রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি

 

⦿ রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি : দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যেসব উগ্র সাম্রাজ্যবাদী একনায়কের আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইটালির মুসােলিনি, জার্মানির হিটলার এবং জাপানের তােজো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে ‘রােম- বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি’ নামে এক মৈত্রীজোট গড়ে ওঠে।

জার্মান শাসক হিটলারের শক্তিবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে ইটালির শাসক মুসােলিনি ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তােলেন। কিন্তু হিটলার উপলব্ধি করেন যে, জার্মানি ভবিষ্যতে অস্ট্রিয়া দখলের উদ্যোগ নিলে ইটালির সমর্থন তাঁর বিশেষ প্রয়ােজন। মুসােলিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ করলে হিটলার তাঁকে সমর্থন করেন। ফলে মুসােলিনি ও হিটলারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। মুসােলিনি ও হিটলারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে উভয়ের মধ্যে মিত্রতা (অক্টোবর, ১৯৩৬ খ্রি.) গড়ে ওঠে। ইটালি ও জার্মানির মধ্যে স্থাপিত এই মিত্রতা ‘রােম-বার্লিন অক্ষচুক্তি’ নামে পরিচিত

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে জার্মানি ও জাপানের মধ্যে সাম্যবাদ-বিরােধী অ্যান্টি- কমিন্টার্ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জার্মানি ও জাপানের অ্যান্টি-কমিন্টার্ন জোটে ইটালি যােগ (৬ নভেম্বর, ১৯৩৭ খ্রি.) দিলে ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তি’ মৈত্রীজোট গড়ে ওঠে। ইটালি, জার্মানি ও জাপানের মধ্যে গড়ে ওঠা জোটের নামকরণে ‘অক্ষ’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন মুসােলিনি
রােম-বার্লিন-টোকিও অক্ষচুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে.....এই জোটের কোনাে রাষ্ট্র চতুর্থ কোনাে রাষ্ট্রের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা একে অন্যকে সহায়তা করবে এবং এই চুক্তির স্থায়িত্ব হবে ১০ বছর।

⦿ মিউনিখ চুক্তি (Munich-Agreement 1938) : অস্ট্রিয়া দখলের (১৯৩৮ খ্রি.) পর চেকোস্লোভাকিয়ার প্রতি হিটলারের কুনজর পড়ে। শিল্পসমৃদ্ধ ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ চেকোস্লোভাকিয়া দখলে হিটলার তৎপর হয়ে উঠলে ইউরােপে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চেকোস্লোভাকিয়ায় অবস্থিত জার্মান জাতি-অবস্থানরত সুদেতন অঞলে হিটলারের প্ররােচনায় দাঙ্গা- হাঙ্গামা শুরু হয়। সুদেতন এ বসবাসকারী জার্মানদের স্বার্থরক্ষার্থে হিটলার চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন।
যুদ্ধ প্রস্তুতির মধ্যেই হিটলারের মিত্র ইটালির শাসক মুসােলিনির মধ্যস্থতায় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ২৯ সেপ্টেম্বর মিউনিখ শহরে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইটালির মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা  'মিউনিখ চুক্তি’ নামে পরিচিত

মিউনিখ চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে—
◕ সুদেতন  অঞল জার্মানিকে দিয়ে দেওয়া হবে
◕ অবশিষ্ট চেকোস্লোভাকিয়ার সার্বভৌমত্ব হিটলার মেনে নেবেন

মিউনিখ চুক্তির দ্বারা চেকোস্লোভাকিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করেও হিটলার সন্তুষ্ট ছিলেন না। চুক্তির ৬ মাসের মধ্যেই চুক্তি ভঙ্গ করে (১৯৩৯ খ্রি. ১৫ মার্চ) অবশিষ্ট চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করেন।

⦿ রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি (১৯৩৯ খ্রি.) : নাৎসি শাসক হিটলার যেমন কমিউনিস্ট-বিরােধী ছিলেন
তেমনি কমিউনিস্ট শাসক স্ট্যালিনও তীব্র নাৎসি-বিদ্বেষী ছিলেন। হিটলার এবং স্ট্যালিনের মধ্যে বিরােধ থাকা সত্ত্বেও বিশেষ পরিস্থিতিতে উভয়ের মধ্যে মিত্রতা স্থাপিত হয়। পােল্যান্ড আক্রমণ করতে গিয়ে
একই সঙ্গে পূর্ব সীমান্তে রাশিয়া এবং পশ্চিম সীমান্তে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে বলে হিটলার আপাতত রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের  দ্বারা পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করেন।

সাম্যবাদ-বিরােধী ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির সঙ্গে জোট গঠনে ব্যর্থ হয়ে রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার প্রয়ােজনে জার্মানির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হয়। রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ২৩ আগস্ট রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলােটভ এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ

রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে, রাশিয়া ও জার্মানি- 
◕  শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজেদের মধ্যে বিবাদের মীমাংসা করবে
◕ পরবর্তী ১০ বছর একে অপরকে আক্রমণ করবে না
◕  তৃতীয় কোনাে শক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে কেউ তৃতীয় পক্ষকে সহায়তা করবে না
◕ পােল্যান্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে

রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি সত্ত্বেও হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চুক্তি ভঙ্গ করে ১৯৪১
খ্রিস্টাব্দে ২২ জুন রাশিয়া আক্রমণ করেন।

⦿ পার্ল হারবারের ঘটনা :- পার্ল হারবার হল প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপে অবস্থিত একটি বন্দর। এখানে আমেরিকা তার নৌঘাঁটির স্থাপন করেছিল। ইউরােপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সুযােগে এশীয় রাষ্ট্র জাপান প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে আগ্রাসী নীতি প্রয়ােগ করে। আমেরিকা এই আগ্রাসনের বিরােধিতা করলে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

জাপানের আগ্রাসী নীতির ফলে আমেরিকা জাপানের সঙ্গে পুরােনাে বাণিজ্যিক চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। জাপানে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যসহ বেশ কয়েকটি পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। আমেরিকায় অবস্থিত জাপানি সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, এসব ঘটনায় জাপান ক্ষুদ্ধ হয়। জাপান খনিজ তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণ ইন্দোচিন দখল (১৯৪১ খ্রি.) করে নিলে জাপানের সঙ্গে আমেরিকা সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এরপর চিন ও ইন্দোচিন থেকে জাপানি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায়। আমেরিকার এই দাবি জাপান প্রত্যাহার  করলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর সকালে বিশাল নৌবহর ও ৩৩৫টি যুদ্ধবিমান নিয়ে ভাইস অ্যাডমিরাল নােগুচির নেতৃত্বে আমেরিকার নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে বোমা বর্ষণ শুরু করে এবং এখান  কার মার্কিন নৌঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। এটি  পার্ল হারবারের ঘটনা নামে পরিচিত। পার্ল হারবারের ঘটনার
পরদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষতা নীতি ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যােগ দেয়। ফলে প্রাচ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন