শিল্প বিপ্লব বলতে কি বোঝায় (Industrial-Revolution)

Industrial-Revolution-Karahan

⦿ Industrial-Revolution :- (শিল্প বিপ্লব)

ロ  উনবিংশ ও বিংশ শতকের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) ব্রিটেনের ইতিহাসচর্চা করে ‘শিল্পবিপ্লব’ (Industrial Revolution) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত কয়েকটি বক্তৃতা মালায় তিনি এবিষয়ে তাঁর ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দকে শিল্পবিপ্লবের সূচনাপর্ব হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন এবং এর পরবর্তীকালেই শিল্পের ক্ষেত্রে নানা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। কিন্তু
এ বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পােষণ করেন বিখ্যাত আমেরিকান অর্থনৈতিক ঐতিহাসিক জে. ইউ. নে (J. U. Nef)। Economic History Review-তে তিনি ঐতিহাসিক অবিচ্ছিন্নতার ধারার পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে নির্দিষ্ট বছরকে শিল্পবিপ্লবের শুরু হিসাবে মানতে অস্বীকার করেছেন এবং এই প্রক্কিয়ায় তিনি বৈপ্লবিক কিছু লক্ষ করেননি। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরােপের ইতিহাসের পর্বটি ছিল অসংখ্য-বৈপ্লবিক তৎপরতা ও কার্যকলাপের যুগ, যা সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনে সীমাহীন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল।

এর পাশাপাশি একটি আর্থিক- বৈজ্ঞানিক বৈপ্লবিক প্রভাব প্রথমে ইংল্যান্ডে ও পরবর্তীকালে মহাদেশীয় ইউরােপে অনুভূত হয়েছিল, এই প্রক্রিয়াই ছিল শিল্পবিপ্লব। এর মর্মার্থ ছিল সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও শক্তির (energy) উপর মানুষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তিম পর্ব পর্যন্ত এই সম্পদ ও শক্তির ওপর মানুষের তেমন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু শিল্পবিপ্লব এর ওপর মানুষের আধিপত্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত করে এক নব দিগন্ত উন্মােচিত করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্তিম পর্ব পর্যন্ত পৃথিবী তথা ইউরােপের সমাজ ছিল গ্রামীণ সমাজ। কৃষি ছিল মানুষের প্রধান জীবিকা। শিল্পবিপ্লব সেই কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে এমন এক শিল্পোন্নত সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত করেছিল, যার অন্যতম ভিত্তি ছিল কলকারখানা, যন্ত্রপাতি আর নগরজীবন।

খ্রিস্টধর্ম, সামন্ততন্ত্র আর রােমান আইনের সংকীর্ণ পরিধি অতিক্রম করে ইউরােপে যে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল তার অন্যতম স্থপতি ছিল নতুন বুর্জোয়া শ্রেণি, ব্যাংক ব্যবস্থা এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা ভিত্তিক জ্ঞান অতঃপর সমৃদ্ধি এবং শিল্পোন্নয়ন হয়ে ওঠে সমার্থক, Phyllis Deane, এর ভাষায় “...the route of affluence lies by the way of Industrial Revolution" (The First Industrial Revolution) শিল্প বিপ্লবের মতাে ব্যাপক ও অভাবনীয় রূপে বিস্তৃত একটি প্রক্রিয়াকে সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিশ্লেষণ করা একটি সাধারণ পাঠ্যপুস্তকে সম্ভব নয়।

যাই হোক, আধুনিক শিল্পভিত্তিক সমাজ প্রথম ইংল্যান্ডেই গড়ে উঠেছিল। সেখানে এবং পরবর্তীকালে ইউরােপে পুরাতন কৃষিভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতিতে ভাঙন এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি নতুন মাত্রায় উত্তরণ ঘটেছিল ১৭৬০-১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মতান্তরে। এই পুরাতন উৎপাদন পদ্ধতি থেকে নতুন উৎপাদন পদ্ধতিতে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে ঐতিহাসিকগণ 'Take off ' বা উড়ান আখ্যা দিয়েছে। কেন মহাদেশীয় ইউরােপের তুলনায় ইংল্যান্ডে এই "Take off " আগে ঘটেছিল তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইতিহাস বিদগণ ইংল্যান্ডের জলবায়ু, খনিজ সম্পদ কয়লা, পর্যাপ্ত শস্য উৎপাদন, ভৌগােলিক অবস্থান প্রভৃতির কথা বলেছেন। অবশ্য এর উত্তরে অন্যান্য লেখকগণ পরবর্তীকালে প্রশ্ন করেছেন অনুকূল জলবায়ু, ইউরােপের অন্যান্য দেশেও ছিল, কয়লাখনি সাইলেশিয়াতেও ছিল, প্রচুর শস্য উৎপাদন ইংল্যান্ডে ইতিপূর্বে হয়েছিল। কিন্তু তখন শিল্পবিপ্লব ইংল্যান্ডে ঘটেনি, সাইলেশিয়াতেও নয়। এ বিষয়ে আরও বলা হয়েছে অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞানচর্চা বা কারিগরি বিদ্যা ইউরােপের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় খুব বেশি অগ্রসার ছিল না—এক্ষেত্রে ফ্রান্স উন্নততর ছিল। তা সত্ত্বেও ইংল্যান্ডেই প্রথম শিল্পবিপ্লব 'take off' করেছিল।

📌 আরো পড়ুন :
🟌ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিল কেন?

এই প্রসঙ্গে W. W. Rostow মতবাদ আলােচনা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।  রস্টো তার 'Stages of Economic Growth' গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশেষ কয়েকটি স্তরকে অতিক্রম করে।এগুলি কখনােই মার্কস বর্ণিত স্তর, অর্থাৎ আদি কমিউনিজম, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই স্তর নয়। রস্টোর মতে এই স্তরগুলি হল
✒ প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত সমাজ
✒ শিল্পবিপ্লবের সূচনাপর্বের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি, 
✒ সূচনাপর্ব (বা take off),
✒ উন্নত (পরিণত) আর্থিক অবস্থার দিকে যাত্রা এবং 
✒ ব্যাপক ভােগ্যপণ্য ব্যবহারের যুগ

ঐতিহাসিকদের একাংশ রস্টোর বক্তব্যের অভিনবত্ব অস্বীকার না করেও একে আংশিকভাবে খণ্ডন করেছেন। তারা তাদের আলােচনায় দেখিয়েছেন বিশেষ কয়েকটি দেশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রাথমিক স্তর বাদ দিয়ে পরবর্তী শিল্পায়নের স্তরে পৌছে যেতে পারে। এছাড়া, পূর্ববর্তী স্তরের কিছু বৈশিষ্ট্য পরবর্তী স্তরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারে। রুশ দেশীয় ইতিহাসবিদ আলেক জান্ডার গার্শেনক্রন মনে করেন অনুন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে রস্টো বর্ণিত এই বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে শিল্পোন্নয়নের অগ্রগতির তত্ত্ব পুরােপুরি প্রযােজ্য নয়। অনুন্নত দেশেও খুব অল্পকালের মধ্যে বড়ােমাপের শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা একেবারে অসম্ভব নয়। সেখানে বৃহৎ শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংস্থা মূলধন সরবরাহ করে এবং প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোগ পতিবৃন্দ সে ব্যাপারে যথাসাধ্য সহায়তা করে।

ইংল্যান্ডের মতাে উন্নত দেশে প্রাথমিক শিল্পায়নের জন্য প্রয়ােজনীয় মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছিল।
দেশবাসীর সঞ্চিত অর্থ থেকে অথবা বাণিজ্য অর্জিত মুনাফা থেকে। কিন্তু জার্মানি বা রাশিয়ার মতাে দেশে মূলধন জোগাতে এগিয়ে এসেছিল ব্যাংকগুলি এবং সরকার সেখানে অর্থ এসেছিল শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি এবং সঙ্গে সঙ্গে। ইতিপূর্বে সঞ্চিত অর্থ সেখানে মূলধন হিসাবে বিনিয়ােগ করা হয়নি এবং এই প্রক্রিয়ায় শিল্পয়নের প্রস্তুতিপর্বও তৈরি হয়নি। এইসব দেশগুলিতে শিল্পবিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেনি পুরাতন কৃষি উৎপাদন পদ্ধতিতে ভাঙন, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, ব্যাপক অর্থনৈতিক পরিবর্তনে আগ্রহী বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উত্থান- এইসব বৈশিষ্ট্য ইউরােপের অন্যান্য দেশে তেমন লক্ষ করা যায় না। অর্থাৎ, শিল্প- বিপ্লবের আগমন বা সূচনাপর্বের (take off) জন্য সর্বদেশ ও সর্বকালে প্রযােজ্য কোনাে সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে কখনােই চিহ্নিত করা যায় না। শিল্পবিপ্লবের আগমনের ক্ষেত্রে যুদ্ধের একটি ভূমিকা আছে এবং এবিষয়ে মার্কস অথবা রস্টো কেউই সেভাবে চিন্তাভাবনা করেননি। নেপােলিয়নের ইউরােপে প্রশাসনিক দুর্বলতার কথা চিন্তা করে জার্মানি ও রাশিয়া শিল্পায়নে প্রয়াসী হয়েছিল। প্রাশিয়া তথা বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানির একীকরণের যুদ্ধে প্রাশিয়ার সাফল্য শিল্পোন্নয়নের বিষয়ে রাশিয়াকে আরও বেশি সচেতন করেছিল। অহিফেন যুদ্ধে ব্রিটেনের সাফল্য অনুরূপভাবে জাপানকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

শিল্পবিপ্লবের আগমন প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি তত্ত্ব পরিবেশিত হয়েছে এগুলির মধ্যে অন্যতম হল পশ্চিম ইউরােপের বাণিজ্য বিপ্লবের তত্ত্ব, যে বাণিজ্য বিপ্লব শিল্পবিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছিল। এই বাণিজ্য পুঁজিবাদ, ১৫০০ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে তন্ত্র বা ব্যবস্থা তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিল এবং যার অবসানে শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিল। এই বাণিজ্য বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি। ছিল-বণিকশ্রেণির উত্থান, বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, পণ্য ও অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি, মূল্য-মুনাফা-মূলধন সঞ্চয় ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রিফর্মেশন আন্দোলন, সামন্তপ্রভুদের অবস্থান, মর্যাদা, ক্ষমতা হ্রাস, রাজতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ইউরােপে একাধিক জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান। এই পরিবর্তনগুলির পরবর্তী অধ্যায়ে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল।

অনেকে শিল্পবিপ্লবের কারণ হিসাবে ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরােপীয় দেশগুলির বহির্বিশ্বে, বিশেষত আমেরিকা, এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, উপনিবেশ থেকে স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল সংগ্রহ, উপনিবেশসমূহে বাজার দখল এবং উপনিবেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ধ্বংস অসম প্রতিযােগিতার ফলশ্রুতি। এই মন্তব্য ব্রিটেন ও তার ভারতীয় উপনিবেশ সম্বন্ধে বিশেষভাবে প্রযােজ্য। কিন্তু উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও শিল্পবিপ্লবের মধ্যে সম্পর্কের তত্ত্ব সর্বক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। লাক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি-ইউরােপীয় দেশগুলির কোনাে উপনিবেশ ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সের তুলনায় জার্মানির উপনিবেশ অনেক কম ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও জার্মানি শিল্পায়নের পথে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছিল। আবার ফ্রান্সের উপনিবেশ যথেষ্ট বিস্তীর্ণ হওয়া সে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে ছিল।

অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল অনেকাংশে সেই যুগের শিল্পনীতির (Fiscal policy) জন্য। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্রিটেন ভারত থেকে আমদানিকৃত কুটির ও হস্তশিল্পজাত বিলাসদ্রব্যের ওপর উচ্চ হারে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ শুল্ক স্থাপন করে। বলাবাহুল্য, এর ফলে ব্রিটেনের বাজারে ঐসব ভারতীয় পণ্যের মূল্য অভাবনীয় রূপে বৃদ্ধি পায় এবং ইংরেজরা স্বদেশে উৎপাদিত ঐসব পণ্য অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যে ক্রয় করতে থাকে। এইভাবে আমদানি শুল্কের অন্তরালে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লবের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। আমদানি শুল্ক বসানাের ফলে ভারতীয় দ্রব্যের চাহিদা কমে যায় এবং ক্রমে ক্রমে হস্তশিল্পগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ভারতীয় কুটির ও
অনেকে অবশ্য এব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করে বলেছেন যে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব ও সেই সময়কার শুল্কনীতির মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই। শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র নানাবিধ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে।

যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলেই ভারতীয় শিল্পগুলি ব্রিটেনের শিল্পের সঙ্গে অসম প্রতিযােগিতায় অস্তিত্ব রক্ষা করতে না পেরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের যদি অবাধ বাণিজ্য থাকত তাহলে উন্নতমানের ভারতীয় হস্তশিল্পজাত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় ব্রিটেনেরপণ্য টিকে থাকতেই পারত না। তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য শুল্ক প্রাচীর (tariff barrier) স্থাপন করতে হয়েছিল। এছাড়া, শুধুমাত্র যন্ত্র আবিষ্কার হলেই হবে না। যন্ত্রগুলিকে আর্থিক প্রয়ােজনে লাগানাের মতাে উপযুক্ত একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়ােজন। এবিষয়ে অধ্যাপক মরিস. ডব মন্তব্য করেছেন যে শিল্প আবিষ্কারসমূহ অনেকাংশেই সামাজিক প্রয়ােজনের ফলশ্রুতি (...largely social products)। একজন আবিষ্কারক ও তার প্রকল্পসমূহের উপাদানগুলিকে যেসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, তা অনেকটাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও যুগের প্রয়ােজনে উত্থাপিত হয়। কয়লা জ্বালিয়ে লােহা গলানাের পদ্ধতি ব্রিটেনে ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও লােহা গলানাের কাজে কাঠই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রায় এক শতাব্দী পরে ডার্বিই প্রথম কয়লা ব্যবহার করে লােহা গলানাের কাজের প্রচলন করেন। কারণ এই সময় কয়লার চেয়ে কাঠের দাম অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং সেই কারণে কয়লা ব্যবহার ছিল আর্থিক দিক থেকে সুবিধাজনক।

তৎকালীন ইউরােপে প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং বিশেষত ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ শিল্পবিপ্লবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এছাড়া, ঐতিহাসিকদের একাংশের মতে শিল্পবিপ্লবের মতাে একটি যুগান্তকারী ঘটনাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা যান্ত্রিক ঘটনার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। সমকালীন কিছু মানুষের জীবনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কথাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। সেইযুগে কিছু সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র দিনযাপন ও বেঁচে থাকার কথা চিন্তা না করে কীভাবে আরও সম্পদশালী হওয়া যায় সেবিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকে। এর জন্য প্রয়ােজনে তারা ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত ছিল। অর্থোপার্জন ছিল এই শ্রেণির ধ্যান-জ্ঞান চিন্তা। শিল্পে অর্থ বিনিয়ােগের ঝুঁকি নিতে এই উদ্যোগ পতিগণ দ্বিধাবােধ করেননি। এদের মধ্যে থেকে উদ্ভূত হয়েছিল আগামী দিনের 'আঁতরপ্রেনার’ (entrepreneur) ও পুজিবাদী শ্রেণি। এরাই ছিলেন শিল্পবিপ্লবের অগ্রদূত।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন