✯ সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিল কেন?
◻ শিল্পবিপ্লব ইউরােপের অন্যান্য দেশে না হয়ে ইংল্যান্ডে কেন প্রথম হল, তা একটি ঐতিহাসিক ভাবনার বিষয়। শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে ইউরােপের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় ঐ যুগে ফ্রান্সই তুলনামূলক বিচারে অধিকতর প্রারাক্রমশালী ও সম্পদশালী ছিল। ইংল্যান্ডের মতাে ফ্রান্সও আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ায় বিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। কিছু সংখ্যক শিল্পও ইতিপূর্বে ফ্রান্সে স্থাপিত হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব প্রসূত নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার যুগে ফরাসি শিল্প ও বাণিজ্যে এসে ছিল মন্দা ও অবক্ষয়। অতঃপর এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকায় অবতীর্ণ হল ইংল্যান্ড। সেখানেই প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটল শিল্প বিপ্লবের জন্য ইংল্যান্ডের প্রথম ও প্রধান সহায়ক পরিস্থিতি ছিল তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এই স্থিতিশীলতা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে বসওয়ার্থের যুদ্ধের পর সপ্তম হেনরি তথা টিউডর স্টুয়ার্ট ও হ্যানােভার বংশীয় রাজা ও রানিদের শাসনাধীন ছিল এবং একমাত্র গৃহযুদ্ধের পর্বটুকু বাদ দিলে ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সুষ্ঠু ও আইন সম্মতভাবে এবং প্রায় বিনা রক্তপাতে সংঘটিত হয়েছিল। শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর।১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের গৌরবময় বিপ্লব ইংল্যান্ডে আধুনিক সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।যাইহােক, আলােচ্য পর্বে ইংল্যান্ড দেখেছিল একটি শক্তিশালী রাজতন্ত্র তথা কার্যকরী প্রশাসনের উত্থান, সামন্ততান্ত্রিক নৈরাজ্য ও বিচ্ছিন্নতাকামী প্রবণতার মূলােচ্ছেদ,রিফর্মেশন আন্দোলন এবং রােমের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ, জাতীয় রাষ্ট্রের জাগরণ এবং সবশেষে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও স্বৈরতন্ত্রী রাজতন্ত্রের ওপর জন প্রতিনিধি তথা পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ। এসব Political factors অবশ্যই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবকে প্রথম বিকশিত হতে সাহায্য করেছিল। এগুলির অনুপস্থিতি ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানির শিল্পায়নকে বিলম্বিত করেছিল। ইউরােপের ঐক্যবদ্ধ ও জাতীয় রাষ্ট্ররূপে ইতালি ও জার্মানি আবির্ভূত হয়েছিল ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে।
এই প্রসঙ্গে আরও বলা যায় যে অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডে যে অভাবনীয় সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) ও নাগরিক তথা ব্যক্তিস্বাধীনতা (civil liberty) বিরাজমান ছিল, তা ইউরােপে প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ইংল্যান্ডে একদিকে যেমন বনেদি অভিজাত শ্রেণি তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল, অন্যদিকে সেখানে উদীয়মান স্থানীয় ভদ্ৰশ্রেণি (Gentry) ইংল্যান্ডে আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে শিল্পবিপ্লবকে তরান্বিত করেছিল। অন্যদিকে পূর্ব ইউরােপ তথা রাশিয়ায় মুমূর্ষ সামন্ততন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি অপপ্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল। অসংখ্য ভূমিদাস (serf) শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল সেখানকার জাতীয় জীবনের কলঙ্ক। অষ্টাদশ শতকেও ফ্রান্স সামন্ততান্ত্রিক প্রভাব পুরােপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
উপরােক্ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়া ইউরােপের অধিকাংশ দেশেই অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রচলিত ছিল না। শুধু ফ্রান্সকেই চারটি শুল্ক এলাকায় (customs area) ভাগ করা হয়েছিল। প্রত্যেক শুল্ক এলাকা নিজ ইচ্ছামতাে শুল্ক ধার্য করত। জার্মানি বিভক্ত ছিল প্রায় সাড়ে তিনশটি ছােটো বড়াে, স্বাধীন আধা-স্বাধীন রাজ্যে। একমাত্র ইংল্যান্ডেই সর্বত্র স্বাধীন ও অবাধ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। ফলে শিল্পজাত দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ইংল্যান্ডেই বেশি ছিল, এটা শিল্পবিপ্লবে সহায়তা করেছিল। ব্যাপক বৈদেশিক বাণিজ্যের সাহায্যে এবং উপনিবেশ শােষণ করে ইংল্যান্ড যে মূলধন সংগ্রহ করেছিল তা শিল্পবিপ্লকে ত্বরান্বিত করেছিল। এছাড়া, আরও কয়েকটি অর্থনৈতিক কারণ দেশটিকে শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে এগিয়ে দিয়েছিল, যথা, Bank of England প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণমূলক শুল্ক (Protective tariff) স্থাপন, ইউরােপ থেকে
দক্ষ শ্রমিকের আগমন প্রভৃতি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় হাঙ্গামার আশঙ্কায় বিভিন্ন দেশ থেকে দক্ষ শিল্প শ্রমিক ইংল্যান্ডে এসে বসবাস করতে থাকে। ক্রমশ তাদের সংস্পর্শে এসে ব্রিটিশ শ্রমিকদের দক্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কয়েকটি বিশেষ প্রাকৃতিক সুবিধা ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিশেষ ভৌগােলিক অবস্থানের ফলে তার নৌবহর এত উন্নত হয়েছিল তার উপকূলে ছিল একাধিক বন্দর, নদীগুলি ছিল জাহাজ চলাচলের উপযােগী। এছাড়া, বিশাল লৌহ ও কয়লার আকর ইংল্যান্ডকে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন ছিল জনবহুল ও সমৃদ্ধিশালী নগরী। হব্সবমের ভাষায়, “by far the largest cityদক্ষ শ্রমিকের আগমন প্রভৃতি।
in Christendom”। এর পাশাপাশি লিভারপুল, গ্লাসগাে এবং ব্রিস্টল ছিল যথেষ্ট জমজমাট। ব্রিটিশ বাণিজ্য পােতগুলিতে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যা এক লক্ষ অতিক্রম করে গিয়েছিল।
বাণিজ্য বিস্তারের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল ইংল্যান্ডের গ্রামীণ জীবনে। আলােচ্য পর্বে ইংরেজ গ্রামবাসী আমদানি করা চা, চিনি ও তামাক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। ক্রমশ গ্রামে ক্ষুদ্রশিল্পের বিস্তার ঘটতে থাকে। এই প্রসঙ্গে তাঁত, উল, হােসিয়ারি প্রভৃতির কথা বলা যায়। এই 'Commercialization of rural life এবং small-scale industry' -র বিস্তার শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করেছিল। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের প্রথম ঘটনার মূলে আর একটি কারণ ছিল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অর্থনীতিবিদরা এই প্রক্রিয়াকে Demographic Revolution' বা জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। এই বর্ধিত জনসংখ্যা এক দিকে যেমন পর্যাপ্ত শিল্পশ্রমিকের জোগান দিতে পেরেছিল, অন্যদিকে তেমনি প্রচুর পরিমাণে উৎ -পাদিত শিল্পজাত পণ্যের জন্য প্রয়ােজনীয় একটি অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে তুলতেও সাহায্য করে ছিল।ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের অন্যতম একটি উপাদান ছিল 'Agricultural Revolution' বা কৃষিবিপ্লব’ এর ফলে ইংল্যান্ড খাদ্যশস্য ও কাঁচামাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
কৃষকের সাচ্ছল্য আসায় অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। কাঁচামাল উৎপাদনে ঘাটতি একেবারে ছিল না বলা যায় না কিন্তু সেই ঘাটতি ব্যাপক আমদানির সাহায্যে মেটানাে সম্ভব হয়েছিল। প্রসঙ্গত তুলা ও চিনির কথা বলা যায়। বড়াে ভূস্বামী কর্তৃক জমি ঘেরাও পদ্ধতি (enclosure system) কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যে সহায়তা করেছিল। এতে অবশ্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে তারাও ব্যাপকভাবে শিল্পশ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিল। সবশেষে বলা যায় ব্রিটেনে প্রথম শিল্পবিল্পব ঘটার মূলে ছিল বিভিন্ন সময়ে সেখানকার শাসক গােষ্ঠীর মন্ত্রীসভা এবং রাজ পরিবার উভয়ের সহায়ক মনােভাব। প্রথমে এই শাসকগােষ্ঠী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে বাণিজ্য বিস্তারে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এবং একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এঁরাই আবার একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকারের অবসান ঘটিয়ে উপনিবেশে অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তন করেছিলেন।অন্যদিকে, দেশীয় শিল্প রক্ষার্থে-শুল্ক প্রাচীর গড়ে তুলে ভারতের মতাে বৃহৎ উপনিবেশে অবশিল্পায়ন ঘটিয়ে, বস্ত্রশিল্প রপ্তানিতে সক্রিয়ভাবে সহযােগিতা করে এবং ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন। অনুরূপ সহায়তা ফরাসি রাজকীয় (বুরবো) প্রশাসন করেননি বলেই বাণিজ্য বিস্তার ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ফ্রান্স পিছিয়ে ছিল। শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল ইংল্যান্ড, পরবর্তীকালে মহাদেশীয় ইউরােপে তাকে অনুসরণ করেছিল ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও রাশিয়া। এদের মধ্যে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বহু পার্থক্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাধারণভাবে বলা যায়, মহাদেশীয় ইউরােপ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের তুলনায় এক-প্রজন্ম পিছিয়ে ছিল। এপ্রসঙ্গে প্রথমেই উভয়ের শহরবাসী ও গ্রামবাসী মানুষের একটি তুলনামূলক বিচার করা যায়। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ড ও ওয়েলস্-এর জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ শহরে বসবাস করত, অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই হার ছিল ২৫ শতাংশ। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি জার্মানির গ্রামীণ জনসংখ্যার চেয়ে নাগরিক জনসংখ্যা উল্লেখ যােগ্য ভাবে বাড়েনি। ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গ্রামীণ মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধি বা হ্রাস শিল্পায়নের অগ্রগতি বা পশ্চাদমুখী নতার পরিচায়ক।
শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে একটা মােটামুটি সমতা এসেছিল। বলাবাহুল্য, নগরবাসী পেশাগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় ইউরােপের দেশগুলাে ইংল্যান্ডের তুলনায় শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। মধ্য ঊনবিংশ শতকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার মাত্র ২৫ শতাংশ কৃষিতে নিযুক্ত ছিল, বেলজিয়ামে এই সংখ্যা ছিল ৫০ শতাংশ। জার্মানির এই স্তরে পৌঁছােতে আরও ২৫ বছর সময় লেগেছিল। ১৮৯৫ খ্রি: পর একটি পরিসংখ্যান থেকে বােঝা যায় যে, তখনও মহাদেশীয় ইউরােপে শিল্পের চেয়ে কৃষিতে বেশি সংখ্যক মানুষ নিযুক্ত ছিল। মহাদেশীয় শিল্পায়ন ইংল্যান্ডের তুলনায় ছিল অপেক্ষাকৃত ধীরগতি সম্পন্ন। শিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের ক্ষেত্রেও এরা পিছিয়ে ছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউরােপীয় শিল্পপতিরা গােপনে ইংল্যান্ড থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করত। কিন্তু এগুলাে আয়ত্তে আনতে তাদের অনেক বেশি সময় লেগেছিল। শিল্পায়ন প্রক্রিয়াও উভয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নতর ছিল।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়েছিল সুতিবস্ত্র শিল্পকে কেন্দ্র করে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সেখানে সুবিস্ত্র
শিল্পের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে এর প্রভাব অনুভূত হয়েছিল অন্যান্য শিল্পে। সুতিবস্ত্র শিল্পের অগ্রগতি লক্ষ করে ইংল্যান্ডের পুঁজিপতি শ্রেণি লৌহ, কয়লা, রাসায়নিক ও অন্যান্য শিল্পে পুঁজি বিনিয়ােগ করতে উৎসাহিত বােধ করেছিলেন। অন্যদিকে মহাদেশীয় ইউরােপে ভারী শিল্প, কয়লা ও লােহা ছিল শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্রে অগ্রণী ক্ষেত্র। সুতিবস্ত্র, রাসায়নিক ইত্যাদি শিল্পের সূত্রপাত হয়েছিল আরও পরবর্তীকালে।