সালে জাহাজটির কাজ সমাপ্ত হয়। ৬০ হাজার টন ওজন এবং ২৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার, যা বর্তমান প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন ডলারের সমান। এ জাহাজটি সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৪৭ জন যাত্রী ও ত্রু বহন করতে পারত। এটি ছিলো তৎকালীন সময়ে তৈরী সবচেয়ে অদ্ভুতপূর্ব মাপে নির্মিত একটি জাহাজ। ফার্স্ট ক্লাস যাত্রীদের জন্য ছিলো বিলাসবহুল ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা। যেখানে এক সাথে প্রায় ৫৫০ জন খাবার খেতে বসতে পারতো। এছাড়াও ছিলো এর অভ্যন্তরে সুদৃশ্য সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, স্কোয়াস খেলার কোট, ব্যয়বহুল তুর্কিস বাথ, ব্যয়বহুল ক্যাফে এবং ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস উভয় যাত্রীদের জন্য আলাদা বিশাল লাইব্রেরি। সেই সময়ই আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটেছিল এই জাহাজটিতে। এর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাও ছিল উন্নতমানের। এ জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের জন্য তিনটি এবং সেকেন্ড ক্লাসের জন্য একটি, মোট চারটি লিফটের ব্যবস্থা ছিল। এবং টাইটানিকের একটি বিশাল ব্যয় বহুল প্রধান গেট বা দরজা ছিলো।
এরপর আসলো বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটি যেদিন প্রথম যাত্রা করল আরএমএস টাইটানিক। দিনটি ছিলো ১৯১২ সালে ১০ এপ্রিল, মোট ২২২৩ জন যাত্রী নিয়ে ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দৈত্যকায় জাহাজটি। প্রথম শ্রেণীদের জন্য জাহাজের ভাড়া ছিলো ৩১০০ ডলার এবং তৃতীয় শ্রেণীদের ভাড়া ছিলো ৩২ ডলার। ব্যায় বহুল হলেও তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিলো তারা টাইটানিকের যাত্রী হয়ে গন্তব্যস্থানে পৌঁছাবে।
এরপর ঘটে ইতিহাসের বিপর্যয়টি। ১৪ই এপ্রিল নিস্তব্দ সমুদ্রে রাত আনুমানিক ১১:৪০ এর সময় টাইটানিকের নাবিকরা টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গ দেখতে পায়, কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ডানদিকে আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে জাহাজটি, এবং একসময় টাইটানিকের প্রায় ৯০ মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয়। কিছু তথ্যসূত্র থেকে জানা যায় যে, ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুর ২:০০ দিকে Amerika নামের একটি জাহাজ থেকে রেডিও এর মাধ্যমে টাইটানিককে সংকেত দেয় হয় যে- তাদের যাত্রা পথের সামনে একটি বিশাল আইসবার্গ রয়েছে! তারপর "Mesaba" নামের আরো একটি জাহাজও রেডিও এর মাধ্যমে ঐ একই সর্তকবানী পাঠায়। তখন টাইটানিকের রেডিও এর যোগাযোগ অপারেটরের দায়িত্বে ছিলো, জ্যাক পিলিপাস এবং হ্যারন্ড ব্রীড। তাদের কাছে দু’দুবার সর্তকবানী আসার পরও এটাকে তারা অপ্রয়োজনীয় মনে করলো। তারা ইচ্ছা করে, বিরক্ত হয়ে সর্তকবানীটি টাইটানিক নিয়ন্ত্রণের মূলকেন্দ্রে পাঠায়নি।
এমনকি টাইটানিক দুর্ঘটনায় পড়ার মাত্র ৪০ মিনিট আগেও Californian শীপের রেডিও অপারেটর, টাইটানিকের সাথে যোগাযোগ করে আইসবার্গ সম্পর্কে জানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু টাইটানিকের রেডিও অপারেটর জ্যাক পিলিপস রাগন্বিত হয়ে বলল আমি কেইপ রেসের সাথে কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। এই বলে লাইনটি কেটে দেয়। আর সাড়া না পেয়ে Californian শীপের রেডিও অপারেটরও তার ওয়ার্লেস সেটটি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পরে। তাই অনেকের ধারণা সামান্য কিছু অবেহেলার কারণে জাহাজটি দুর্ঘটনার কবলে পরে। আর সেই অবেহেলার কারণের মৃত্যু হলো ১,৫১৩ জন যাত্রীর। অনেকে এটিকে পরিকল্পিত বলে মনে করেন।
অনেকের ধারণা ছিলো আমেন বা আমেন রা নামের মিসরীয় এক রাজকুমরীর অভিশপ্ত মমি ছিলো ঐ টাইটানিকে। তাই বলা হয়- সেই মমির অভিশাপেই নাকি টাইটানিক বরফের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায়। আবার অনেকে এ অভিশাপের কারন হিসেবে দেখিয়েছিলেন এর নম্বর, 390904 কে। আয়নায় যার প্রতিবিম্বের পাশ পরিবর্তন করলে হয়, NO POPE। টাইটানিক জাহাজ ডুবে যাওয়াটা এখনো রহস্যময়। দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধানের পর টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান একদল বিজ্ঞানী। রবার্ট বালার্ড নামক ফরাসি বিজ্ঞানী টাইটানিককে খুঁজে বের করেন। এই টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে সাবমার্শিবল টাইটান পাঁচ জন যাত্রীকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে গেল। টাইটানিক মানেই রহস্য।