রচনাধর্মী- ২০২১ উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন = উত্তর সেট
তৃতীয় অধ্যায়ঃ- ঔপনিবেশিক আধিপত্যের প্রকৃতিবানিজ্য ক্ষেত্রে ক্যান্টন বন্দরের সুবিধা ও গুরুত্ব : চিন সরকার ক্যান্টন বন্দরকে উন্মুক্ত রাখার বিশেষ আগ্রহ । সমুদ্রের সহজ যােগাযােগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য বন্দরের তুলনায় ক্যান্টন বন্দরে নজরদারির সুবিধা, ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের সুবিধা ইত্যাদি। প্রথম আফিম যুদ্ধের শেষ (১৮৪২ খ্রি.) পর্যন্ত চলেছিল ‘ক্যান্টন বাণিজ্য। ক্যান্টন বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও কো-হং’ সংঘ : কো-হং’ নামে একটি বণিক ক্যান্টন বন্দরের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। এঁরা চিনা সম্রাটের অধীনস্ত ছিলেন। পণ্যের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা, বাজারের জিনিসপত্রের মূল্য স্থির করা, বিদেশী বণিকদের সাধারণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ‘কো-হং’ কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিদেশীরা পণ্য বিক্রয় বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাধ্য ছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্যে অন্যান্য বিবিধ শর্তাবলী :
ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান : অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে প্রথম আফিম যুদ্ধ (1842 খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত ক্যান্টনে চিন সরকার প্রবর্তিত বাণিজ্য ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরােপে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চরম বিকাশ লক্ষ করা যায়। অবাধ বাণিজ্য নীতির উদ্ভব বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চিন সরকারের নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করে তুলেছিল। আফিম ব্যাবসা এবং ব্যক্তিগত ও দেশীয় বাণিজ্যের মাধ্যমে ইংল্যান্ড ক্যান্টন বাণিজ্য ব্যবস্থার কার্যকারিতার অবসান ঘটায়।
উপসংহার : শিল্পবিপ্লবের পূর্বে ক্যান্টনের বাণিজ্য নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে চিন সরকার বিদেশি
বণিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু শিল্পবিপ্লব ও অবাধ বাণিজ্য নীতি এই পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দেয়। ফলস্বরূপ চিনের ওপর পাশ্চাত্য শক্তিগুলির বিশেষত ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
অসম চুক্তির বৈশিষ্ট্য গুলি কি ছিলো :
- চিনের সঙ্গে কোনাে আলােচনা ছাড়াই ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গুলি একতরফা ভাবে অসম চুক্তিগুলি আরােপ করেছিল। পশ্চিমি শক্তিগুলির কাছে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত চিনের ওপর এই অসম চুক্তিগুলি একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া হত। এক্ষেত্রে চিনের কোনাে অভিমত শোনা হতনা ।
- ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির দ্বারা আরােপিত বিভিন্ন অসম চুক্তি চিনের সার্বভৌমিকতায় আঘাত হানে। এই আঘাত সামলানাে চিনের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে চিনে ক্রমশ পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির ‘আধা উপনিবেশ’-এ রূপান্তরিত হয়।
- অসম চুক্তিগুলির মধ্য দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিধর রাষ্ট্র চিনের ওপর ভৌগােলিক আধিপত্য স্থাপন করতে থাকে। এর ফলে চিনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর তাদের সরকারের ক্ষমতা হ্রাস পায়। আর এই কারণে বিদেশি শক্তিগুলি সহজেই সেই দেশের দখলীকৃত অঞ্চলগুলিতে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে সক্ষম হয়।
- চিনের সঙ্গে বিদেশি শক্তিগুলির যুদ্ধের জন্য চিন কেই কেবলমাত্র দায়ী করা চলে না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি জোর করে যুদ্ধের সমস্ত দায়িত্ব চিনের ওপর চাপিয়ে দেয়। এর ফলে বিভিন্ন অসম চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ইউরােপীয় শক্তিগুলির হাতে তুলে দিতে চিন বাধ্য হয়।
- বিভিন্ন অসম চুক্তির কারণে চিন নিজ দেশের বিভিন্ন বন্দর বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়। যেমন—হংকং বন্দর ব্রিটেনের জন্য বা ম্যাকাও বন্দর পাের্তুগালের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে অসম চুক্তির জন্য বিদেশি শক্তিগুলি বাণিজ্য ছাড়া অন্যান্য সুবিধাও চিনের কাছ থেকে আদায় করেছিল।
- ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি চিনের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ওপর দখল ও লােলুপ দৃষ্টি থেকে চিনের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদও বাদ পড়েনি। সেই কারণে বিদেশি শক্তিগুলি বিভিন্ন অসম চুক্তি দ্বারা চিনের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ দখল করে নেয়। চিনের খনিজ সম্পদ জলপথে বিদেশে রপ্তানি করে ইউরােপীয় দেশগুলি নিজেদের অর্থনীতি ও শিল্পকে উন্নত করে।
- বিদেশি শক্তিগুলি চিনের সঙ্গে অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে বাণিজ্যিক শুল্কে ছাড় আদায় করে। চিনা বণিকরা তাদের সরকারকে ন্যায্য শুল্ক দিয়ে বাণিজ্য করলেও বিদেশি বণিকরা শুল্কে ছাড় পেত। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাের্তুগালের মতাে দেশগুলি অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারত।
উপসংহার : বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি চিনের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন অসম চুক্তি করেছিল। ইউরােপীয় শক্তিগুলির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যুদ্ধে চিনের পরাজয়ই এর প্রধান কারণ ছিল। বিংশ শতাব্দীর মধ্যপর্বে চিনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলে অসম চুক্তিগুলির গুরুত্ব হ্রাস পায়।
প্রশ্নঃ ভারতে রেলপথ প্রবর্তন এর উদ্দেশ্য এবং প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করো? **
ロ উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইংরেজরা তাদের নিজস্ব প্রয়ােজনেই ভারতে রেলপথ প্রতিষ্ঠাকরে। এ বিষয়ে লর্ড ডালহৌসির অবদান অনস্বীকার্য। 1853 খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে রেলপথ প্রবর্তনের উপযােগিতা সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করেন এবং তাঁকেই ভারতের রেলপথের জনক বলা হয় । তার উদ্যোগে ওই বছরের 16 এপ্রিল সর্বপ্রথম গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেল কোম্পানি বােম্বাই (মুম্বাই) থেকে থানে পর্যন্ত 21 মাইল দীর্ঘ রেলপথ চালু করে।
ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য : (1) ভারতের কল্যাণসাধন বা আধুনিকীকরণ রেলপথ স্থাপনের পিছনে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিক সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য ছিল। যেমন- ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের লগ্নির নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের দরুন ব্রিটিশ শিল্পপতিদের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত পুঁজি সঞ্জিত হতে থাকে। সেই উদ্বৃত্ত অর্থ লাভজনক বাণিজ্যে লগ্নি করার জন্য তারা উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে। তাই তারা সরকারকে ভারতে রেলপথ নির্মাণে চাপ দিতে থাকে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: সুবিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত যােগাযােগ স্থাপন, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক তদারকির জন্য পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির প্রয়ােজন ছিল। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর খাদ্য ও রসদ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত পৌছে দেওয়ারও প্রয়ােজন ছিল। বিশেষ করে 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর এই প্রয়ােজনীয়তা অধিক অনুভূত হয়েছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও এর কুপ্রভাবকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না। ড. সুমিত সরকার, ম্যাকফারসন প্রমুখ সকল দিক বিবেচনা করে ভারতে রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যিক এবং সামরিক উদ্দেশ্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ড. সব্যসাচী ভট্টাচার্য-এর মতে, রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতীয় অর্থনীতির আধুনিকীকরণ নয়, কোম্পানির লাভের আকাঙ্ক্ষাই প্রধান ছিল।
চতুর্থ অধ্যায়ঃ- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
প্রশ্নঃ মুসলিম সমাজের অগ্রগতিতে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এবং আলীগড় আন্দোলনের ভূমিকা আলোচনা করো? ***
- প্রথমতঃ অভিজাত শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে অবহেলা ছিল। আর অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছা ছিল না।
- দ্বিতীয়তঃ ভারতের মুসলমানরা ইংরেজকে সুনজরে দেখত না। তাদের চোখে ইংরেজ ছিল বিধর্মী মাত্র তাই তারা পাশ্চাত্য শিক্ষা থেকে দূরে থাকত।
ロ ইউরোপের নবজাগরণের প্রসঙ্গ এলেই ইতালির নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের নবজাগরণের সূচনা ঘটেছিল ইতালিতেই। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আলোকে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতের বিশেষত বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা ঘটেছিল। বাংলায় নবযুগের এই সূচনা ও বিস্তারকে ‘নবজাগরণ’ বলা হয় ।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই ঐতিহাসিকগণ ইউরোপীয় নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য সাপেক্ষে বাংলার নবজাগরণের তুলনামূলক আলোচনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ যেন উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দিক গুলো তুলে ধরেছেন, তেমনি অনেকে আবার বাংলা ও ইতালির নবজাগরণের বৈ-সাদৃশ্য গুলোর দিকে আলোকপাত করেছেন। ইটালির নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল সমাজ সংস্কার। ইতালির নবজাগরণ মধ্যযুগীয় অন্ধকার ও কুসংস্কার দূরীভূত করার দিশা দেখিয়েছিল। যা পরবর্তীকালে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। একইভাবে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল সমাজ সংস্কার। বাংলার নবজাগরণ চিরাচরিত প্রথা ও অন্ধ সংস্কারগুলির মূলে কুঠারাঘাত করেছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এই সকল ভ্রান্ত ধারণা গুলো ভাঙতে শুরু করে। পরবর্তী সময় এই ধ্যানধারণা ভারতের সর্বত্র বিস্তৃত হয়। ইতালির নবজাগরণে স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বিকাশ লক্ষ্য করা গিয়েছিল পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপের ইতালির মনীষীরা নিজেদের স্বাধীন চিন্তাধারার দ্বারা দেশের জনগণের মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলেন। একইভাবে রামমোহন রায় ,বিদ্যাসাগর প্রমূখ মনীষীরা বাংলায় নবজাগরণ যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়ে ছিল তবে এই সময়কার ছিল উনবিংশ- বিংশ শতাব্দীর । আলোচ্য সময়ে থেকে বাংলার জনগণের মনে যুক্তি মানবতা ও অনুসন্ধানী চিন্তাধারার বিকাশ ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
নবজাগরণের প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা:
ইতালির নবজাগরণ ব্যাপকতার দিক থেকে বাংলার নবজাগরণের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। ইতালির নবজাগরণে সে দেশের সমাজের সকল স্তরের মানুষ সার্বিকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়, ইতালিতে সূত্রপাত ঘটা এই নবজাগরণ কালক্রমে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
অপরদিকে, বাংলার নবজাগরণের মধ্যে সার্বিকতা লক্ষ্য করা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে অনেকেই বাংলার নবজাগরণকে সীমাবদ্ধ নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, বাংলার শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণির নবজাগরণে শামিল হয়েছিল এর পাশাপাশি এতে হিন্দুদের অবদান ছিল অধিক। তাই ড. অনিল শীল বাংলার নবজাগরণ কে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন' বলেছেন।
পঞদশ-যােড়শ শতাব্দীতে ইতালির নবজাগরণ আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তবে যে পরিবেশে ফ্লোরেন্স নগরীকে কেন্দ্র করে ইতালিতে নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল সেটি ছিল স্বাধীন এবং মুক্ত।
অপরদিকে, উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে বিকাশ ঘটা বাংলার নবজাগরণেও আধুনিক চিন্তাধারা লক্ষ করা যায়। তবে যে পরিবেশে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে বাংলার নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল সেটি ছিল পরাধীন এবং সীমাবদ্ধ। কারণ, তখন বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন।
ইতালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে গতিবেগ, উদ্যমতা প্রবাহ ছিল যথেষ্ট ইতিবাচক। আর ওই ইতিবাচক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। আর এসবের যােগ ফলস্বরূপ ইতালি নবজাগরণ স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক বিস্তার লাভ করে।
অপরদিকে, বাংলার নবজাগরণে গতির সার ঘটলেও তার প্রবাহ ছিল শ্লথ। ফলে ইতালির নবজাগরণের মতাে এখানকার নবজাগরণে গতিবেগ এবং উদ্যমতা ফারাক পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বাংলার নবজাগরণে বহুমুখী সৃজনশীলতার নিদর্শনও ছিল তুলনামূলক কম।
উপসংহার : এ কথা ঠিক যে, উনবিংশ শতাব্দী থেকেই পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যার ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের বিস্তার ঘটে। ইতালির নবজাগরণের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের পার্থক্য থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে পরিস্থিতি, পরিবেশগত পার্থক্য উভয়কে স্বতন্ত্র প্রদান করেছিল।
প্রশ্নঃ চিনের ৪ মে আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা করো? ***
ロ চীনের প্রতি জাপান সরকারের অপমানজনক 21 দফা দাবির বিরুদ্ধে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ মে পিকিংয়ের ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তোলেন এ আন্দোলন সাধারণভাবে ৪ মে আন্দোলন নামে পরিচিত।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে মিত্রশক্তি চিনের প্রতি অবিচার করলে চিনের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চিনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু-শিউ-র ডাকে-জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার ছাত্র ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে পিকিং-এর ‘তিয়েনআনমেন স্কোয়ার’-এ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা চিন থেকে বিদেশি শক্তির অপসারণ, সমস্ত অসম চুক্তি বাতিল, দেশদ্রোহীদের শাস্তি প্রভৃতি দাবি করে এবং জাপানি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানায়। বেশ কিছু ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করলে পিকিং-এর ছাত্ররা ধর্মঘটে শামিল হয়। ৪মে-র আন্দোলন ক্রমে চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে জাপানে পাঠরত চিনা ছাত্ররাও টোকিওর রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘জিউগুয়াে’ অর্থাৎ দেশ বাঁচাও।
৪ঠা মে-র আন্দোলনের গুরুত্ব : পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে চিনে যে সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তারই ফলশ্রুতি ছিল ৪ মে-র আন্দোলন। চাও সে-সুং মনে করেন যে কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা ও গভীরতার বিচারে ৪ মে র আন্দোলন ছিল চিনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। চিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন –
- (১) দেশাত্মবোধ ও আধুনিকতার উদ্ভব ও ৪ মে-র আন্দোলন কে কেন্দ্র করেই চিনে আধুনিকতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়। প্রথম পর্বে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি।
- (২) ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে চিন সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয় এবং আন্দোলনের চাপে সরকার বাধ্য হয়ে ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দেয় । ভার্সাই সন্ধি পত্রে স্বাক্ষর করবে না বলে ঘোষণা করে (২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রি.)।
- (৩) এই আন্দোলনের ফলেই চিনে কুয়ােমিনতাং দলের পুনর্গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে। জঁ-শ্যেনাে বলেন যে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চিনের শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় প্রবেশ করে।
- (৪) আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চিনে বহু বইপত্র ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটে।
পঞ্চম অধ্যায়ঃ- ঔপনিবেশিক ভারতে শাসন
প্রশ্নঃ ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট ও শর্তাবলী আলোচনা করো এই আইনের গুরুত্ব কী ছিল? ***
ロ 1919 খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি এই আইনে ভারতবাসীকে কোনাে প্রকার কার্যকারী শাসনক্ষমতা দেওয়া হয়নি। 1926 খ্রিস্টাব্দে ভারতবাসীও রাজনৈতিক কার্যকলাপ অনেকটা গতিশীল হয়ে ওঠে ওই বছরই মুসলিম লীগ, স্বরাজ্য দল সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করে। জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও ইংরেজ বিরােধী মনোভাবের তীব্রতা লক্ষ করা যায়। আলোচ্য সময়ে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে সংকট দেখা দেয়।
জাতীয় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ পদ্ধতি সম্পর্কে জাতীয় নেতৃত্বের মধ্যে মতভেদ ঘনীভূত হয় । তার কারণ হলো , গান্ধিজি ও তার অনুগামীরা দীর্ঘদিন ধরে আইন অমান্য আন্দোলন চালানোর পর সেটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী সদস্যরা কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন সেই মুহূর্তে সাধারণ ভারতবাসী মানসিকভাবে গণ আন্দোলন করতে প্রস্তুত নয় তাই আলোচ্য সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে লক্ষণীয়ভাবে একটি তৃতীয় শক্তি ও মতবাদের দ্রুত প্রসার ঘটেছিল সেটি ছিল সমাজতান্ত্রিক ধারা।
1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট ও শর্তাবলী : বড়লাট লর্ড উইলিংডন কঠোর হাতে আইন অমান্য আন্দোলন দমন করেন। পাশাপাশি তিনি এটাও উপলব্ধি করেন যে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারত সম্পর্কিত কোনাে সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হবে না। তাই কংগ্রেস বর্জিত তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক 1932 খ্রিস্টাব্দের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। এই শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য সংসদের এক যৌথ কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী 1935 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন গৃহীত হয়।
1935 খ্রিস্টাব্দের আইনের ধারা : 1935 খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের মূলত দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়। যথা— কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।
কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্র : কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল-
- (i) ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়, যার শাসনভার ভাইসরয় ও মন্ত্রীসভার ওপর অর্পিত হয়।
- (ii) কেন্দ্রীয় আইনসভার বিষয়গুলিকে সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। বৈদেশিক নীতি, দেশরক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি সংরক্ষিত বিষয়গুলোর ওপর ভারতীয় আইনসভা কোন ক্ষমতা ছিল না। অপরদিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়গুলি গভর্নর জেনারেল তা- মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে পরিচালনা করার দায়িত্ব পান।
- (iii) কেন্দ্রে দুই কক্ষ যুক্ত (নিম্নকক্ষ—ফেডারেল অ্যাসেম্বলি এবং উচ্চ কাউন্সিল অব স্টেটস) আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
- (iv) আইনসভা আহ্বান ও বাতিলের ক্ষমতা পান বড়ােলাট।
- (v) কেন্দ্রে একটি মন্ত্রীসভা গঠনের কথা বলা হয়।
- (vi) পুনা চুক্তি (1932 খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে মুসলিম ও তফসিল সদস্যদের পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : 1935 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে যে সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেগুলি হল-
- (i) 1935 খ্রিস্টাব্দের আইনে প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়।
- (i) প্রদেশের গভর্নর একটি মন্ত্রীপরিষদের সাহায্যে শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান।।
- (ii) স্থির হয় বাংলা, বিহার, অসম, মাদ্রাজ, বােম্বাই প্রভৃতি বৃহৎ প্রদেশগুলিতে দুই কক্ষযুক্ত আইনসভা।
- গঠিত হবে। উচ্চকক্ষের নাম হবে লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ও নিম্নকক্ষের নাম হবে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি।
- (iv) ছােটো প্রদেশগুলিতে এককক্ষযুক্ত আইনসভা রাখা হয়।
- (v) প্রদেশগুলোতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল তা তুলে দেওয়া হয়।
- (vi) মুসলিম ও তফসিল সদস্যদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
- (vii) 1935-এর ভারত শাসন আইনে প্রদেশ গুলিকে দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে মাত্রায়
- বোম্বাই, বাংলা, বিহার ও ওড়িশা সহ এগারোটি গভর্নর শাসিত প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া পাঁচটি প্রদেশ ছিল চিফ কমিশনের হাতে। কেবলমাত্র গভর্নর শাসিত প্রদেশ গুলোর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, 1935 খ্রিস্টাব্দের আইনে ভারতবাসীর সন্তুষ্ট হওয়ার মতাে কোনাে উপাদানই ছিল না। অথচ এই আইনের মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের বিভেদ সৃষ্টির বহু উপাদান লুকিয়ে ছিল। তাই বড়লাট লিনলিথগো লিখেছেন—আমরা মনে করি যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখার এটিই সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। তবে জাতীয় কংগ্রেস এই আইনকে যেমন সম্পূর্ণ হতাশাজনক’ বলেছে তেমনি মুসলিম লিগ এটিকে ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা ধ্বংসকারী’ বলে অভিহিত করেছে।
প্রশ্নঃ জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড প্রেক্ষাপট কি ছিল ? এই হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব আলোচনা করো? **
ロ 1919 খ্রিস্টাব্দে পাস হওয়া কুখ্যাত রাওলাট আইন ভারতের সমগ্র অঞলে বিশেষত পাঞ্জাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। রাওলাট আইন ও ব্রিটিশ সরকারের অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংঘটিত হয়। পাঞ্জাবের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারও চরম দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। এই নীতিরই নির্লজ্জ তম বহিঃপ্রকাশ ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই পাঞ্জাবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। ওই সময় এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল যা একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং সরকারি দমনপীড়নের তীব্রতাকে বহুগুণ বর্ধিত করে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি হিসেবে নিম্নলিখিত কয়েকটি ঘটনা খুবগুরুত্বপূর্ণ । পাঞ্জাবে লেফটেন্যান্ট গভর্নর হিসেবে নিযুক্তির পর থেকেই জেনারেল মাইকেল ও ডায়ার পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে পাঞ্জাব প্রদেশের মানুষদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, দেশীয় সংবাদপত্র গুলোর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করণ এবং অন্যান্য নানা দমনপীড়ন মূলক নীতির ফলে এক সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 1918 খ্রিস্টাব্দের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পাঞ্জাবের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেনারেল ডায়ারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির তীব্র নিন্দা করেন। তখন থেকেই তাঁরা এই নীতির বিরুদ্ধে বৃহওর গণ আন্দোলনের পরিকল্পনা নেন।
1919 খ্রিস্টাব্দে রাওলাট আইন পাস হলে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সমগ্র ভারতে এই প্রতিক্রিয়াশীল আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। বিশেষত গান্ধিজি প্রবর্তিত সত্যাগ্রহ আন্দোলন এই সময় প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পাঞ্জাবে এই আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। পাঞ্জাব থেকে বলপূর্বক সেনা ও অর্থ সংগ্রহ করা, ‘গদর’ বিদ্রোহ দমনের অজুহাতে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষকে পীড়ন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ইতোপূর্বে পাঞ্জাবের মানুষ বিক্ষুব্দ ছিল। রাওলাট আইন বিরোধী হরতাল বা সত্যাগ্রহ পাঞ্জাবে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পালিত হয়। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সরকারি দমনপীড়নের তীব্রতাও উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পায়। বিক্ষোভকারী নিরস্ত্র সত্যাগ্রহী ও ছাত্রদের মিছিলের ওপর পুলিশের তরফ থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। পাঞ্জাবের লাহোর ও কাসুর অঞলে পুলিশি অত্যাচার ব্যাপকভাবে পরিবর্ধিত হয়েছিল। অমৃতসরে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ আন্দোলন করার জন্য সত্যাগ্রহীরা পিপলস কমিটি গঠন করে।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার অমৃতসরের দুই জনপ্রিয় নেতা ড,সৈফুদ্দিন কিচলু ও ড ,সত্যপাল কে গ্রেফতার করে ঘটনাটি পাঞ্জাবের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে এবং অমৃতসরে হরতাল পালিত হয়। এই পরিস্থিতিতে জেনারেল ডায়ার পাঞ্জাবের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব লাভ করে প্রতিক্রিয়াশীল শাসনব্যবস্থাকে প্রায় চরম পর্যায়ে নিয়ে যান। অমৃতসরের শাসনভার সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যায়। এমতাবস্থায় 11 এপ্রিল সামরিক আইন জারি করে শহরের সমস্ত জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: ডায়ারের দমনমূলক নীতির প্রতিবাদে প্রায় দশ হাজার নিরস্ত্র মানুষ 1919 খ্রিস্টাব্দের 13 এপ্রিল বৈশাখী উৎসবের দিনে শান্তিপূর্ণভাবে অমৃতসরের পূর্বে অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগের এক সমাবেশে যোগদান করে। সেই সময়ই জেনারেল ডায়ার বিরাট বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে কোনাে সতর্কবার্তা ছাড়াই সমাবেশকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানাের নির্দেশ দেন। উঁচু প্রাচীর ঘেরা স্থানটিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ খুব সরু হওয়ায় বের হবার পথ না থাকার কারণে সেখানে সেনাবাহিনীর গুলিতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে ছিল বহু শিশু, নারী ও বৈশাখী উৎসবে যোগ দিতে আসা গ্রামের মানুষ। সরকারি হিসাব অনুসারে মৃতের সংখ্যা ছিল 379 ও আহতের সংখ্যা এক হাজারের বেশি। কিন্তু প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা ছিল সরকারি হিসাবের থেকে অনেক বেশি।
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া: জালিয়ানওয়ালাবাগের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরও পাঞ্জাবের মানুষের ওপর ব্রিটিশ সামরিক শাসন ও দমনমূলক নীতি অব্যাহত ছিল। দৈহিক শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাও ছিল খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনা ভারতের ব্রিটিশ সরকার বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। এই নারকীয় ঘটনাটি ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ গান্ধিজি, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ক্ষোভ ও ধিক্কার জানান। এই ঘটনার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। চার্চিল, হার্বাট এসকুইথ প্রমুখ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁদের মতে এই ঘটনা ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক ও নজিরবিহীন।
পরিশেষে দেখা যায় যে , কংগ্রেসের তরফ থেকেও এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানাে হয়। গান্ধিজি উপলব্ধি করেন যে এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব। পাশাপাশি তিনি এও উপলব্ধি করতে বাধ্য হন যে দেশবাসী এখনও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে 1919 খ্রিস্টাব্দের 18 এপ্রিল তিনি আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।