টুম্যান নীতি (Truman-Doctrine)

টুম্যান নীতি বলতে বোঝোয় তুরস্ক ও গ্রিসকে সোভিয়েত প্রভাব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ প্রেসিডেন্ট টুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তিনি তুরস্ক, গ্রিস এবং বিশ্বের যে-কোনাে দেশকে সােভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এই ঘােষণা টুম্যান নীতি’ (Truman Doctrine) নামে পরিচিত।

ট্রুম্যান বা টুম্যান নীতি হলো দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে চলমান ঠান্ডা লড়াই যখন ১৯৪৭ সালের গােড়ায় তীব্রতর হয়ে উঠেছিল তখন ‘টুম্যান নীতি’ নামে পরিচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি টুম্যানের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিশেষ নীতিটি ঘােষিত হওয়ার সাথে সাথে, ইতিপূর্বে আলােচিত কেন্নানের ‘Policy of Containment'-এর পরিপূরক ও সম্প্রসারিত রূপ ছিল এই 'Truman Doctrine' নীতি। ১৯৪৭ সালের ১৫ মার্চ টুম্যান নীতি ঘােষিত হয়েছিল। এই নীতিতে বলা হয়েছিল বিশ্বের যে-কোনাে দেশ বা জাতি নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার প্রয়ােজনে অথবা বিদেশি চাপ ও প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি অক্ষুন্ন রাখতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পুরােমাত্রায় সাহায্য ও সহযােগিতা পাবে। অর্থাৎ মার্কিন প্রশাসনের নীতি হল বহিরাগত চাপের বিরুদ্ধে যে সমস্ত দেশের স্বাধীন জনসাধারণ সংগ্রামরত তাদের সর্বতােভাবে সাহায্য করা  (“...it must be the policy of the United States to support free peoples who are resisting subjugation by armed minorities or outside pressures.")
এর প্রকৃত অর্থ ছিল কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ ও তার সঞ্চালক সােভিয়েত রাশিয়ার রাজনৈতিক তথা সামরিক তৎপরতার সর্বতােভাবে বিরােধিতা করা।

 টুম্যান নীতি প্রবর্তনের একটি বিশেষ পরিপ্রেক্ষিত ছিল পূর্ব ইউরােপে ধাপে ধাপে কমিউনিস্ট শাসিত প্রভাববলয় গড়ে তােলার পর সােভিয়েত ইউনিয়ন গ্রিস, তুরস্ক ও ইরানের ওপর তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর্থিকভাবে বিধ্বস্ত ব্রিটেনের পক্ষে ১৯৪৭ থেকে গ্রিস ও তুরস্ককে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সাহায্য করে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ব্রিটেন ঐ দুটি দেশ থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে থাকে।

সােভিয়েত রাশিয়া সেই সুযােগে তুরস্কের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে সচেষ্ট হয় এবং সাথে সাথে মস্কোর মদতপুষ্ট বামপন্থী গেরিলারা গ্রিসের দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান টুম্যান সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি গ্রিস ও তুরস্ককে সহায়তা দেওয়ার প্রয়ােজনে এবং অবশ্যই সােভিয়েত তৎপরতার মােকাবিলা করতে ১৯৪৭ সালের ১২ মার্চ মতান্তরে, ১৫ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসের কাছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ব্যয়বরাদ্দের অনুমােদন চান। তার এই উদ্যোগ সাধারণভাবে “টুম্যান নীতি’র অঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে।

অবশেষে, আমেরিকার সাহায্যপুষ্ট গ্রিস প্রশাসন ১৯৪৯ সালে সেখানকার বামপন্থী গেরিলা যােদ্ধাদের ধ্বংস করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা কায়েম করতে সফল হয়। তুরস্কেও প্রায় অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। বিতর্কিত টুম্যান নীতির সমালােচনা যারা করে থাকেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন। মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার ওয়াল্টার লিপম্যান। 

⦿ প্রথমতঃ লিপম্যানের মতে এই টুম্যান তত্ত্ব মার্কিন বিদেশনীতিকে তীব্র সােভিয়েতবিরােধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলেছিল। যে-কোনাে প্রকার সােভিয়েত বিরােধিতা এখন মার্কিন বিদেশনীতির মূল কথা হয়ে উঠল। 
⦿ দ্বিতীয়তঃ সােভিয়েত সঞ্চালিত সাম্যবাদের প্রসার রােধ করার জন্য এখন থেকে আমেরিকাকে একগুচ্ছ তাবেদার রাষ্ট্রগঠনে উদ্যোগী হতে হয়েছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেসব রাষ্ট্রগুলি প্রকৃতি ও শাসন কাঠামােয় ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ও গণতন্ত্র বিরােধী। ১৯৬০-এর দশক থেকে লাতিন আমেরিকা, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই ধরনের বেশ কয়েকটি মার্কিনপন্থী একনায়কসুলভ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল। 
⦿ তৃতীয়তঃ টুম্যান নীতিতে রাষ্ট্রসংঘ অবহেলিত হয়েছিল। গ্রিস, তুরস্কের মতাে রাষ্ট্রগুলিকে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে সাহায্যদান করা যেত। 
⦿ চতুর্থতঃ টুম্যান ঘােষণা অনেকাংশে মার্কিন রাষ্ট্রপতির আগ্রাসী ও যুদ্ধবাদী মনােভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিল যা ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও সুস্থিতির পক্ষে ক্ষতিকর। সমালােচকদের অধিকাংশের
অভিমত হল ট্রম্যান নীতি যেমন অপ্রয়ােজনীয় ও অনাবশ্যক ছিল তেমনি এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে ঠান্ডা লড়াই-এ বাড়তি ইন্ধন জুগিয়েছিল।

রুশ বিরােধিতায় মার্কিন অস্ত্র ছিল এই নীতি। টুম্যান নীতি অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী মার্কিন সক্রিয়তার নীতি প্রকৃতিতে ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং একই সাথে এটি হয়ে উঠেছিল সাম্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর একটি রণকৌশল যা স্নায়ুযুদ্ধকে তীব্রতর হতে সাহায্য করেছিল। মনে রাখা প্রয়ােজন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
তার ঐতিহ্যবাহী মনরাে নীতি অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত অনেকাংশে বিচ্ছিন্নতার নীতি অনুসরণ করে চলেছিল। টুম্যান নীতি সেই পরম্পরামূলক ব্যবস্থার ওপর চিরতরে যবনিকা টেনে দিয়েছিল। যাইহােক, টুম্যান ডকট্রিন মার্কিন কংগ্রেসে দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত হলে কংগ্রেসের সদস্যরা এর মূল বক্তব্যের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। এই নীতিতে টুম্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী ভূমিকার কথা বলে মার্কিন জনগণেরও বিপুল সমর্থন লাভ করেন। অচিরেই মার্কিন বিদেশনীতির মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠল এই টুম্যান নীতি। হ্যানস্ মর্গ্যানথাের ভাষায়, “এই টুম্যান ডকট্রিন ক্রমে ঠান্ডা লড়াই-এর মেধাগত পুঁজি হয়ে উঠল।

টুম্যান অত্যন্ত সুকৌশলে তার বিবৃতির দ্বারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন বিদেশনীতির মূল সুরটিকে তুলে ধরলেন এবং জোরের সঙ্গে জানালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিহিত আছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার মধ্যে। তিনি আরও জানান, পৃথিবী বিভক্ত হয়েছে দুটি পরস্পরবিরােধী জীবনচর্যার মধ্যে এবং তাঁর মতে প্রয়ােজনে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে মার্কিনি জীবনচর্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তােলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অবৈধ নয়। কার্যত, টুম্যান নীতি অনুসারে মার্কিন কংগ্রেস গ্রিস ও তুরস্কের ক্ষমতাসীন সরকারকে সাহায্যের জন্য প্রভূত অর্থ মঞ্জুর করে। এই আর্থিক সহায়তা প্রদানও টুম্যান নীতির একটি বিশেষ দিক ছিল। গৃহযুদ্ধে দীর্ণ গ্রিস আর্থিক সহায়তা লাভের পাশাপাশি কমিউনিস্ট গেরিলাদের দমন করতে আমেরিকার কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র ও সমরােপকরণ সাহায্য স্বরূপ পেয়েছিল।
অনুরূপ ভাবে তুরস্কও একই সময়ে ৬০ মিলিয়ন ডলার মার্কিনি
সাহায্য লাভ করেছিল।

আমেরিকার টুম্যান নীতি দুটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে ছিল—(i) ইউরােপের ভূখণ্ডের বাইরে বিশ্বজুড়ে সােভিয়েত প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলা এবং (ii) সােভিয়েত শক্তিবলয়ের পাল্টা বিকল্প হিসেবে পশ্চিমি পুঁজিবাদী জোট গঠনের কাজে অগ্রসর হওয়া এই নীতির প্রয়ােগ দেখা গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল পরিকল্পনা’ (Marshall Plan) ঘােষণার মধ্য দিয়ে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে আমেরিকা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক সহায়তাদানের প্রকল্পের আড়ালে ডলার সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী
প্রসারের আয়ােজন করেছিল।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন