2022 H.S West Bengal Board Final History Suggestion Question
➧ উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন প্রশ্ন :
☞ অধ্যায়ঃ অতীতকে স্মরণ
Q1. জাদুঘর বা (মিউজিয়াম) কাকে বলে? অতীত পুনর্গঠনে জাদুঘরের ভূমিকা লেখ?
Q2. মিথ (উপকথা) ও লিজেন্ড (পুরাকাহিনি) বলতে কী বােঝাে? অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে কীভাবে রুপদান করে?
Q3. অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি বা মিথ এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা লেখ?
☞ অধ্যায়ঃ উপনিবেশিক কর্তৃত্বের প্রকৃতি
Q1. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও?
Q2. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল আলোচনা করো?
Q3. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাব সিরাজদৌলার সম্পর্ক?
Q4. ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য লেখ ? এই বাণিজ্য বন্ধ বা অবসান হয় কেন?
☞ অধ্যায়ঃ- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
Q1. চিনে ৪ঠা মে-র আন্দোলনের উত্থান ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করাে।
অথবা, চিনে ৪ঠা মে আন্দোলনের কারণ ও প্রভাব লেখ?
Q2.বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলোচনা করো?
Q3. সমাজসংস্কারক রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?
অথবা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক কার্যাবলি উল্লেখ করাে।
Q4. সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান কী ছিল?
Q5. আলীগড় আন্দোলন সম্পর্কে যা জানো লেখ?
☞ অধ্যায়ঃ- ঔপনিবেশিক ভারতে শাসন
Q1. মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন কি? এর বৈশিষ্ট্য বা শর্ত লেখ?
Q2.পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও প্রেক্ষাপট আলোচনা করাে?
অথবা, ৫০-এর মন্বন্তর তৎকালীন ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে কী প্রভাব ফেলেছিল?
Q3. মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে। ঐ মামলাটির গুরুত্ব বা পরিণতি কী হয়েছিল ?
অথবা,মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট ও পরিণতি বর্ণনা করাে?
Q4. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট কী ছিল? এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও এবং ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করাে?
Q5. ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এর পটভূমি ব্যাখ্যা করাে?
অথবা, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মলে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইনের পটভূমি উল্লেখ করাে। এই আইনের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলি কী ছিল?
Q6. লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্ত ও গুরুত্ব আলোচনা করো?
☞ অধ্যায়ঃ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও উপনিবেশসমূহ
Q1. ভারতের মুক্তিসংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা কী ছিল?
Q2. ভারতে ক্রিপস্ মিশন আসার কারণ কী ছিল? ক্রিপস্ মিশন কেন ব্যার্থ হয়েছিলো আলোচনা করো?
Q3. হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করো?
অথবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দাও।
Q4. ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়াে আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখাে।
অথবা, ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলনের কারণ কী ছিল? এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।
Q5. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলােচনা করাে?
অথবা, নৌবিদ্রোহ কোথায় শুরু হয়েছিল? এই বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
➧ উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন বড়ো প্রশ্নের উত্তর :
Q1. জাদুঘর বা (মিউজিয়াম) কাকে বলে? অতীত পুনর্গঠনে জাদুঘরের ভূমিকা লেখ?
➺সাধারণ অর্থে জাদুঘর হলাে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের সংগ্রহশালা, যেখানে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্প-বিষয়ক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন সংরক্ষণ করে তা জনসাধারণের উদ্দেশ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এক কথায়, বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করে সেগুলি যেসব প্রতিষ্ঠান বা ভবনে সংরক্ষণ করে রাখা হয় সেসব প্রতিষ্ঠান বা ভবনকে জাদুঘর বলে।
☉ জাদুঘরের ভূমিকা : বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন প্রকারের মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।মিউজিয়াম গুলি অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতাে বহু বিষয়ে উদ্দেশ্যসাধন করে। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিউজিয়ামগুলি পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে ভূমিকা পালন করছে। মিউজিয়ামের কাজ দুষ্প্রাপ্য পুরাতত্ত্ব থেকে মানবসভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে বস্তুসামগ্রী এখন পরিবেশে দেখা যায় না সেগুলি এবং অদ্যাবধি পারিপার্শ্বিক পরিবেশে দেখা যায় এমন বস্তুসামগ্রী গুরুত্ব সহকারে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
এই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে ইতিহাসের সংগ্রহশালা হিসাবে মিউজিয়াম ভূমিকা পালন করে। ওই বস্তুসামগ্রীর ওপর গবেষণা, ব্যাখ্যা দ্বারা শিক্ষা ও চর্চার ধারা অব্যাহত রাখতে মিউজিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। জাতীয় ও নাগরিক জীবনের সংরক্ষণ ছাড়াও শিক্ষা ও গবেষণার অনুপ্রেরণা মিউজিয়াম গুলি। মিউজিয়ামগুলির সংগ্রহের বৈচিত্র্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাসের বিষয় ছাড়াও বিশেষ কাজ, ব্যক্তিজীবন, ধর্ম, জীববৈচিত্র্য, খনি, জাহাজ, পরিবহণ ইত্যাদি মিউজিয়ামের সংগ্রহে স্থান পেয়েছে। কোনাে সময়ের সমগ্র জীবনকে ধরার প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। সমাজ তার অতীতকে জানতে চায়। তার ঐতিহ্যকে জানতে চায়। তার অতীত জেনে পুলকিত ও শিহরিত হয়। কিন্তু অতীত সম্পর্কে অনেক বিষয়ে নীরবতা, বিচ্ছিন্নতা বা অনেক কিছুর অনুপস্থিতি মানুষকে অসুবিধায় ফেলে। এই অসুবিধা দূর করতে সাহায্য করে মিউজিয়াম। শুধু অতীতকে ধরে রাখাই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভাবতে ও অতীতকে বুঝতে সাহায্য করে মিউজিয়াম। বা জাদুঘর গুলি। এক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
Q2. মিথ (উপকথা) ও লিজেন্ড (পুরাকাহিনি) বলতে কী বােঝাে? অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে এরা কীভাবে রুপদান করে?
☉ মিথ বা উপকথা : গ্রিক শব্দ 'Muthos' থেকে 'Myth' শব্দটি এসেছে। প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা বা কাহিনি রচনা করে এবং পরবর্তী সময় প্রজন্মাব্যাপী সেগুলি প্রচারিত হতে থাকে। এগুলিকেই বলা হয় মিথ বা উপকথা। শুধু ভারতই নয়, চিন, ব্যাবিলন, মিশর প্রভৃতি দেশেও পৌরাণিক কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। উপকথার প্রধান চরিত্রগুলি মূলত দেবদেবীকেন্দ্রিক এবং অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। পৌরাণিক কাহিনিগুলি ধর্মকেন্দ্রিক হওয়ায় পূজা, প্রার্থনা, লােকাচার প্রভৃতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে উপকথা।
☉ লিজেন্ড বা পুরাকাহিনি : কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে কল্পকাহিনি বা বীরগাথা বিভিন্ন দেশে প্রচলিত তাকে লিজেন্ড বা পুরাকাহিনি বা কিংবদন্তি বলা হয়। 'Legend' কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ 'Legenda' থেকে। বেশকিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, মানবসমাজে ইতিহাসবােধ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই এই সকল কাহিনিগুলি গড়ে উঠতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পাশ্চাত্যের প্রােটেস্টান্টগণ প্রথম কিংবদন্তি শব্দটির ব্যবহার করেন বাল অনেকে মনে করেন। কোনাে ঘটনার গুরুত্ব বােঝানাের জন্য তারা এটি করতেন বলে জানা যায়। যেমন—ভারতবর্যে মৌর্য সম্রাট অশােক রানি পদ্মিনী, মীরাবাই, রানি দুর্গাবতী, শিবাজি প্রমুখকে কেন্দ্র করে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
☉ অতীত বিষয়ের রূপদানে উপকথা ও পুরাকাহিনির ভূমিকা :
(i) ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্রে : উপকথা ও পুরাকাহিনিগুলি অনেকাংশেই কল্পনানির্ভর হলেও এগুলি
থেকে ঐতিহাসিক উপাদানের সুত্র পাওয়া যায়। যেমন—গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনি থেকে প্রাপ্ত উপাদানগুলির সূত্র ধরে ট্রয় নগরী বা ট্রয়ের যুদ্ধের কথা জানা যায়। আবার, ভারতে প্রচলিত মৌর্য সম্রাট অশােক, রানি দুর্গাবতী, মীরাবাই, ফ্রান্সের লুই নেপােলিয়ান সম্পর্কে প্রচলিত পুরাকাহিনি তাদেরকে যেমন জাতীয় বীরের মর্যাদায় উন্নীত করে, অপরদিকে তেমনি এঁদের রাজত্বকালের কিছু তথ্য সম্পর্কেও আলােকপাত করে ইত্যাদি। (ii) সময়কাল ও বংশতালিকা নির্মাণ : উপকথা ও পুরাকাহিনিতে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার তুলনামূলক আলােচনার মাধ্যমে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনাবলির আনুমানিক সময়কাল জানা যায়। এ ছাড়া উপকথা ও পৌরাণিক কাহিনি থেকে বিভিন্ন প্রাচীন রাজবংশের রাজাদের নাম ও শাসনকাল সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। (iii) বিশ্বজনীনতা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পুরাকাহিনি এবং উপকথা থেকে বিশ্বজনীনতার আভাস পাওয়া যায়। বিশ্ব সৃষ্টি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি ঘটনাবলির আভাসও এই কাহিনিগুলি প্রদান করে থাকে।
উপসংহার : সামগ্রিক আলােচনার সাপেক্ষে বলা যায়, পুরাকাহিনি তথা উপকথাগুলি কল্পকাহিনি নির্ভর হলেও প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আবার, অতীতকে জানতে বা বুঝতে গেলে মিথের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। সামগ্রিক দিক দিয়ে মিথ এবং লিজেন্ড বা পুরাকাহিনি থেকে আর্থ -সামাজিক তথা রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাযায়।
Q3. অতীত বিষয়ে মানুষের ধারণাকে স্মরণ করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি বা মিথ এবং স্মৃতিকথার ভূমিকা লেখ?
➺ পৌরাণিক কাহিনিগুলির কতটা বিষয়বস্তু ঐতিহাসিকভাবে ঠিক বা ভুল, অর্থাৎ সত্য বা মিথ্যা, তা যাচাই করা খুবই কঠিন কাজ। আজকাল বহু ক্ষেত্রেই পৌরাণিক কাহিনির ঘটনা গুলিকে ঐতিহাসিক ভাবে ভিত্তিহীন বলে অনেকে অভিমত দিয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও বর্তমানকালে মানবসংস্কৃতি ও ধর্মের ইতিহাসে এসব পৌরাণিক কাহিনি বা মিথগুলির বিশেষ গুরুত্ব অনেকেই স্বীকার করে নিয়েছেন।সত্য ঐতিহাসিক উপাদান ও পৌরাণিক কাহিনিগুলিতে অতীত ইতিহাসের বহু সত্য ও যথার্থ উপাদান লুকিয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনিগুলিকে তাদের ‘দেবতা, পূর্বপুরুষ এবং বীরপুরুষ'-এর গল্প বলে মনে করা হয়। প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনির সূত্র ধরেই আধুনিককালে ট্রয় নগরী ও ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।
বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনিতে প্রাচীন মানবসংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন গল্প বহু যুগ অতিক্রম করে বর্তমান কালেও প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীন সেই সংস্কৃতি থেকে যে সময় আধুনিক মানব সংস্কৃতির উৎপত্তি হয়েছে বলে তারা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয় যে, প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনির গল্পে তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যেসব কাহিনি প্রচলিত রয়েছে সেগুলি সত্য।
☉ কিংবদন্তির গুরুত্ব : মৌখিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে কিংবদন্তিগুলির গুরুত্ব হলাে— আনন্দদান কিংবদন্তির ঘটনাগুলি অতীত কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হায়ে লােক সমাজকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। কিংবদন্তিতে আনন্দদায়ক উপাদান আছে বলেই এগুলি বংশপরম্পরায় বর্তমান কালে এসে পৌঁছেছে। সেই সূত্রেই কিংবদন্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র বর্তমানে আমরা জানতে পারি। শিক্ষাদান ও বর্তমানকালের মানুষকে কিংবদন্তির ঘটনাগুলি অতীতের নৈতিকতা, বীরত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে। এগুলি থেকে বর্তমানকালের মানুষ নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করতে পারে এবং জীবনে চলার পথে সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে। ঐতিহাসিক ভিত্তি কিংবদন্তির কাহিনি রূপকথার কাহিনির মতাে সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। বহু ক্ষেত্রেই কিংবদন্তির কাহিনিগুলির একটি বাস্তব ভিত্তি আছে। বাংলার কিংবদন্তি চরিত্র রঘু ডাকাতের কালী পুজোর ভিত্তিতে আজও একটি কালী মন্দিরকে চিহ্নিত করা হয়। তাই কিংবদন্তি থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি যথার্থ ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া সম্ভব।
☉ মিথ এবং স্মৃতিকথার গুরুত্ব : প্রাচীনকালে মানুষ বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা বা কাহিনি রচনা করে এবং পরবর্তী সময় প্রজন্মাব্যাপী সেগুলি প্রচারিত হতে থাকে। এগুলিকেই বলা হয় মিথ বা উপকথা।স্মৃতিতে প্রতিটি মানুষের অতীত অভিজ্ঞতা লুকিয়ে থাকে। সেগুলি সে লিখে রাখতে পারে বা পরবর্তী কালে কাউকে জানাতে পারে। এই লিখিত স্মৃতি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তি স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন। সেক্ষেত্রে স্মৃতিকথাতে কিছু ভ্রান্তি লক্ষ করা গেলেও এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। ইতিহাস রচনায় এই অতীত স্মৃতিচারণের গুরুত্ব ঐতিহাসিকদের কাছে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে Annal Historian-দের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। জার্মানিতে হিটলারের নাতসি বাহিনীর বর্বরতা বা ভারতবর্ষে দেশভাগ পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সমস্যার অপেক্ষাকৃত বাস্তবমুখী চিত্র অন্য উপাদানের পরিবর্তে স্মৃতিকথা থেকে বেশি ভালােভাবে জানা গেছে।
☞ অধ্যায়ঃ উপনিবেশিক কর্তৃত্বের প্রকৃতি
Q1. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও?
➺ দেওয়ানি লাভের পর ব্রিটিশ কোম্পানীর (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী) দ্বারা ভূমিরাজস্ব ক্ষেত্রে নিযুক্ত নায়েব রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের বেপরােয়া রাজস্ব আদায়ে কৃষকদের চরম শােচনীয় অবস্থা হয়। শােষণ ও অনাবৃষ্টির পরিণতিতে ঘটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও মহামারি, যা বাংলার ইতিহাসে ৭৬-এর মন্বন্তর নামে খ্যাত (১৭৭০ খ্রি.)। এর ফলস্বরূপ ভূমিরাজস্ব ক্ষেত্রে নানাধরণের চিন্তাভাবনা ও বন্দোবস্ত শুরু হয় সেগুলি হল—
(i) ওয়ারেন হেস্টিংস-এর পাঁচশালা বন্দোবস্ত : গভর্নর পদে নিযুক্ত হয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস দেশীয় দেওয়ান দুজনকে বরখাস্ত করে গঠন করেন ভ্রাম্যমান কমিটি। এই কমিটির সুপারিশে 'কালেক্টর' নামে ইংরেজ কর্মচারীর হাতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন এবং ভূমিরাজস্ব তত্ত্বাবধানের জন্য গঠন করেন রাজস্ব বাের্ড। এর পর নিলামের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য যে বন্দোবস্ত করেন তার নাম পাঁচশালা বন্দোবস্ত।
(ii) একসালা বন্দোবস্ত : পাঁচশালা বন্দোবস্ত সফল হয়নি। এর বিষময় কুফলে, কৃষক-সমাজ সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই ব্যবস্থায় জমির উন্নয়নও হয়নি। একশ্রেণির লােক এই ব্যবস্থাকে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি -তে দাঁড় করিয়ে দেয়। ফলে নতুন করে ভূমিরাজস্ব ক্ষেত্রে শুরু হয় ‘একলা বন্দোবস্ত (১৭৭৭)। এই ব্যবস্থা চলে ১৭৯০ খ্রি. পর্যন্ত। একবছর মেয়াদী এই বন্দোবস্ত ও ব্যর্থ হয়। শুরু হয় আবার নতুন চিন্তাভাবনা।
(iii) কর্নওয়ালিস-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ খ্রি. গভর্নর পদে যােগ দিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানের পর দেশীয় জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য একটি বন্দোবস্ত করেন, যা ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষের অনুমােদন পেলে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবে। কর্নওয়ালিস মনে করেন—চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলে জমিদারগণ প্রজাদের সুখ-সুবিধার দিকে নজর দিতে পারবেন। পারিষদ-সদস্য জন শাের-এর সঙ্গে মতপার্থক্য হলেও কর্নওয়ালিসের মত-ই সমর্থিত হয়। সেই অনুযায়ী দশ বছর মেয়াদি বন্দোবস্তকেই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বলে ঘােষণা করেন (২২ মার্চ ১৭৯৩ খ্রি.) কর্নওয়ালিস।
(iv) আলেকজান্ডার রীড ও টমাস মনরাে-র উদ্যোগে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত : ১৭৯২ খ্রি. ইংরেজ কোম্পানী ‘বড়ােমহাল’ দখল করে এবং সেখানকার স্থানীয় বন্দোবস্ত সম্পর্কে পরিচিত হয়। পরবর্তী কালে এখানকার এই বন্দোবস্ত আরও কিছু পরিবর্তনসহ ‘রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত’ নামে চালু করা হয়। এক্ষেত্রে আলেকজান্ডার রীড ও স্যর টমাস মনরাে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এই ব্যবস্থায় কৃষকরা সরকারকেই সরাসরি রাজস্ব দিত। তবে, এই ব্যবস্থায় কৃষকের জমির ওপর কোনাে মালিকানা স্বত্ব ছিল না, শুধুমাত্র চাষ করার অধিকার ছিল। প্রথমে বড়ােমহাল, তারপর কর্ণাটক ও বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু হয়। এই বন্দোবস্ত ২০/৩০ বছরের জন্য দেওয়া হয়।
(iv) হােন্ট ম্যাকেঞ্জির সুপারিশে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত : গাঙ্গেয় উপত্যকা, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও মধ্যভারতের একাংশে ‘মহলওয়ারি বন্দোবস্ত’ চালু হয় (১৮২২ খ্রি.)—ইংরেজ কোম্পানীর পর্যবেক্ষক হােল্ট ম্যাকেঞ্জির সুপারিশে। এই ব্যবস্থায় সমষ্টিগতভাবে এক বা একাধিক গ্রামের সমষ্টির সঙ্গে রাজস্ব বন্দোবস্ত হয়। এই সমষ্টির নাম ‘মহাল’। গ্রাম-প্রধান বা মহালের একটি গােষ্ঠীর ওপর জমি বন্টন ও রাজস্ব আদায়ের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের পর আবার নতুন হারে বন্দোবস্ত নিতে হত। মােট উৎপাদনের ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ রাজস্বের হার ছিল। এখানেও বন্দোবস্ত দেওয়া হত রায়তওয়ারি'-র মতাে ২০/৩০ বছর।
উপসংহার : ব্রিটিশ শাসনকালে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলা তথা ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ। আর্থিক ব্যবস্থার অনেকটাই নির্ভর করতে কৃষিজমির বা চাষবাসের ওপর। মুঘল আমলে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা মােটামুটি স্থিতিশীল ছিল। কারণ, কৃষকদের অনুকূলেই ছিল সেই ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানীর সবচেয়ে বেশি ‘রাজস্ব আদায়ের লােভ—এই ব্যবস্থার ওপর এক চরম আঘাত করে। যার পরিণতিতে ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মহামারি আরও সব ভয়ংকর ঘটনা কৃষকসমাজ প্রাণান্ত পরিশ্রম করেও ধ্বংসমুখী হয়। অত্যাচার অবিচারে সর্বস্বান্ত হয় কৃষক। তবে, ইংরেজ কোম্পানী, ভূমিরাজস্ব সম্পর্কিত নানা প্রচেষ্টার সার্বিক উন্নয়ন করতে না পারলেও ধাপে ধাপে একটা সুবন্দোবস্তের দিকে এগিয়ে গেছে।
Q2. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল আলোচনা করো?
➺ লন্ডনের পরিচালক সভা আশা প্রকাশ করে যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পের অগ্রগতি ঘটবে এবং কৃষকশ্রেনি সুখ ও সম্পদের অধিকারী হবে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বস্তুত চিরস্থায়ী ব্যবস্থার কিছু তাৎক্ষণিক সুফল ছিল এবং এর ফল ভােগ করেছিল বিদেশি ইংরেজ ও তাদের তাবেদার কিছু বিত্তবান জমিদার। কিন্তু কুফলের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। আর সেই ভার বহন করতে হয়েছিল মূলত বাংলার কৃষক সমাজকে।
☉ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল : (i) এদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল। মার্শম্যান বলেছেন, “It was a Bold, brave and wise measure" এই ব্যবস্থার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রাজনীতি রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ ও তা আদায়ের ব্যবস্থা নির্দিষ্ট হয়। (ii) আয়ব্যয়ের হিসাব ও রাজস্ব-আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ফলে সরকারের পক্ষে হিসাব প্রস্তুত করা সহজ হয়। তারা নানা সংস্কারমূলক কাজেও মনােযােগী হন। (iii) সামাজিক ক্ষেত্রে জমির স্থায়ী মালিকানা মালিকানা পাওয়ার ফলে কোনাে কোনাে জমিদার জমির উন্নতি করার উদ্যোগ নেন।
☉ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল অপেক্ষা কুফল ছিল অনেক বেশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : (i) অধিক রাজস্ব হার: জমি জরিপ না করে এবং জমির গুণাগুণ বিচার না করেই রাজস্বের পরিমাণ ধার্য করা হয়েছিল। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজস্বের হার ছিল বেশি। (ii) কৃষকদের দুরবস্থা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিল কোম্পানির সঙ্গে জমিদারদের। এই বন্দোবস্তে কৃষকদের ন্যায় অধিকার ও স্বার্থরক্ষার কোনাে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কর্নওয়ালিশ আশা করেছিলেন যে, জমিদাররা স্বেচ্ছায় কৃষকদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু জমিদাররা কৃষকের ওপর ইচ্ছামতাে রাজস্ব চাপিয়ে দেন এবং খেয়ালখুশিমতাে কৃষকদের জমি থেকে বিতাড়িত করতে শুরু করেন। এইভাবে কৃষকশ্রেণি দুরবস্থার শেষ সীমায় এসে পৌঁছােয়। (iii) সামাজিক ক্ষেত্রে জমিদারির অবসান: জমিদার ভারতে ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ও তার ফলাফল নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব জমা না দিলে ‘সূর্যাস্ত আইন’-এ জমি বাজেয়াপ্ত করে তা নিলাম করা হত। এর ফলে বহু কৃষক জমিদার তাদের জমিদারি হারান। (iv) কৃষকদের জমি থেকে উৎখাত : সরকার ১৭৯৯-এ ৭ নং রেগুলেশন জারি করে রাজস্ব প্রদানে অক্ষম চাষিদের জমি থেকে উৎখাত করার অধিকার জমিদারদের হাতে তুলে দেয়। এই আইনের সুযােগে জমিদাররা সামান্য কারণে বহু কৃষককে উৎখাত করে। তাই সিরাজুল ইসলাম এই আইনকে ব্রিটিশ ভারতের প্রথম কালাকানুন বলে সমালােচনা। করেছেন। (v) কৃষির বাণিজ্যকরণ : অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে জর্জরিত কৃষকশ্রেণি মহাজনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। ঋণ-ফেরত নিশ্চিত করার জন্য মহাজনরা কৃষকদের অর্থকরী ফসল, যেমন—নীল, পাট, তুলাে ইত্যাদি চাষ করতে বাধ্য করে। এইভাবে কৃষির বাণিজ্যকরণ (Commercialization of Agriculture) ঘটে। পরিণামে কৃষকের খাদ্যাভাব প্রকট হয়।
উপসংহারঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কৃষকদের পক্ষে ছিল ক্ষতিকারক। কৃষকদের দুঃখদুর্দশা মােচনের জন্য সরকার কয়েকটি আইন চালু করলেও কৃষকদের দুঃখদুর্দশার অবসান হয়নি। বাধ্য হয়ে কৃষকরা মাঝে মাঝে বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রজাদের স্বার্থ সুরক্ষা করার কিছুটা চেষ্টা করা হয়। তাই হোম্স লিখেছেন—“চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দুঃখজনক ভুল।"
Q3. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাব সিরাজদৌলার সম্পর্ক?
অথবা, সিরাজের সঙ্গে কোম্পানির বিরােধের কারণগুলি আলােচনা করাে।
➺ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন (১৭৫৬ খ্রি.)। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে বিভিন্ন কারণে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল।
☉ কোম্পানির সাথে নবাব সিরাজদৌলার সম্পর্ক : সিরাজ উদ-দৌলা যখন বাংলার নবাব হন তখন তার আত্মীয়স্বজনেরা তার বিরােধিতা করেছিলেন। সুযােগ বুঝে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজ-বিরােধী ঘসেটি বেগম ও সৌকত জঙ্গ-এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সিরাজ উদ-দৌলা এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে ইংরেজ কোম্পানিকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। বাংলায় ইংরেজ এবং ফরাসি কোম্পানি দুর্গ নির্মাণ করে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা এই বিদেশি কোম্পানি গুলিকে দুর্গ নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দিলে নবাবের নির্দেশ ফরাসিরা মেনে নেয়, কিন্তু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তা অগ্রাহ্য করে। এর ফলে নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
সর্বোপরি ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে দস্তকের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের ফরমান অনুযায়ী শুধুমাত্র কোম্পানি 'দস্তক' অর্থাৎ বিনাশুল্কে বাণিজ্যের ছাড়পত্র পেয়েছিল, কোম্পানির কর্মচারীরা নয়। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা এই সুযােগের অপব্যবহার করতে শুরু করলে সিরাজ ইংরেজদের উপর ক্ষুব্ধ হন। ঘসেটি বেগমের প্রিয়পাত্র ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভের বিরুদ্ধে নবাবি তহবিল তছরূপের অভিযােগ ছিল। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদ এসে তাকে হিসাবপত্র দেখানাের নির্দেশ দেন। তখন দেওয়ান রাজবল্লভ তার পুত্র কৃষ্ণ দাসকে প্রচুর ধনরত্নসহ কলকাতায় ইংরেজদের কুঠিতে পাঠিয়ে দেন। নবাব বারংবার কৃষ্ণ দাসকে প্রত্যর্পণ করার নির্দেশ দিলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। নবাবের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির দুর্গ নির্মাণ, কৃষ্ণ দাস প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিরােধের মীমাংসার জন্য নবাব নারায়ণ দাসকে দূত হিসেবে কলকাতায় পাঠান। ইংরেজরা নারায়ণ দাসকে অপমান করলে নবাব ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন।
এরপর নবাব সিরাজ উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন। কলকাতার নাম রাখেন আলিনগর।
এই সংবাদে রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে এসে কলকাতা পুনর্দখল করেন। যুদ্ধ না হয়ে দুপক্ষে আলিনগরের সন্ধি হয় (১৭৫৭, ৯ ফেব্রুয়ারি)। এর একটি শর্ত ছিল— নবাব ফরাসিদের সাহায্য করবেন না। কিন্তু চন্দননগরের ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয়লাভ করে। ক্লাইভ তখন সন্ধিভঙ্গের অপরাধে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেন। অতঃপর ইংরেজরা নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মিরজা ফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে সিরাজ উদ-দৌলাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে।
Q4. ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য লেখ ? এই বাণিজ্য বন্ধ বা অবসান হয় কেন?
➺ পাশ্চাত্য দেশগুলাের সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে ক্যান্টন বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। নিংপাে, অ্যাময় ইত্যাদি অন্যান্য বাণিজ্য বন্দর থাকলেও ক্যান্টন বন্দর ছিল বেশি আকর্ষণীয়। কারণ, সমুদ্রের সহজসাধ্য যােগাযােগ আর চিন সরকারের এই বন্দরকে কেন্দ্র করেই আগ্রহ অর্থাৎ ক্যান্টন বন্দরের নাম অনুযায়ীই এই বাণিজ্য 'ক্যান্টন বাণিজ্য’ নামে উল্লেখযােগ্য।
☉ ক্যান্টন বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য : ক্যান্টন বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও কো-হং’ সংঘ নামে একটি বণিক-সংঘ ক্যান্টন বন্দরের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। এরা চিনা সম্রাটের অধীনস্ত ছিলেন। পণ্যের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা, বাজারের জিনিসপত্রের মূল্য স্থির করা, বিদেশী বণিকদের সাধারণ কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং 'কো-হং’ কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে বিদেশীরা পণ্য বিক্রয় বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাধ্য ছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যে হােপ্পো নামক শুল্ক কমিশনারের দুনীর্তি ‘কো-হং’ ক্যান্টন বাণিজ হােপ্পোরা প্রচণ্ড দূনীতিপরায়ণ ছিলেন। আর এঁদের দুনীর্তির ফলস্বরূপ ‘কো-হং’ বণিকরাও দূনীতির পথে নেমেছিলেন। ক্যান্টন বাণিজ্যে অন্যান্য বিবিধ শর্তাবলী ছিল যে , প্রাচীর বেষ্টিত ক্যান্টন শহরের মধ্যে বিদেশীদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। কোনাে চিনা ভৃত্য নিয়ােগ করতে পারতেন না বিদেশীরা বিদেশী বণিকদের পত্নী বা পরিবারের মহিলারাও ক্যান্টন শহরে প্রবেশ করতে পারতেন না।
☉ ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান : (i) উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইউরােপে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলিতে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ করা যায়। ফলে ইউরােপীয় দেশগুলি অবাধ বাণিজ্যের সমর্থক হয়ে ওঠে। (ii) চিনের বাণিজ্য সম্পর্কিত রুদ্ধ দ্বার নীতি ছিল ইউরােপীয় বণিকদের পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। তাই ইউরােপীয় বণিকরা চিনা সরকারের এই নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করার বদ্ধপরিকর ছিল। (iii) ব্রিটিশ সরকার ক্যান্টন বাণিজ্যের শর্তাবলি ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার জন্য চিন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব জানিয়েছিল। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলে সামরিক শক্তি প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। (iv) 1859 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ক্যান্টন বন্দরে সংঘটিত ব্রিটিশদের যাবতীয় বাণিজ্যিক কার্যাবলি হংকং কে কেন্দ্র করে সম্পাদিত হতে থাকে। বেজিং, গ্র্যান্ড ক্যানাল ও পীত নদী থেকে হংকংয়ে নৈকট্য পশ্চিমি বণিকদের কাছে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছিল। প্রথম আফিম যুদ্ধে ব্রিটেনের জয় ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানের প্রধান কারণে পরিণত হয়েছিল।
উপসংহার : উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ব্রিটিশ বণিকগণ ভারত থেকে চোরাপথে চিনে আফিম
রপ্তানি করতে শুরু করে। এর ফলে ক্যান্টন বাণিজ্যে চারিত্রিক গঠনে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তী প্রথম আফিম যুদ্ধের পর চিনের বেশকিছু বন্দর বিদেশি বণিকদের জন্য খুলে গেলে ধীরে ধীরে ক্যান্টন বাণিজ্যের সমাপ্তি ঘটে।
☞ অধ্যায়ঃ- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া
Q1. চিনে ৪ঠা মে-র আন্দোলনের উত্থান ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ করাে।
অথবা, চিনে ৪ঠা মে আন্দোলনের কারণ ও প্রভাব লেখ?
➺১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে মিত্রশক্তি চিনের প্রতি অবিচার করলে চিনের মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চিনের পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন-তু-শিউ-র ডাকে জাতীয়তা বােধে উদ্বুদ্ধ হাজার হাজার ছাত্র ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে পিকিং-এর ‘তিয়েনআনমেন স্কোয়ার’-এ সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা চিন থেকে বিদেশি শক্তির অপসারণ, সমস্ত অসম চুক্তি বাতিল, দেশদ্রোহীদের শাস্তি প্রভৃতি দাবি করে এবং জাপানি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানায়। বেশ কিছু ছাত্রকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পিকিং-এর ছাত্ররা ধর্মঘটে শামিল হয়। ৪মে-র আন্দোলন ক্ৰমে চিনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। জাপানে পাঠরত চিনা ছাত্ররাও টোকিওর রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তাদের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘জিউগুয়াে’ অর্থাৎ দেশ বার্চাও।
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে চিনে যে সাংস্কৃতিক নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল তারই ফলশ্রুতি ছিল ৪ মে-র আন্দোলন। চাও সে-সুং মনে করেন যে কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা ও গভীরতার বিচারে ৪ মের আন্দোলন ছিল চিনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। চিনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন – (i) ৪ মে-র আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই চিনে আধুনিকতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়। প্রথম পর্বে দেশপ্রেম ও জাতীয়তা বােধে উদ্বুদ্ধ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা ছিল এই আন্দোলনের চালিকা শক্তি। (ii) ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে চিন সরকার নতি স্বীকারে বাধ্য হয়। আন্দোলনের চাপে সরকার বাধ্য হয়ে ধৃত ছাত্রদের ছেড়ে দেয় ও ভাসাই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করবে না বলে ঘােষণা করে (২৮ জুন, ১৯১৯ খ্রি.)। (iii) কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও এই আন্দোলনের ফলেই চিনে কুয়ােমিনতাং দলের পুনর্গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে। জঁ-শ্যেনাে বলেন যে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চিনের শ্রমিকশ্রেণি রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙিনায় প্রবেশ করে। (iv) সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ও আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চিনে বহু বইপত্র ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হলে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ঘটে।
উপসংহার : চিনে 4 মে আন্দোলনটি ছিল সে দেশের জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই আন্দোলনের
পরবর্তীকালে চিনের রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারা নির্দেশিত হয়েছিল। এই আন্দোলনে চিনের জাতীয় শ্ৰেণিস্বার্থের প্রতিফলনও পরিলক্ষিত হয়।
Q2.বাংলায় নবজাগরণের প্রকৃতি আলোচনা করো?
➺ উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবর্ষে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা, চিরাচরিত প্রথা, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের স্থলে বিচারশক্তি, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানচেতনা দেখা দেয়। এশিয়াটিক সােসাইটি'র প্রতিষ্ঠা এবং উইলিয়ম জোন্স, ম্যাক্সমুলার,কানিংহাম, প্রিন্সেপ ও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের গবেষণা প্রাচীন ভারতের গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়কে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তােলে। এইভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘর্ষে জন্ম নেয় বাংলায় ভারতীয় নবজাগরণ।
প্রাচীন ঐতিহ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বদেশপ্রেম, মানবপ্রেম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও যুক্তিবাদ হল এই নবজাগ -রণের বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় জনজীবনে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, চিত্রকলা, সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রনৈতিক ধ্যানধারণা—জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এক নবযুগের সূচনা হয়। তবে একথা মনে রাখা দরকার যে, এই নবজাগরণ কখনােই ইতালীয় নবজাগরণের সঙ্গে তুলনীয় নয়। প্রথমত, দুই নবজাগ রণের প্রেক্ষাপট এক ছিল না। ইতালীয় নবজাগরণের পশ্চাতে ছিল গ্রিক ও লাতিন ঐতিহ্য। বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রেরণা আসে ইংল্যান্ড থেকে। ইংল্যান্ডের চিন্তাধারার সঙ্গে যুক্ত হয় প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য। দ্বিতীয়ত, ইউরােপীয় নবজাগরণের বিরাট গতিবেগ, প্রবল উদ্যম এবং বহুমুখী সৃজনশীলতা এখানে অনুপস্থিত। ভারতীয় নবজাগরণ ছিল সীমাবদ্ধ’ নবজাগরণ। কেবল সমাজের উচ্চশ্রেণির মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দুসমাজের নিম্নবর্ণের মানুষ, কৃষকসমাজ বা মুসলিম সমাজের সঙ্গে এক কোনাে সম্পর্ক ছিল না। ড. অনিল শীল একে 'এলিটিস্ট আন্দোলন' বলে অভিহিত করেছেন। তৃতীয়, উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে বিকাশ ঘটা বাংলার নবজাগরণেও আধুনিক চিন্তাধারা লক্ষ করা যায়। তবে যে পরিবেশে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে বাংলার নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল সেটি ছিল পরাধীন এবং সীমাবদ্ধ। কারণ, তখন বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন। চতুর্থ,বাংলার নবজাগরণে গতির সঞ্চার ঘটলেও তার প্রবাহ ছিল শ্লথ। ফলে ইটালির নবজাগরণের মতাে এখানকার নবজাগরণে গতিবেগ এবং উদ্যমতার ফারাক পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বাংলার নবজাগরণে বহুমুখী সৃজনশীলতার নিদর্শনও ছিল তুলনামূলক কম।
উপসংহার : এ কথা ঠিক যে, উনবিংশ শতাব্দী থেকেই পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যার ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের বিস্তার ঘটে।ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের পার্থক্য থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে, স্থান, পরিস্থিতি, পরিবেশগত পার্থক্য উভয়কে স্বতন্ত্রতা প্রদান করেছিল।
Q3. সমাজসংস্কারক রূপে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কী ছিল?
অথবা,
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারমূলক কার্যাবলি উল্লেখ করাে।
➺ উনিশ শতকে ভারতের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে প্রগতিশীল উদারপন্থী মনীষীগণ আন্দোলন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
☉ বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলন : (i) বিধবাবিবাহ : পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীর অকাল বৈধব্য জীবনের দুঃখদুর্দশা দেখে বিচলিত হয়ে বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে ছিলেন। বিধবাবিবাহ যে শাস্ত্রসম্মত তা প্রমাণ করার জন্য তিনি 'পরাশর সংহিতা’-র শ্লোক উদ্ধৃত করে লিখেছিলেন, “স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব হলে, সংসারধর্ম ত্যাগ করলে অথবা পতিত হলে স্ত্রীর পুনর্বিবাহ শাস্ত্রসম্মত।” রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে গোঁড়া হিন্দুদের বিরােধিতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই আইন জারি করে বিধবাবিবাহ আইনসম্মত বলে ঘােষণা করেন।
(ii) বহুবিবাহ : বিদ্যাসাগর বহুবিবাহের মতাে সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তিনি পুস্তিকা প্রকাশ করে জনসাধারণকে বােঝাতে চেষ্টা করেন যে, বহুবিবাহের পিছনে শাস্ত্রের কোনাে স্বীকৃতি নেই। কিন্তু সরকার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালে আইন পাস করে বহুবিবাহ রদ করে জনগণকে ক্ষিপ্ত করতে রাজি হয়নি। (iii) বাল্যবিবাহ : বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও বিদ্যাসাগর আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর আন্দোলনের ফলে সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবাহের জন্য কন্যার সর্বনিম্ন বয়স ১০ বছর নির্ধারণ করে। বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে ভারতীয় সমাজ থেকে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের প্রবণতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। এই 'করুণাসাগর’ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, তার মনীষা প্রাচীন ঋষিদের মতাে, কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মতাে এবং হূদয়বত্তা বাঙালি জননীর মতাে।
Q4. সমাজসংস্কার আন্দোলনে রাজা রামমােহন রায়ের অবদান কী ছিল?
➺ উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কয়েকজন প্রগতিশীল উদারপন্থী সমাজসংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হলেন ভারতে সমাজসংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ'রাজা রামমােহন রায়।'
☉ রাজা রামমােহন রায়ের সমাজসংস্কার : (i) ব্রাহ্মসমাজ : রাজা রামমােহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে 'ব্রাহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে খ্যাতি লাভ করে (১৮৩০ খ্রি.)। ব্রাহ্মসমাজ ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। (ii) সতীদাহ প্রথা : রামমােহন রায়ের সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন। তার আন্দোলনের ফলে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। (iii) নারীদের সম্পত্তির অধিকার : স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী যাতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে পারেন তা নিশ্চিত করতে রামমােহন রায় নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করেন। (iv) বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা ও বিধবাবিবাহ প্রভৃতির বিরােধিতা : রামমােহন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও জাতিভেদ প্রথার বিরোধ ছিলেন। তিনি অসবর্ণ বিবাহ, বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্যও আন্দোলন করেছিলেন।
এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, রাজা রামমােহন রায় হলেন ভারতের ইতিহাসে আধুনিক যুগের অগ্রদূত।
Q5. আলীগড় আন্দোলন সম্পর্কে যা জানো লেখ?
➺উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদী ভাবধারা ভারতের মুসলমান সমাজকেও প্রভাবিত করেছিল। ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে চেতনার বিকাশ ঘটানাের ক্ষেত্রে আলিগড় আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, “উনিশ শতকের নবজাগরণ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুদের কাছে যা ছিল, আলিগড় আন্দোলনও মুসলিমদের কাছে ছিল ঠিক তাই।
ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় হিন্দুসমাজ ইংরেজ শাসন ও সভ্যতাকে স্বাগত জানায় এবং ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত হয়। অপরপক্ষে, ইংরেজ শাসনের সূচনা থেকেই মুসলিম সমাজ তার বিরােধী ছিল, কারণ মুসলিমদের প্রভাব- প্রতিপত্তি খর্ব করেই ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতা থেকে সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে এবং এর ফলে সরকারি চাকরি থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। ইংরেজ সরকারও তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। ওয়াহাবি আন্দোলন : ও পরবর্তীকালে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহে মুসলিম সমাজের ভূমিকায় ইংরেজ সরকার তাদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত হয়। এইভাবে শিক্ষাদীক্ষা, প্রভাব- প্রতিপত্তি, সরকারি চাকরি সবকিছু থেকে বঞ্জিত হয়ে মুসলিম সৈয়দ আহমদ খান সমাজ হতাশার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এই অবস্থায় মুসলিম সমাজের ত্রাণকর্তা হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আবির্ভাব হয়। হিন্দুসমাজের মঙ্গলসাধনের জন্য রাজা রামমােহন যা করেছিলেন, মুসলিম সমাজের মঙ্গলের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদও অনুরূপ ভূমিকা পালন করেন।
আলিগড় আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণে দেখা যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে হিন্দুরা সরকারি উচ্চপদ অধিকার করে এবং সমাজে নিজেদের অবস্থানকে উন্নত করে। কিন্তু মুসলিমরা ব্রিটিশ
শাসনের প্রতি সন্দিহান ও ক্ষুদ্ধ থাকায় তারা ব্রিটিশ শাসন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে তারা পিছিয়ে পড়ে। সৈয়দ আহমদ, থিওডাের বেক-সহ কিছু মুসলিম নেতা এই পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালান। মুসলিম নেতৃবর্গ মুসলমানদের এটা বােঝাতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশদের সঙ্গে আপস মীমাংসায় পৌঁছেলে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের সব সুযােগসুবিধা গ্রহণ করলে আখেরে মুসলমান সম্প্রদায়েরই লাভ। আলিগড় আন্দোলনে রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্লেষণে সাম্প্রদায়িক মনােভাবই স্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। আন্দোলনের আদর্শ হিসেবে ঘােষণায় বলেন ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি আলাদা জাতি, তাই উভয়ের রাজনৈতিক স্বার্থ আলাদা।
আলিগড় আন্দোলন মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে আলােয় নিয়ে আসার এক উজ্জ্বল প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। যদিও মুসলমানদের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে পরােক্ষে এই আন্দোলন পরবর্তী কালের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকেই প্রশ্রয় দেয়। এর পরিণতিতে দেশবিভাগ ও পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি। ইতিহাসবিদ কে, কে, আজিজের মতে, “আলিগড়আন্দোলন ছিল অংশত শিক্ষাগত, অংশত সাহিত্যগত, অংশত ধর্মীয় এবং সম্পূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক।”
☞ অধ্যায়ঃ- ঔপনিবেশিক ভারতে শাসন
Q1. মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন কি? এর বৈশিষ্ট্য বা শর্ত লেখ?
➺ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার ভারতীয়দের প্রত্যাশা পূর্ণ করেনি। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তারা অধিকতর ক্ষমতা ও অধিকারের দাবি করতে থাকে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে চরমপন্থীরা যােগ দিলে জাতীয় কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই অধিবেশন কালে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদন করে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনায় সম্মত হয়। এ সময় শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত ও বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে ‘হােমরুল আন্দোলন’শুরু হলে সরকার ভীত হয়ে ওঠে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সরকার বুঝতে পারে, ভারতবাসীর লােকবল ও অর্থবল ছাড়া যুদ্ধজয় অসম্ভব। তাই সরকার বিরােধী আন্দোলন প্রশমন এবং যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য লাভ সরকারের কাছে অপরিহার্য ছিল। এ কারণে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত-সচিব মন্টেগু ঘােষণা করেন, যুদ্ধান্তে ভারতকে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দেওয়া হবে। এই বছরেই তিনি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য ভারতে আসেন। তখন ভারতের বড়ােলাট ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড। মন্টেগু ও চেমসফোর্ডের যৌথ রিপাের্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন পাস হয়। তাই এই আইন ‘মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার’বা '১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন’নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য বা শর্তাবলি: (i) এই শাসন সংস্কার দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টন করা হয়। (ii) কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর দেশরক্ষা, রেলপথ, মুদ্রা, পররাষ্ট্র নীতি, শুল্ক, ডাকব্যবস্থা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়। (iii) প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, রাজস্ব, যােগাযােগ প্রভৃতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। (iv) কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টিত হলেও কেবল কেন্দ্রীয় আইনসভাই সারা ভারতের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারত। কোনাে কোনাে বিষয়ে আইন-সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপনের পূর্বে বড়ােলাটের অনুমতি নেওয়া অপরিহার্য ছিল। বড়ােলাট 'অর্ডিন্যান্সের’ বলে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন। ৭ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ বা বড়ােলাটের শাসন-পরিষদ (Executive Council) গঠিত হয়। ৭ জন সদস্যের মধ্যে অন্তত ৩ জন সদস্যকে ভারতীয় হতে হত। শাসন-পরিষদের সাহায্যে বড়ােলাট নিজ দায়িত্বে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেনভারতীয় আইনসভার কাছে নয়। (v) কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। নিম্নকক্ষের নাম হয় কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় রাষ্ট্রীয় পরিষদ'। উচ্চকক্ষের ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ২৬ জনকে বড়ােলাট কর্তৃক মনােনীত এবং বাকি ৩৪ জন সদস্যকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। নিম্নকক্ষের ১৪০ (পরে ১৪৫) জন সদস্যের মধ্যে ৪০ জনকে মনােনীত এবং ১০০ (পরে ১০৫) জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয় কক্ষেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। (vi) প্রদেশগুলিতে একক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা স্থাপিত হয়। এর সদস্যদের মধ্যে শতকরা ৭০ জনকে নির্বাচিত এবং ৩০ জনকে গভর্নর কর্তৃক মনােনীত করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বগুলিকে দু-ভাগে ভাগ হয়–সংরক্ষিত বিষয় ও হস্তান্তরিত বিষয়। আইনশৃঙ্খলা, পুলিশ, প্রশাসন, অর্থ, বিচার, শ্রম প্রভৃতি বিষয়গুলি ছিল সংরক্ষিত বিষয়। এগুলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক গভর্নর ও তার কার্যনির্বাহক সভার ওপর। আবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি ছিল হস্তান্তরিত বিবর। এগুলি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে । মন্ত্রীরা তাদের কাজকর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়ী থাকতেন। হস্তান্তরিত বিষয়ে প্রাদেশিক আইনসভা কোনাে আইন প্রবর্তন করলে গভর্নর বা গভর্নর জেনারেল তা নাকচ করে দিতে পারতেন। এইভাবে এই অইন প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে।
Q2.পঞ্চাশের মন্বন্তরের কারণ ও প্রেক্ষাপট আলোচনা করাে?
অথবা, ৫০-এর মন্বন্তর তৎকালীন ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে কী প্রভাব ফেলেছিল?
➺ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রথমদিকে সরকার এদেশে শিল্পের বিকাশে বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি। তখন ভারত ব্রিটেনের কলকারখানাগুলিতে কাঁচামাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। ব্রিটেনে উৎপাদিত শিল্পজাত পণ্য ভারতের বাজার দখল করে নিলে ভারতের কুটিরশিল্প ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়। অবশ্য মহাবিদ্রোহের পরবর্তীকালে ভারতের শিল্পায়নে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতে শিল্পের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতে শিল্পের অগ্রগতির কয়েকটি কারণ ছিল,
যেমন - (i) পুঁজিপতিদের সুবিধাদান : ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেনের কলকারখানা গুলি যুদ্ধ-সংক্রান্ত কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পর্যাপ্ত ভােগ্যপণ্য উৎপাদনে এবং ভারতে পর্যাপ্ত শিল্পজাত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে ব্রিটেন ব্যর্থ হয়। এই শূন্যতার সুযােগে ভারতের বাজার দখলের উদ্দেশ্যে আমেরিকা ও জাপান তৎপরতা শুরু করে। আমেরিকা ও জাপান কর্তৃক ভারতের বাজার দখলের তৎপরতা প্রতিরােধ করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় পুঁজিপতিদের শিল্পস্থাপনে কিছু কিছু সুযােগ-সুবিধা দিতে শুরু করে । (ii) সংরক্ষণ নীতি : ব্রিটিশ সরকার ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পর এদেশে বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নীতি অর্থাৎ সেসব শিল্পের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিশেষ কিছু সুবিধাদানের নীতি গ্রহণ করে। ফলে বিদেশি শিল্পপণ্যের অসম প্রতিযােগিতার হাত থেকে ভারতীয় শিল্প কিছুটা রক্ষা পায়। এই পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে হলেও ভারতে শিল্পায়নের সুবিধা হয়। (iii) অর্থনৈতিক মহামন্দা : অর্থনৈতিক মহামন্দা ও ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট বা মহামন্দা দেখা দেয়। এতে ব্রিটিশ শিল্পের অগ্রগতিও যথেষ্ট ব্যাহত হয়। এই সুযােগে ভারতে শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করে।
পরবর্তী কালে ৫০-এর মন্বন্তরের ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে প্রভাব ও অর্থনৈতিক প্রভাব ও মন্বন্তরের সময় বাংলায় চুড়ান্ত অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দরিদ্র মানুষের দীর্ঘদিন ধরে জমানাে অর্থসম্পদ দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য কিনতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এরপর নিঃস্ব, রিক্ত, অভুক্ত মানুষগুলি থালা-বাটি হাতে রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তিতে বেরিয়ে পড়ে। “মা, একটু ফ্যান দাও” বলে কাতরাতে কাতরাতে কলকাতার বুভুক্ষু মানুষের দল দিশাহীনভাবে ঘুরে বেরাচ্ছে এবং পরে অভুক্ত, শীর্ণ, কঙ্কালসার এই মানুষগুলি রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকছে। এই দৃশ্য কলকাতা সহ বাংলার সর্বত্র দেখা যেত। ৫০-এর মন্বন্তরের পটভূমিকায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টি হয়েছে। চিত্তপ্রসাদ তার ক্ষুধার্ত বাংলা ১৯৪৩-এর নভেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় ভ্রমণ’-এ, বিজন ভট্টাচার্য তার ‘নবান্ন নাটকে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'অশনি সংকেত’ উপন্যাসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ কাহিনি তুলে ধরেন। এছাড়া অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘আকালের সন্ধানে’, কে.এ আব্বাস পরিচালিত ‘ধরতি কে লাল’ এবং বিমল রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র, জয়নুল আবেদিনের আঁকা বিভিন্ন চিত্র প্রভৃতি তে পঞ্চাশের মন্বন্তরের করুণ কাহিনি ধরা পড়েছে।
Q3. মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট আলােচনা করাে। ঐ মামলাটির গুরুত্ব বা পরিণতি কী হয়েছিল ?
অথবা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯ খ্রি.) প্রেক্ষাপট ও পরিণতি বর্ণনা করাে?
➺ ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট ছিল- (i) শ্রমিক অসন্তোষ : ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলােপ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা প্রভৃতির দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের প্রসার সরকারকে চিন্তায় ফেলে দেয়। (ii) হুইটলি কমিশন নিয়ােগ : ক্রমাগত শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষোভ প্রশমনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হুইটলি কমিশন’ নিয়ােগ করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে। (iii) ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার ও কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ ও তাদের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৩ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে এটি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। অভিযুক্ত ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। (iv) পরিণতি : ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন জওহরলাল নেহরু, এম. সি চাগলা প্রমুখ। (v) মামলার রায় : ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার দীর্ঘমেয়াদের কারাদণ্ড ঘােষণা করা হয়। (vi) গান্ধিজির ভূমিকা : কংগ্রেস নেতা গান্ধিজি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান। (vii) বামপন্থী আদর্শের প্রসারে পরােক্ষ সহায়তা : মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতে বামপন্থার প্রসারে পরােক্ষভাবে সহায়তা করে। জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছালে ভারতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে। (viii) কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধকরণ : শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল।
Q4. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট কী ছিল? এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দাও এবং ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করাে?
➺ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত রাওলাট আইনের চরম পরিণতি ছিল জালিয়ান -ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের উদ্যানে এই কুখ্যাত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশ আহূত হয়।জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ঘাতক পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে শান্তিপূর্ণ জমায়েতকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করে। এই কুখ্যাত ঘটনাটি ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাটের মতে - জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সিপাহি বিদ্রোহের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পাঞ্জাব অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার-এর স্বৈরাচারী শাসনে পাঞ্জাববাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের দুই শীর্ষ নেতা ড. সত্যপাল ও সৈফুদ্দিন কিচলুকে রাওলাট আইনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে আটকে রাখলে (১৯১৯ খ্রি. ১০ এপ্রিল) সমগ্র পাঞ্জাবে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ওই দিনই দুপুরে দিল্লির অদূরে পালওয়াল স্টেশনে গান্ধিজিকে গ্রেপ্তার করা হলে লাহােরে জনতা হরতাল করে। অমৃতসরে এক শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় পুলিশ গুলি চালায়। এতে ২০ জন নিরীহ লােক মারা যায়, ১৫০ জন আহত হয়। লালা
লাজপত রায় বলেন – “পাঞ্জাববাসীর অসন্তোষের মূলে ছিল অর্থনীতি যা ছিল সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতিরই ফলশ্রুতি।”
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া : (i) এই নির্লজ্জ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমগ্র ভারতবর্ষ উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ভারতীয়দের তীব্র ধিক্কার ধ্বনিত হয়। (ii) প্রচণ্ড দুঃখে ও ক্ষোভে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া 'নাইট’ উপাধি বর্জন করেন। (iii) সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন “জালিয়ানওয়ালাবাগের বীভৎস ঘটনা সমগ্র ভারতে মহাযুদ্ধের হােমশিখা প্রজ্বলিত করেছিল।” (iv) ইংরেজ রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিলও বলেছেন, “এই রকম ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর কখনাে ঘটেছে বলে মনে হয় না।” (v) শান্তির পূজারি গান্ধিজি ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকাতে লিখেছেন “This satanic government cannot be mended, it must be ended” এই শয়তান সরকারের সংশােধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে।
Q5. ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এর পটভূমি ব্যাখ্যা করাে?
অথবা, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মলে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইনের পটভূমি উল্লেখ করাে। এই আইনের বৈশিষ্ট্য ও শর্তাবলি কী ছিল?
➺ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থী গােষ্ঠীর বিরােধ এবং বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদীদের উত্থানের মতাে ঘটনায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড ব্যালফোর এক কৌশলী আপস নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি লর্ড কার্জনের কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড মিন্টোকে ভারতের গভর্নর জেনারেল করে পাঠান। এই সময় ভারতসচিব ছিলেন লর্ড মর্লে। লর্ড মর্লে ও লর্ড মিন্টো এক শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দ্বারা কংগ্রেসের নরমপন্থী গােষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে ও নরমপন্থী-চরমপন্থী বিবাদ দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং কংগ্রেস বিরােধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। তাদের উদ্যোগে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ১ অক্টোবর ভারতের শাসন সংস্কারের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি খসড়া আইন পেশ করা হয়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এই খসড়া আইন আইনের রূপ পায়। এই ভারত শাসন আইন বা মর্লে-মিন্টো আইন নামে পরিচিত।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে-মিন্টো শাসন সংস্কার আইনে প্রকৃত নাম ছিল ভারত শাসন আইন । এই আইনের দুটি দিক ছিল। (ক) কার্যনির্বাহী পরিষদ, (খ) আইন পরিষদ।
(ক) কার্যনির্বাহী পরিষদ : (i) গভর্নর জেনারেলের কার্যনির্বাহী পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়। কার্যনির্বাহী পরিষদে প্রথম ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন ব্যারিস্টার লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। তিনি এই পরিষদে আইন সদস্যরূপে নিযুক্ত হন। (ii) বােম্বাই, মাদ্রাজ ও বাংলার গভর্নরদের কার্যনির্বাহী পরিষদে সদস্যসংখ্যা ২জন থেকে বাড়িয়ে ৪জন করা হয়।
(খ) আইন পরিষদ : আইন পরিষদে চার ধরনের নির্বাচকমণ্ডলী রাখার কথা বলা হয়। যথা-
ভারতীয়দের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে মর্লে-মিন্টো আইন পাশ হলেও এই আইনের বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। যেমন - অধিকারহীনতা : এই আইনের মাধ্যমে দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বিদেশীনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনাে প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার হাতে ছিল না। দায়িত্বশীলতার অভাব : মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্রে এবং প্রদেশে নির্বাচিত ভারতীয় জন প্রতিনিধি -দের বিশেষ কোনাে গুরুত্ব স্বীকৃত হয়নি। ফলে এই আইন ভারতের কোনো দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
Q6. লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্ত ও গুরুত্ব আলোচনা করো?
➺ জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তিলকের উদ্যোগে কংগ্রেস ও জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে পরিচিত।।
লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্ত : (i) কংগ্রেস ও লিগ একযােগে ব্রিটিশের কাছে শাসন সংস্কারের দাবি জানাবে (ii) লিগ কংগ্রেসের স্বরাজের আদর্শ মেনে নেবে এবং কংগ্রেসও লিগের আলাদ নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি মেনে নেবে (iii) প্রাদেশিক আইনসভা ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মােট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম প্রতিনিধি।
লক্ষ্ণৌ চুক্তির গুরুত্ব : কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে স্বাক্ষরিত লক্ষ্ণৌ চুক্তির গুরুত্ব অসীম। (i) এই চুক্তি ইংরেজের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের ওপর আঘাত হানে। এ প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভাবগত ঐক্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এই চুক্তি।" (ii) এই চুক্তির রূপকার হিসেবে বালগঙ্গাধর তিলক ও মহম্মদ আলি জিন্নার জাতীয় নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। (iii) আলাদা আলাদা স্থায়িত্ব এই চুক্তিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পৃথক স্বার্থকে পরােক্ষে স্বীকার করা হয়েছিল। মহম্মদ দুরানীর মতে—“লক্ষ্ণৌ চুক্তি দ্বারা কংগ্রেস স্বীকার করে নেয় যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক জাতি।"
উপসংহারঃ জাতীয় কংগ্রেস লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম লিগের আলাদা নির্বাচনের দাবি মেনে নেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু-মুসলিম দুটি আলাদা জাতি এবং তাদের স্বার্থও আলাদা। বেশ কয়েকটি ত্রুটি সত্ত্বেও লক্ষ্ণৌ চুক্তি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের অংশীদার করতে সক্ষম হয়। এই চুক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ভারতে এক উত্তাল জাতীয় আন্দোলনের ঢেউ তােলে।
☞ অধ্যায়ঃ- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও উপনিবেশসমূহ
Q1. ভারতের মুক্তিসংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ভূমিকা কী ছিল?
➺ ভারতের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনাদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় হয়ে আছে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করেছিলেন। (১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি কটক শহরে সুভাষচন্দ্রের জন্ম হয়। তার পিতা সরকারি উকিল জানকিনাথ বসু ও মাতা প্রভাবতী দেবী। তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, পরে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অনার্স-সহ বি এ পাস করেন। এরপর তিনি আই .সি .এস পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান।)
(i) আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রতিষ্ঠা : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জুন প্রখ্যাত ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ব্যাংকক শহরে প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগ’ গঠন করেন। তিনি সিঙ্গাপুরে 'আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর। প্রতিষ্ঠাকালে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান সেনাপতি ছিলেন মােহন সিং। (ii) সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ : নেতাজি সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে এক বিশাল অনুষ্ঠানে 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লিগের' দায়িত্বভার এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্বভার গ্রহণের পর তিনি এর সেনাদলকে কয়েকটি ব্রিগেডে ভাগ করেন। এগুলি হল গান্ধি ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহরু ব্রিগেড, রানি ঝাসি ব্রিগেড প্রভৃতি। (iii) আজাদ হিন্দ সরকার গঠন : নেতাজি সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। জাপান, ইটালি, জার্মানি-সহ নয়টি রাষ্ট্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। জাপান তার অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এই সরকারকে অর্পণ করে। এই দ্বীপপুঞ্জ দুটির নামকরণ করা হয় যথাক্রমে 'শহিদ দ্বীপ’ ও ‘স্বরাজ দ্বীপ। (iv) ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা : আজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। ভারতীয়রা দলে দলে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যােগদান করে। নেতাজি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান সামরিক দপ্তর স্থাপন করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের রণধ্বনি ছিল ‘দিল্লি চলাে'। তাদের লক্ষ্য ছিল দিল্লি দখল করে ভারত থেকে ইংরেজদের বিতাড়িত করা। (v) আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান : নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ আজাদ হিন্দ বাহিনী ব্রহ্মদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ। তারা মণিপুরে প্রবেশ করে মৈরাং-এ ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লড়াই শুরু করে। (vi) আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মসমর্পণ : এদিকে আমেরিকা জাপান অভিযানে অগ্রসর হলে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হয়। জাপানি সেনাবাহিনী স্বদেশ রক্ষার্থে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গ ত্যাগ করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাপান মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলে আজাদ হিন্দ বাহিনীও অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে ১৮ আগস্ট নেতাজি এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন বলে খবর প্রচারিত হয়।
সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াই ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নকে একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে উন্নীত করে। আজাদি সেনাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদান যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতবাসীকে দেশাত্মবােধে উদ্বুদ্ধ করেছে, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। গান্ধিজি বলেছেন, - "তাঁরা একই পতাকা তলে ভারতের সব ধর্ম ও জাতির মানুষকে একত্রিত করেছিলেন, ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে তাঁরা একতা ও সংহতির আদর্শ সঞ্চারিত করেছেন।"
Q2. ভারতে ক্রিপস্ মিশন আসার কারণ কী ছিল? ক্রিপস্ মিশন কেন ব্যার্থ হয়েছিলো আলোচনা করো?
➺ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্ ছিলেন ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য তথা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আইনবিদ ও বিশিষ্ট সমাজবাদী নেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযােগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান বিষয়ক প্রস্তাব বলি আলাপ-আলোচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ক্রিপস মিশন কে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। সেইমতো ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে মার্চ ২৩ তারিখে ক্রিপস ভারতে আসেন।
ক্রিপস মিশনকে ভারতে পাঠাবার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল- (i) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেঙ্গুন দখল করে জাপান ভারতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয় ১৯৪২খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রকার উপলব্ধি করে যে, জাপান আক্রমণ প্রতিরােধে ভারতীয়দের আন্তরিক সহযােগিত্যা দরকার ভারতবাসীর সন্তুষ্টির জন্য ক্রিপস্ ভারতে আসে (ii) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটিশ শ্রমিক দলের নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ও অন্যান্য ইংরেজ রাজনীতিবিদ দৃঢ় অভিমত দেন যে, ভারতবাসীর সহযােগিতা পাওয়ার জন্য স্বায়ত্ত -শাসন সম্পর্কে কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া দরকার। (iii) চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই-শেকও ভারতবাসীর দাবিগুলি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা জন্য প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অনুরােধ জানান। (iv) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে গনবিদ্রোহ শুরু হয় তাতে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে মিত্রপক্ষ তথা ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে। তাই ভারতীয়দের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য ক্রিপস্ ভারতে আসেন।
ক্রিপস প্রস্তাব ব্যর্থতার কারণ : ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল ক্রিপস্-এর প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করে। (i) ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতাদানের কোনাে উল্লেখ না থাকায় এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়। (ii) ক্রিপস্ প্রস্তাবে পরােক্ষভাবে ভারত-বিভাগকে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই প্রস্তাব সফল হয়নি। (iii) দেশীয় রাজ্যগুলির ৯ কোটি মানুষের ভাগ্য রাজন্যবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে জাতীয় কংগ্রেস। (iv) ক্রিপস্ প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারের তুলনায় দুর্বল করায় প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। (v) সংবিধান সভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু-মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দলও ক্লিপস্ প্রস্তাবের বিরূপ সমালােচনা করে। শেষপর্যন্ত ক্রিপস্ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।
Q3. হো-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করো?
অথবা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দাও।
➺ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম বাসীরা দীর্ঘ ৩০ বছর (১৯৪৫-৭৫ খ্রি:) ধরে যে যুদ্ধ চালিয়েছিল তা ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। প্রথমে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামে থাবা বসাতে চাইলে এই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
☉ পটভূমি : (i) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির জাতীয় আন্দোলনের প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত মালয় ও শ্যাম (থাইল্যান্ড), মায়ানমার-সহ বিভিন্ন দেশে উপনিবেশবিরােধী সংগ্রাম চরমে পৌঁছােয়। এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে ভিয়েতনাম (টংকিং, আন্নাম, কোচিন-চিন)-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। (ii) রুশ-জাপান যুদের ফলাফল : রুশ-জাপান যুদ্ধের ফলাফল জাপানের অনুকূলে যাওয়ায় ভিয়েতনাম বাসীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ভিয়েতনামও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটাতে পারবে। (iii) চিনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব : চিনে প্রজাতান্ত্রিক বিপ্লব (১৯১১ খ্রি.) এবং সান ইয়াত সেনের জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভিয়েতনামিরা ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। (iv) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ : দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে সােভিয়েত রাশিয়া ও চিনের সাহায্যে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে শুরু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম সমস্যায় হস্তক্ষেপ করে। মার্কিন মদতে দক্ষিণ ভিয়েতনামে তদারকি রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় বসানাে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ আরও তীব্ররূপ ধারণ করে।
☉ ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রথম পর্ব (১৯৪৫-৫৪ খ্রি.) :
(i) উদ্দেশ্যগত পার্থক্য: প্রথমে ফ্রান্স দক্ষিণ ইন্দোচিনে নিজের আধিপত্য কায়েম করে। কিন্তু শুধুমাত্র দক্ষিণ ইন্দোচিন নয়, ফ্রান্সের লক্ষ্য ছিল সমগ্র ইন্দোচিনে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। অপর দিকে কুয়ােমিনটাং চিন ও ইন্দোচিনে (কোচিন-চিন-লাওস, কম্বােডিয়া, আন্নাম ও টংকিং) হাে-চি-মিনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকলেও তার লক্ষ্য ছিল ভিয়েতনামের স্বাধীনতা অর্জন। (ii) মার্কিনি সাহায্যদান: প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। সাম্যবাদের প্রসার রােধের জন্য ফ্রান্সকে কেবলমাত্র মদত জুগিয়েছিল। (iii) দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনা: ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফরাসি বাহিনী যখন কোণঠাসা, তখন ভিয়েতমিনদের ধ্বংস করার জন্য ফরাসি জেনারেল নেভারে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই নেভারে পরিকল্পনা অনুযায়ী টংকিং-এর ‘দিয়েন-বিয়েন-ফু’ নামক স্থানে একটি অস্ত্রভাণ্ডার ও দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই ঘাঁটি ভিয়েতমিন সেনাপতি জেনারেল গিয়াফ-এর আক্রমণে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ৮ বছর ব্যাপী এই যুদ্ধে মােট ৮২ হাজার ফরাসি সেনা মারা যায় এবং ১ লক্ষ ১৪ হাজার ফরাসি সেনা আহত হয়। (iv) জেনেভা সম্মেলন: “দিয়েন-বিয়েন-ফু’ ঘটনার পরের দিন জেনেভাতে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরােধী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং ভিয়েতনামে দীর্ঘদিনের ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে লাওস ও কম্বােডিয়াকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।
☉ ভিয়েতনাম যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় :
(i) জেনেভা চুক্তির ব্যর্থতা : জেনেভা চুক্তি (১৯৫৪ খ্রি.)-র দ্বারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটলেও এই চুক্তি যুদ্ধের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটায়। ভিয়েতনাম চুক্তির শর্তাবলি রূপায়িত না হওয়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধ জারি থাকে। (ii) যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ : ইন্দোচিনে উত্তরােত্তর হাে-চি-মিনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদবিগ্ন হয়ে পড়ে। আমেরিকা নদিন দিয়েমকে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে ঢালাও আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে শুরু করে। এর পাশাপাশি সাম্যবাদের প্রসার রােধের লক্ষ্যে আমেরিকা গঠন করে সিয়াটো বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা। (iii) ভিয়েতকং: উত্তর ভিয়েতনামে হাে-চি-মিন বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি ও জমিবণ্টনের মাধ্যমে নিজের সরকারের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখেন। অপর দিকে দক্ষিণ ভিয়েতনাম দিয়েম সরকারের নির্বাচনের বিরােধিতা করলে সমগ্র ইন্দোচিন জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে নবগঠিত জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সঙ্গে দিয়ে সরকারের সংঘর্ষ বাঁধে। মুক্তিফ্রন্টের যােদ্ধা ভিয়েতকংদের উত্তর ভিয়েতনাম থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেওয়া শুরু হয়। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধৈর্য হারিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে ভিয়েতকংদের আক্রমণ করে। এর পরিণামে দক্ষিণ ভিয়েতনামে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে। (iv) স্বাধীন ভিয়েতনামের আত্মপ্রকাশ : সারা বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠলে, এমনকি খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রতিবাদের ঝড় উঠলে মার্কিন সরকার বাধ্য হয় যুদ্ধবিরােধী চুক্তি (১৯৭৩ খ্রি., ২৩ জানুয়ারি) সম্পাদন করতে। চুক্তির শর্ত মেনে মার্কিন সরকার ভিয়েতনাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিলে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রায় সমস্ত অঞ্চলই ভিয়েতকরা দখল করে নেয়। উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামের মিলন ঘটলে আত্মপ্রকাশ ঘটে সােশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব ভিয়েতনাম-এর।
উপসংহার: সুদীর্ঘ ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিনিদের পরাজিত করে ভিয়েতনামবাসীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিসংগ্রামকে গৌরবান্বিত করেছিল। অপর দিকে এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে আমেরিকা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের সম্মান অনেকটাই খুইয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের সচিব উ.থান্ট বলেছেন—“ভিয়েতনামের যুদ্ধ কমিউনিস্ট আগ্রাসনের যুদ্ধ নয়, এটি বিদেশি বিশেষত আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।”
Q4. ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়াে আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখাে।
অথবা, ভারত ছাড়াে বা আগস্ট আন্দোলনের কারণ কী ছিল? এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলােচনা করাে।
☉ ভূমিকা : ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায় হিসাবে ১৯৪২ -এর ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন স্মরণীয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতার এই সংগ্রাম অভূতপূর্ব। আঞ্চলিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও ভারতে পূর্বে সংঘটিত সব আন্দোলন থেকে এই আন্দোলনের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।
☉ পটভূমি : ১৯৪২-এর ব্যাপক গণআন্দোলনের একটি বাস্তব পটভূমি ছিল (i) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের পূর্ণ সমর্থন ও সহযােগিতা কামনা করেই ব্রিটিশ সরকার ক্রিপসকে ভারতে পাঠায়। কিন্তু এই মিশন ব্যর্থ হলে ভারতীয় রাজনীতিতে হতাশার ছায়া নেমে আসে। (ii) ব্রিটিশ সরকার জাতীয় সরকার গঠনের দাবি অস্বীকার করলে কংগ্রেসের মধ্যে ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব বৃদ্ধি পায়। ইংরেজদের অনমনীয় মনােভাবে ক্ষুদ্ধ গান্ধিজি গণআন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। (iii) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতি ভারত ছাড়াে আন্দোলনের পটভূমি অনিবার্য করে তুলেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অক্ষশক্তির শরিক হিসাবে জাপান দূর্বার গতিতে অগ্রসর হলে ভারতে জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়। ভারতের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইংরেজদের উপস্থিতিকেই এদেশে জাপানি আক্রমণের কারণ বলে গান্ধিজি ও কংগ্রেস মনে করে । ফলশ্রুতিতে ভারত ছাড়াে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
☉ ভারত ছাড়াে প্রস্তাব : ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট বােম্বাই-এর কংগ্রেস অধিবেশনে গান্ধির নেতৃত্বে গণ আন্দোলনের প্রস্তাব নেওয়া হয়। গান্ধিজি তার বিখ্যাত ভাষণে ঘােষণা করলেন, “এখন থেকে প্রতিটি ভারতবাসী নিজেকে স্বাধীন মানুষ বলে মনে করুক।” এই আন্দোলনের একটিই মূল কথা- “ডু অর ডাই” “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ”। কংগ্রেসের ভারত ছাড়াে প্রস্তাব পুরােপুরি আপােসহীন ছিল না। ব্রিটেনের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য দানের কথা এর মধ্যে ছিল। গান্ধিজিও ভারত সচিবের সঙ্গে দেখা করতে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু সরকার ৯ আগস্ট কংগ্রেসের নেতাদের গ্রেপ্তার করলেন। ফলে এই ঘটনায় যে প্রতিক্রিয়া ঘটল তা যেমন আকস্মিক তেমনি স্বতঃস্ফুর্ত।
নেতৃত্বহীন অবস্থায় দেখা দিল ব্যাপক জনজাগরণ। কংগ্রেসের এই আন্দোলন প্রথমদিকে অহিংস ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বিচলিত হয়ে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণ শুরু করলে আন্দোলন হিংসাত্মক আকার ধারণ করে এবং এর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে কংগ্রেসের নির্দেশ না থাকা সত্ত্বেও আন্দোলন হিংসাত্মক রূপ লাভ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে সভা সমিতি, মিছিল, পিকেটিং, হরতাল প্রভৃতি অহিংস উপায়ে আন্দোলন শুরু হয়। কালক্রমে এই আন্দোলন সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের আকার ধারণ করে। বিহার, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গা ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে পড়ে। তমলুকে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন জাতীয় সরকার। মেদিনীপুরের ৭২ বছরের বৃদ্ধ মাতঙ্গিনী হাজরা থানা দখল করে বিদ্রোহ প্রকাশ করেন। ফলে আন্দোলন প্রকৃতই গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়।
☉ আন্দোলনের সমাপ্তি : আন্দোলন বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দমন-পীড়ন নীতি বাড়তে থাকে। গুলিতে প্রাণ হারায় বহু ভারতবাসী। সমগ্র দেশেই পরিণত হয় কারাগারে। ফলে আন্দোলনের তীব্রতা কমতে থাকে এবং তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অত্মিসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আগস্ট আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। সরকারি দমননীতি, প্রধান নেতাদের কারাবাস, বহু মানুষের প্রাণহানি প্রভৃতি কারণের সঙ্গে এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার পিছনে আরাে কিছু কারণ ছিল— (i) এই আন্দোলনের কোনাে নির্দিষ্ট কর্মসূচি ছিল না। (ii) ভারতের সব রাজনৈতিক দল যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, লিগ ও অনুন্নত সম্প্রদায় আন্দোলনকে সমর্থন করেনি। (iii) আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংহতি ছিল না।
ব্যর্থতা সত্ত্বেও ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়াে আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
(i) মানসিক অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করেও মুক্তিপাগল ভারতবাসী বিশ্ব দরবারে তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেয়। (ii) জাতীয় কংগ্রেস ভারতবাসীর কাছে একটি জনপ্রিয় দলে রূপান্তরিত হয়। (iii) ভারতবাসী উপলব্ধি করে তাদের স্বাধীনতা লাভ আর শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। (iv) ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে যে দমন-পীড়নের দ্বারা আর বেশিদিন ভারতবাসীকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তাই তারা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উদ্যোগী হয়।
Q5. ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতে নৌবিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব আলােচনা করাে?
অথবা, নৌবিদ্রোহ কোথায় শুরু হয়েছিল? এই বিদ্রোহের গুরুত্ব কী ছিল?
➺ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্বে এক উল্লেখযােগ্য গণ আন্দোলন হল ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি বােম্বাইয়ের 'রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির তলােয়ার’ নামক জাহাজে নাবিকরা বিদ্রোহ ঘােষণা করে। কারণ ব্রিটিশ সরকার এই জাহাজের রেডিয়াে অপারেটর বলাই দত্তকে দেশাত্মবােধক স্লোগান দেওয়ার জন্য পদ্যচুত করে। নাবিকরা ব্রিটিশ সরকারের পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা তুলে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এম.এস খানের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহে বােম্বাইয়ের প্রায় ২০ হাজার নৌ-সেনা অংশগ্রহণ করে। এই বিদ্রোহ মাদ্রাজ, কলকাতা, করাচি প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
☉ বিদ্রোহের কারণ :
(i) আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার : আজাদ হিন্দ বাহিনীর ধৃত সেনাপতিদের বিচার শুরু হয়েছিল দিল্লির লালকেল্লায় (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর—৩১ ডিসেম্বর)। এর ফলে সেনাপতি ও সৈন্যদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কাহিনি প্রচারিত হয় এবং নৌবাহিনীর সেনারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘােষণা করে।
(ii) নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ: নৌবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ভারতীয় নৌসেনা ও নৌ-কর্মচারী দের জন্য নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা। ভারতীয় নৌ-সেনারা এর প্রতিকারের জন্য বারবার আবেদন করলেও কোনাে ফল হয়নি। তাই তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। (iii) বেতন ও পদোন্নতি সংক্রান্ত বৈষম্য : ইংরেজ কর্মচারীদের মতাে সমান যােগ্যতা থাকলেও ভারতীয় কর্মচারীদের পদোন্নতি করা হত না। তাদের বেতনও ইংরেজ কর্মচারীদের থেকে অনেক কম ছিল। ফলে ভারতীয় নৌসেনারা ক্ষুদ্ধ হয়েছিল। (iv) ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার : ইংরেজ কর্মচারীরা ভারতীয় নৌ-সৈনিকদের গালিগালাজ ও অপমান করত। ইংরেজ কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে ভারতীয়রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল— এর প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য তারা বিদ্রোহ করেছিল। (v) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রভাব : ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের ব্যবহার না করার জন্য। নৌবাহিনীর সৈন্যরা দাবি করেছিল। তা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের প্রভাবও ভারতীয় নৌ-বাহিনীর ওপর পড়েছিল। (vi) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে নৌসেনাদের প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নৌসেনাদের ছাঁটাই করতে শুরু করে। এর ফলে তারা প্রবল আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে ও বিদ্রোহে শামিল হয়।
☉ নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল— (i) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর আরও একটি বড়াে মাপের সেনাবাহিনীর
বিদ্রোহ ছিল নৌবিদ্রোহ। নৌসেনাদের বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, ভারতে তারা আর বেশিদিন রাজত্ব করতে পারবে না। (ii) নৌবিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা প্রেরিত মন্ত্রীমিশন ভারতে যুক্তরাষ্ট্র গঠন ও সংবিধান সভার বিষয়ে সুপারিশ করে। পরিশেষে বলা যায়, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ উল্লেখযােগ্য গণসংগ্রাম ছিল নৌবিদ্রোহ। ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত বলেন যে, ‘এই বিদ্রোহ ভারত ইতিহাসে নবযুগের সূচনা করে”।