B.A 2nd Semester Sociology Notes Bengali Version Pdf Download | University Of Gour Banga 2022
প্রশ্নঃ ১১ লিঙ্গ বৈষম্য বলতে কি বোঝ? সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি প্রকারভেদ হিসেবে
লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, লিঙ্গ অসম্যতার কারণগুলি এবং প্রকারভেদ আলোচনা করো।
প্রশ্নঃ ১২ বিবাহের সংজ্ঞা
দাও। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহের গুরুত্ব আলোচনা করো।
অথবা, কেন বিবাহকে একটি সামাজিক
প্রতিষ্ঠান বলা হয়? তোমার অভিযোগটি বিশ্লেষণ করো।
প্রশ্নঃ ১৩ পরিবারের সংজ্ঞা
দাও। উদাহরণ সহকারে পরিবারের প্রকারভেদ আলোচনা করো।
অথবা, পরিবার কাকে বলে? উদাহরণ সহ পরিবারের ধরণগুলি আলোচনা করো। অথবা, পরিবারের প্রকারভেদের ওপর একটি টীকা লেখো।
প্রশ্নঃ ১৪ ভারতের যৌথ
পরিবারের কাঠামোয় পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা করো।
প্রশ্নঃ ১৫ বিবাহের মূল
ধারণা এবং প্রকারভেদগুলি আলোচনা করো।
❥ প্রশ্নও উত্তর নোটস ❥
প্রশ্নঃ ১১ লিঙ্গ বৈষম্য বলতে কি বোঝ? সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি প্রকারভেদ হিসেবে
লিঙ্গ বৈষম্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, লিঙ্গ অসম্যতার কারণগুলি এবং
প্রকারভেদ আলোচনা করো।
❍ ভূমিকা : স্তরবিন্যাসের গবেষণায়
লিঙ্গ বিষয়টি বহুদিন পর্যন্ত অন্ধত্ব হয়ে পড়ে ছিল। দীর্ঘদিন এইরূপ একটি মনোভাব
দেখা যায় যে সমাজে মহিলা নেই কিম্বা মহিলা থাকলেও সম্পদ এবং মর্যাদার বিশ্লেষণে
-র দিকে তাদের কোন গুরুত্ব নেই। তাই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ছিল নিষ্প্রয়োজনীয়।
তাছাড়াও এটি সত্য যে লিঙ্গ স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ। পৃথিবীতে
এমন কোন সমাজ ব্যবস্থা নেই যেখানে পুরুষরা সম্পদ, মর্যাদা ও প্রভাবের দিক থেকে
মহিলা অপেক্ষা বড় নয়। আধুনিক সমাজে লিঙ্গ ও স্তরবিন্যাস সংক্রান্ত পাঠে যে
সমস্যা প্রতিভাত হয় সহজ কিন্তু তার সমাধান করা অত্যন্ত দুরূহ। সুতরাং প্রশ্ন হল
শ্রেণী বিভাজনের ভিত্তিতে বর্তমানে আমরা কতটা লিঙ্গ-বৈষম্য বুঝি।
ও লিঙ্গবৈষম্য একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের বাস্তব অবস্থান তার বাবা অথবা স্বামীর অবস্থান অনুসারে স্থির হয়ে থাকে। সুতরাং লিঙ্গ বৈষম্যকে শ্রেণীর ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা দরকার। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকুরির সুযোগ সম্পত্তির মালিকানা, আয় এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলারা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হয়। তথাপি লিঙ্গগত বৈষম্যকে স্তরবিন্যাসের উপাদান হিসেবে ধরা হয়। কারণ অধিকাংশ মহিলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার পরিবারের মর্যাদা অনুযায়ী। তবে অনেক সময় মহিলারা পুরুষদের মতো কিছু মর্যাদা লাভ করে থাকে কিন্তু তাদের মর্যাদা পেশা দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার বাবা বা স্বামীর পেশার ভিত্তিতে।
❍ গোল্ডথ্রোপের বক্তব্য : গোল্ডথ্রোপ তাঁর শ্রেণী বিশ্লেষণে মহিলাদের অবস্থানকে ‘প্রথাগত অবস্থান' বলে অভিহিত করেন। তিনি মনে করেন বেতনভোগী মহিলাদের থেকে পুরুষদের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই মহিলারা স্বামীর সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত বলে বিবেচিত হয়। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি আংশিক সময়ের কর্মী এবং তাদের অনেকেই পূর্ণ সময়ের কাজের অভিজ্ঞতা থাকে না কারণ তাদের সন্তান বহন প্রতিপালনের জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলারা স্বামীর উপর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
তবে গোল্ডথ্রোপের বক্তব্য বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। অধিকাংশ
মহিলাদের আয় পরিবার পরিচালনায় অপরিহার্য। সুতরাং, পরিবারের শ্রেণী অবস্থান অনেক
সময় মহিলাদের বেতনের দ্বারা অংশত নির্ধারিত হয়। অনেক সময় স্ত্রী চাকুরী
স্বামীর সামাজিক অবস্থানকেও প্রভাবিত করে। কারণ মহিলারা কম আয় করলেও স্বামীর
অবস্থানে পরিবর্তন আনে। যেমন স্বামী যদি দক্ষ অথবা আধা দক্ষ কায়িক শ্রমিক হয়
এবং তার স্ত্রী কোন দোকানের ব্যবস্থাপক হয় তাহলে স্ত্রীর পেশা সমগ্র পরিবারের
অবস্থানের উন্নতি ঘটাতে পারে।
প্রশ্নঃ ১২ বিবাহের সংজ্ঞা দাও। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহের গুরুত্ব আলোচনা
করো।
অথবা, কেন বিবাহকে একটি সামাজিক
প্রতিষ্ঠান বলা হয়? তোমার অভিযোগটি বিশ্লেষণ করো।
অনুষ্ঠানের মাধ্যেমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক ও ব্যক্তিগত দিক থেকে বিচার করলে বিবাহ হল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই কারণে সামাজিক ও ব্যক্তিগত উভয় দিক থেকেই বিবাহের গুরুত্ব নির্ধারণ করা দরকার।
❐ সামাজিক গুরুত্ব :
১. বিবাহ পরিবারের প্রতিষ্ঠান : বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত রীতি অনুসারে পরিবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং পরিবারের প্রতিষ্ঠা করায় বিবাহের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মানব সমাজের একটি আবশ্যক ও ন্যূনতম একক সংস্থা হল পরিবার। সুস্থ পারিবারিক সংগঠন হল সমাজে
ঐক্য ও সংহতির সংরক্ষণের সহায়ক। আবার পারিবারিক সংগঠন বিবাহে ব্যবস্থার উপরই নির্ভরশীল।
২. নবজাতকের দায়িত্ব গ্রহণ : মানব শিশু সহজাত প্রবৃত্তির সাহায্যে সহজে স্বাবলম্বী হতে পারে না, কারণ মানব শিশু পশুর মতো নয়। মানব শিশুর যথোপযুক্ত প্রতিপালন ও পরিচর্যার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সমস্ত দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত ভাবে নির্দিষ্ট হওয়া বিশেষ ভাবে দরকার এই দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ পিতা-মাতার উপরেই বর্তায়। এর ফলে শিশুর সামাজিকীকরণে কোন অসুবিধে হয় না।
৩. যৌন সম্পর্কের সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা : সুস্থ স্বাভাবিক সমাজজীবনের স্বার্থে নারী-পুরুষের যৌন আচরণ অবাধ ও উচ্ছৃঙ্খল ভাবে চলতে দেওয়া যায় না। কারণ সে পরিবার জীবন এবং সমগ্র সমাজ জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে নারী-পুরুষের সহজাত দেহজ কামনাকে সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়।
৪. সমাজিক সম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় হয় : বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। বিবাহের মাধ্যমে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ উভয় পক্ষের পরিবারের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং উভয় তরফের পবিবারের নিকট ও দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি কুটুম্বদের মধ্যে আত্মীয়তার যোগসূত্র সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্ক ক্রমশ সমাজের মধ্যে সম্পর্কের জাল ছড়িয়ে দেয়।
❐ ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহের গুরুত্ব : বিবাহ ব্যবস্থা মানব সমাজে ব্যক্তির যৌন প্রবৃত্তিকে প্রশমিত করে। বিবাহ মানুষের যৌন ক্ষুধার পরিতৃপ্তির সহজ ও স্বাভাবিক সুযোগ প্রদান করে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা দরকার যে অবদমিত বা বিকৃত যৌন জীবন ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধ কতার সৃষ্টি করে। অবদমিত যৌন বাসনার কারণে ব্যক্তির মানসিক অসুস্থতা ও বিকৃতি দেখা দিতে পারে। ব্যক্তির যৌন কামনা বাসনা বিবাহিত জীবনের মাধ্যমে চরিতার্থ হয়। সন্তানের লালন পালন ব্যক্তির কাছে বিবাহের একটি বড় উদ্দেশ্য হল সন্তান প্রজনন ও বংশগতি অব্যাহত রাখা। তাই দেখা যায় দম্পতি মাত্রেই পুত্র সন্তান কামনা করে থাকে। হিন্দুদের ধর্মীয় বিধানে বলা হয় যে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, প্রকৃত প্রস্তাবে বিবাহিত জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য হল পরিবার বা বংশের ধারাবিকতাকে অব্যাহত রাখা।
হিন্দুদের কাছে বিবাহের ধর্মীয় ভূমিকার গুরুত্ব বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। হিন্দু শাস্ত্রের নির্দেশ হল বিবাহের পর স্বামী সহধর্মিনীর সহযোগে ধর্মাচারণ ও গাহস্থ্য ধর্ম পালন করবে এবং এর জন্যই বিবাহের কথা বলা হয়। বিবাহ নারী ও পুরুষের মধ্যে কেবল একটা যৌন সংযোগ সম্পর্কের বিষয় মাত্র নয়। বিবাহিত জীবনের মাধ্যমে পাওয়া যায় পারস্পরিক সাহচর্য ও সহানুভূতি, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা এবং সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতা। এই সুকোমল বৃত্তিসমূহ দম্পতির দেহজ কামনা-বাসনাকে বাস্তবে এক পবিত্র
আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করে থাকে।
প্রশ্নঃ ১৩ পরিবারের সংজ্ঞা দাও। উদাহরণ সহকারে পরিবারের প্রকারভেদ আলোচনা
করো।
অথবা, পরিবার কাকে বলে? উদাহরণ সহ পরিবারের ধরণগুলি আলোচনা করো। অথবা, পরিবারের প্রকারভেদের ওপর একটি টীকা লেখো।
❍ পরিবারের সংজ্ঞা : পরিবার কথাটির ইংরেজি হলো Family । এই শব্দটির এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Famulus’ থেকে । মানবসমাজে পরিবার হলো একটি অন্যতম প্রাথমিক গোষ্ঠী। এটি হলো সমাজ জীবনের একক স্বরূপ। সমাজজীবনে নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত সময়টি সে পরিবারের মধ্যেই অতিবাহিত করে। ভূমিষ্ঠ হবার পর মানবশিশু মানুষকে পরিবারে গড়ে তুলতে হয়। মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ বা জন্ম থেকে অসহায় অবস্থায় থাকে। স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত সে আশ্রয়, ভরণ-পোষণ প্রভৃতি তার পরিবারের মধ্যেই পেয়ে থাকে। অর্থাৎ সামাজিক সংগঠন হিসেবে পরিবার হলো একটি অপরিহার্য সংগঠন।
❐ বিভিন্ন সামাজিক মাপকাঠির ভিত্তিতে পরিবারকে কতকগুলি ভাগে ভাগ করা যায়।
সেগুলি হল নিম্নরূপ— (ক) পিতৃশাসিত ও মাতৃশাসিত পরিবার, (খ) একগামী ও
বহুগামী পরিবার, (গ) মাতৃবংশানুক্রমিক ও পিতৃবংশানুক্রমিক পরিবার, (ঘ)
পিতৃ-আবাসিক ও মাতৃ আবাসিক পরিবার (ঙ) একক পরিবার ও যৌথ পরিবার।
(ক) পিতৃশাসিত ও মাতৃশাসিত পরিবার : পরিবার কর্তৃত্বের অবস্থানের ভিত্তিতে পিতৃশাসিত ও মাতৃশাসিত পরিবার গড়ে উঠতে দেখা যায়। পরিবারের মহিলা অথবা পুরুষ কার অধীনে পরিবারের কর্তৃত্ব তার ভিত্তিতেই এই ধরণের পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেখা যায়। যখন কোন পরিবারের কর্তৃত্ব পিতার হাতে ন্যস্ত থাকতে দেখা যায় তখন তাকে পিতৃশাসিত পরিবার বলা হয়। যদিও আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পরিবার হল পিতৃশাসিত বা পিতৃতান্ত্রিক পরিবার, কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবারে নারী হল গৃহকর্ত্রী। গৃহকর্ত্রী হিসেবে পরিবারে নারীর ভূমিকা ও গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। অন্যদিকে যখন কোন পরিবারে মায়ের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তাকে বলা হয় মাতৃতান্ত্রিক অথবা মাতৃশাসিত পরিবার। প্রাচীনকালে আদিম মানবগোষ্ঠীর পারিবারিক জীবনে মায়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে অনেক ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। মাতার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পিতার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না।
(খ) একগামী ও বহুগামী পরিবার : যৌন সম্পর্কের স্বীকৃতির ভিত্তিতে পরিবারকে একগামী ও বহুগামী— এই দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ধরণের পরিবারের ক্ষেত্রে বলা যায় একগামী পরিবার এক পতি ও এক পত্নী নিয়ে গড়ে ওঠে। এই ধরণের পরিবার ব্যবস্থায় এক পতি ও পত্নীর মধ্যে যৌন সম্পর্ক সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। অন্যদিকে এক পতি ও একাধিক পত্নী অথবা এক পত্নী ও একাধিক পতি নিয়ে গড়ে ওঠা পরিবারকে বহুগামী পরিবার বলে। এই ধরণের পরিবারে এক পতি ও একাধিক পত্নী ও এক পত্নী ও একাধিক পতির মধ্যে যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় সর্বজন স্বীকৃত পরিবার ব্যবস্থা হল একগামী পরিবার।
পিতা-পুত্র-পৌত্র এই ধারা অনুসরণ করে। মাতৃবংশানুক্রমিক পরিবারের ক্ষেত্রে কন্যা পরিবারের সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী হয়ে থাকে।
(ঘ) পিতৃ-আবাসিক ও মাতৃ আবাসিক পরিবার : বিবাহের পর স্বামী ও স্ত্রীর বাসস্থানের ভিত্তিতে পরিবারকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। পিতৃ-আবাসিক ও মাতৃ-আবাসিক পরিবার। বিবাহের পর স্বামী যখন তার স্ত্রীর মাতৃগৃহে গিয়ে বসবাস করে তখন তাকে বলা হয় মাতৃআবাসিক পরিবার। অন্যদিকে বিবাহের পরিবার
পর স্ত্রী যখন তার স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাস করে তখন তাকে পিতৃ আবাসিক বলা হয়।
(ঙ) একক পরিবার ও যৌথ পরিবার : একক পরিবার ও যৌথ পরিবার হল পরিবার ব্যবস্থার আরেকটি প্রকারভেদ। একক পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায় স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের এক বা একাধিক সন্তানকে নিয়ে গড়ে ওঠে। স্বামী, স্ত্রী, সন্তান এই কয়েকজনের মধ্যে একক পরিবারের সদস্যসংখ্যা সীমিত থাকে। তাছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল একক পরিবারের মধ্যে কেবলমাত্র পিতা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান এই দুই পুরুষ একত্রে বসবাস করে। তার অন্যদিকে আকার-আয়তনের দিক থেকে একক পরিবারের তুলনায় যৌথ পরিবারের আকার অনেক বেশী বৃহদায়তন। রক্তের সম্পর্কের যোগসূত্রের
ভিত্তিতে কতকগুলি একক পরিবারের সমষ্টি হল যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারে দেখা যায় পুত্র বা কন্যারা বিবাহের পর যখন তাদের স্ত্রী বা স্বামী নিয়ে পিতামাতার সংসারে বসবাস করে, তবে সাধারণত বলা যায় যে পিতা-মাতার মৃত্যুর পর এই ধরণের পরিবার ব্যবস্থা একক পরিবারে ভেঙে পড়ে।
যৌথ পরিবার সম্পর্কে অধ্যাপক সচ্দেব ও বিদ্যাভূষণ বলেছেন—
“An extended family may be crammed into a single house, or it may occupy
a cluster of houses within an extended family compound or the houses may
be more widely dispersed than this. The Hindu family is an extended
family."
❍ উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমান আধুনিক সভ্যতার যুগে ও সমাজ
ব্যবস্থায় বহুগামী পরিবার ও যৌথ পরিবারের আধিক্য পূর্বের তুলনায় হ্রাসমান
হয়েছে। একক পরিবার বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সর্বজনস্বীকৃত একটি পরিবার
ব্যবস্থা। অধ্যাপক ডেভিস
(Kingsley Davis)- এর মতে আধুনিক শিল্প সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন স্বামী-স্ত্রীর পরিবার।
(Kingsley Davis)- এর মতে আধুনিক শিল্প সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীন স্বামী-স্ত্রীর পরিবার।
প্রশ্নঃ ১৪ ভারতের যৌথ পরিবারের কাঠামোয় পরিবর্তন সম্বন্ধে আলোচনা
করো।
❍ ভূমিকা : সমাজ উৎপত্তির সময় থেকে পরিবার প্রথার প্রচলন হয়েছে। পরিবার একটি পরিবর্তনশীল সংস্থা হিসেবে পরিগণিত। পরিবর্তন সমাজের প্রতিটি অঙ্গে অঙ্গে অনুভূত হয়। পরিবারের পরিবর্তন সাধারণত দুই দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। i. কাঠামোগত পরিবর্তন (Structural Change) ii. কার্যগত পরিবর্তন (Functional Change)❐ i. কাঠামোগত পরিবর্তন :
1. যৌথ পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তন : সাম্প্রতিককালে শিল্প সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। এই ঘটনা উপর জীবনের ব্যাপক বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। এইসবের ফলশ্রুতি হিসেবে সাবেকী যৌথ পরিবারগুলির ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভেঙ্গে পড়া সাবেকী যৌথ পরিবারগুলির জায়গায় গড়ে উঠেছে দম্পতিকেন্দ্রিক একক পরিবার।
2. জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব প্রদান : বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া হয়। মানুষের মধ্যে বর্তমানে সাধারণভাবে পরিবার ছোটো করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এর ফলশ্রুতি হিসেবে বহু পরিবারের সদস্যসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। আধুনিক সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়।
আদেশ মান্য করে চলত। কিন্তু বর্তমানে নানাবিধ পারিবারিক সম্পর্ক সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
4. মহিলাদের মর্যাদার পরিবর্তন : আধুনিক শিল্প সভ্যতার যুগে মহিলাদের শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে আর্থিক নির্ভরশীলতা বেড়েছে, ফলে মহিলাদের প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
❐ ii. কার্যগত পরিবর্তন :
1. পরিবারের ঐতিহ্যপূর্ণ কার্যের গুরুত্ব হ্রাস : পরিবারের চিরাচরিত কাজকর্মের গুরুত্ব পূর্বের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আধুনিক পরিবারে বর্তমানে কোনোরকম উৎপাদন কার্য নেই বললেই চলে পরি -বারের সদস্যগণ শুধুমাত্র একসঙ্গে আহার করা ছাড়া আর কোনো কাজ প্রায় করে না। উপার্জন কারী ব্যক্তিগণের আয়সমূহ সংসারের খরচের জন্যে ব্যবহার করা হয়।
2. শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে অন্য সংস্থার হস্তক্ষেপ : আধুনিককালে শিশুদের যাবতীয় শিক্ষার ভার পরিবার তথাপি পিতা-মাতার পরিবর্তে কিন্ডার গার্টেন, প্রাইমারী স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ গ্রহণ করেছে।
3. বিবাহব্যবস্থায় বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রাধান্য হ্রাস : পরিবারের ভিত্তি রচিত হয় বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে। আধুনিক পরিবারগুলিতে বিবাহব্যবস্থার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য পরিবর্তন দেখা যায়। আগেকার দিনে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক প্রতিটি কাজেই পরিবারের বয়োজ্যোষ্ঠ মানুষের মতামত প্রাধান্য
পেত, কিন্তু বর্তমান রোমান্টিক বিবাহের প্রচলন পূর্বের সাবেকী পরিবারের নিয়ন্ত্রণশীল ভূমিকাকে শিথিল করে দিয়েছে।
উপসংহারঃ পরিবারের কাঠামোগত এবং কার্যগত পরিবর্তন একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটির পরিবর্তন ঘটলে আরেকটির পরিবর্তন ঘটবেই, তবে এই পরিবর্তন সাবেকীকালের সমাজ এবং বর্তমানকালের সমাজ এই দুইটির মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করে এই কাঠামোগত ও কার্যগত পরিবর্তন।
প্রশ্নঃ ১৫ বিবাহের মূল ধারণা এবং প্রকারভেদগুলি আলোচনা করো।
ভূমিকা : সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বিবাহ একটি
সামাজিক প্রতিষ্ঠান। প্রাচীনকাল থেকে বিবাহ গঠনের পশ্চাতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি
প্রাধান্য পেত। বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি নয়, এটি একটি কর্তব্য ও দায়িত্ব হিসেবে
দেখা হয়।
বিবাহের মূল ধারণা : নতুন প্রজন্মের সুষ্ঠ বিকাশের ক্ষেত্রে বিবাহের অবদান অনস্বীকার্য। বিবাহের দ্বারা নতুন দম্পতির মধ্যে যেমন আইনি, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক জোট গঠন হয়, ঠিক তেমনি দুটি পরিবারের মধ্যেও সামাজিক মেলবন্ধন ঘটে। সমাজকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল পরিবার। প্রসঙ্গত অধ্যাপক ম্যালিনোস্কির মতে – বিবাহের দ্বারা স্ত্রী পুরুষের সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠে এবং বিবাহের ফলে জাত সন্তান সামাজিক মর্যাদা পায় ও দম্পতির পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে।
প্রকারভেদ : বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলি
সর্বব্যাপী হলেও সমাজের বিভিন্ন ধরণের রীতিনীতি, আচার, অনুষ্ঠান প্রচলিত রয়েছে।
সকল সমাজেই বিবাহকে কেন্দ্র করে আইন, প্রথা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক নিয়মবিধি,
স্থান ও কালের থেকে পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। নিম্নে কতকগুলি বহুল
প্রচলিত ধরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
❍ একগামিতা বিবাহ (Monogamy)
❍ বহুগামিতা বিবাহ (Polygamy)
❍ বহুপত্নীত্ব (Polygyny)
❍ বহুপতিত্ব (Polyandry)
❍ একগামিতা বিবাহ (Monogamy)
❍ বহুগামিতা বিবাহ (Polygamy)
❍ বহুপত্নীত্ব (Polygyny)
❍ বহুপতিত্ব (Polyandry)
❍ একগামিতা বিবাহ (Monogamy) : যখন সমাজে একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষ বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় এবং একত্রে সংসার ধর্মকে প্রতিপালন করে, তখন সেই বিবাহকে একগামিতা বলে। একগামিতা বিবাহের ক্ষেত্রে আজীবন সেই বিবাহ বন্ধন অক্ষুণ্ণ থাকবে। কেবলমাত্র কোন একজনের মৃত্যু হলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে পুনরায় বিবাহ হতে পারে। সমাজতাত্ত্বিকদের মতে এই বিবাহ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত এবং এই বিবাহের ফলে নারী পুরুষের যৌন সংক্রমণের আশঙ্কাও থাকে না। তাছাড়া পরিবারের মধ্যে স্নেহ-প্রীতি- ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একগামিতা আইন স্বীকৃতএই বিবাহ বন্ধনের ফলে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ে ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।
❍ বহুগামিতা বিবাহ (Polygamy) : বহুগামিতা বিবাহের ক্ষেত্রে একজন পুরুষ একের বেশি মাহিলাকে বিবাহ করতে পারে আবার একজন নারী একাধিক পুরুষকে বিবাহ করতে পারে। মারডক (Murdock) -এর মতে এই বিবাহের দুটি ধরণ দেখা যায়। যথা-
❍ বহুপত্নীত্ব (Polygyny)
❍ বহুপতিত্ব (Polyandry)
❍ বহুপত্নীত্ব (Polygyny) : অধ্যাপক লুই-এর মতে নারী পুরুষের ভারসাম্য হীনতার কারণেই বহুপতিত্ব বিবাহ গড়ে ওঠে এবং তিনি এটাও বলেন বহুগামিতা বিবাহ সংস্কৃতিও সমাজ দ্বারা স্বীকৃত। কিছু কিছু সমাজ জীবনে অনেক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার কারণে এই ধরণের বিবাহ
ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায় কৃষিকাজে অনেক বেশি লোকে সাহায্যের দরকার হয়। সেই শ্রম যদি বাড়ীর সদস্যদের থেকে পাওয়া যায় তাহলে আর্থিক সাশ্রয় হয়। সেই কারণেও বহুপতিত্ব বিবাহ দেখা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়ীর প্রথম স্ত্রী তার কাজের বোঝাকে কমানোর জন্য স্বামীর বিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে আসে। যাতে সাংসারিক কাজের বোঝা কেবল একজনের উপর না পড়ে তা সকলের মধ্যে বণ্টন হয়ে যায়। এ ধরণের বিবাহ ভারতে নাগা, গোন্দ, বৈগা, টোডা আদিবাসীদের মধ্যে দেখা যায়।
❍ বহুপতিত্ব (Polyandry) : এই ধরণের বিবাহের ক্ষেত্রে একজন মহিলা একাধিক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ করে। যদি একই ধরণের বিবাহে সকল ভাই একই পরিবারের হয় তাহলে তাকে বলে স-ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিত্ব (Fraternal Polygandry)। আবার যদি স্বামীরা একই পরিবারের না হয় কিন্তু স্ত্রী একটাই হয় তাহলে সেই ধরণের বিবাহকে অ-ভ্রাতৃত্বমূলক বহুপতিত্ব (Non- fraternal Polygandry) বলে।