ঊনবিংশ-শতাব্দীতে-নারী-প্রশ্ন-কেন-একটি-কেন্দ্রীয়-বিষয়-হয়ে-দাঁড়িয়েছিল?

Q. ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী প্রশ্ন কেন একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
❐ ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল এমন একটি যুগ যেখানে নারীর অধিকার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। একে নারীয় যুগ বলা যা, কারণ প্রায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী নারীর ভালমন্দ, তাদের আশা-আকাঙ্খা-সম্ভাবনা ইত্যাদি ছিল জোরদার আলোচনার বিষয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই ইউরোপে নারী সম্পর্কিত সচেতনতা বিকাশ লাভ করতে শুরু করেছিল। ফরাসি বিপ্লাবের মূলমন্ত্রই ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই শতাব্দীর শেষের দিকে নারী সম্পর্কিত ধারণা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানীতে র‍্যাডিক্যালদের দ্বারা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রুশ র‍্যাডিক্যাল সংস্কারকদের মধ্যে নারী প্রশ্ন একটি কেন্দ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারতবর্ষেও নারী সমাজের প্রতি অসৎ-আচরণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিন্দাবর্ষণের পাশাপাশি এগুলির উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল। মিশনারীরা এই আন্দোলনের সূচনা করলেও ক্রমেই ভারতীয় সমাজ সংস্কারদের দ্বারা এই আন্দোলন বাংলা ও মহারাষ্ট্র হয়ে সারা ভারতে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতকে ভারতে নারী আন্দোলনের মুখ্য বিষয় :
“নারীকে আপন ভাগ্যজয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা।”
রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলিই প্রমাণ করে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দীর্ঘদিন পুরুষ প্রাধান্যের শিকার হয়ে ভারতের নারী সমাজকে ভোগ করতে হয়েছে দীর্ঘ যন্ত্রণা ও অত্যাচার। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের অধিকার যতই বর্ধিত হয়েছে ততই নারী হয়েছে গৃহবন্দি, অধিকারহীন ও পর্দার আড়ালে পুরুষের একভোগের সামগ্রী। শুধু তাই নয়, কেড়ে নেওয়া হয়েছে সতীদাহের নামে নারীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার। উনিশ শতকের মনীষীরা সতীদাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, কন্যা সন্তানের হত্যা প্রভৃতি কু-প্রথার উচ্ছেদ সাধন করতে এবং বিধবা বিবাহ প্রচলন ও পর্দাপ্রথার অবসান করতে উদ্যোগী হন। স্ত্রীলোকের শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে যে সকল বাধা নিষেধ ছিল তা দূর করে স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারে তারা আগ্রহী হন। 
তাঁদের প্রচেষ্টায় ঊনবিংশ শতাব্দীর আন্দোলন মূলতঃ নারী মুক্তি আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। উনিশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত এই আন্দোলন ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বিশেষত খ্রিষ্টান মিশনারী ও ভারতীয় মনীষী যথা রাজা রামমোহন রায়, ডিরোজিও, কেশবচন্দ্র সেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের প্রচেষ্টায় বিকশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের স্তরে উত্তীর্ণ হয়। স্বামী বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশন, দয়ানন্দ প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজ, আত্মরাম পান্ডুরঙ্গ প্রতিষ্ঠিত প্রার্থনা সমাজ, অ্যানি বেসান্তের পরিচালনাধীনে থিওসফিক্যাল সোসাইটি এই পর্যায়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতে নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা : ভারতে নারী আন্দোলনের সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নিয়েছিল দুটি বিপরীত সংস্কৃতির সংঘাতের ফল হিসাবে। পাশ্চাত্য আধিপত্যের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে ভারতে এই সময় যে বুর্জোয়া সমাজ গড়ে উঠেছিল তারা সমাজ সংস্কারের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠে। এরাই মূলত জাতিভেদ, মূর্তিপূজা, সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। পাশাপাশি বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে তারা আন্দোলন শুরু করে। এই সমস্ত বিষয়ের কেন্দ্রিয় চরিত্র ছিল নারীসমাজ। অন্যদিকে ভারতের চিরাচরিত সংস্কৃতি যা এতদিন ধরে নীরবে চলে এসেছিল তার সঙ্গে বিবাদ বাধে। যেমন সতীদাহ প্রথা ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনপ্রিয়তা লাভ করলেও এর বিরুদ্ধে ভারতীয় বুর্জোয়ারা ও খ্রিস্টান মিশনারীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিল।
রাজা রামমোহন রায় : নারী কল্যাণকে যিনি প্রথম সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের অর্ধাংশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে কখনই গোটা সমাজে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি প্রথমেই সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। ১৮২৯ খ্রিঃ তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৭নং রেগুলেশন জারী করে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই কুপ্রথা নিষিদ্ধ করেন। সম্ভবতঃ এর থেকেই নারী অধিকার সংক্রান্ত আইনের সংস্কার শুরু হয়। এছাড়াও তিনি ভারতীয় নারীর কল্যাণের জন্য বেশ কয়েকটি সমস্যা নিয়ে জনমত গঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। যেমন বাল্যবিবাহ, কৌলিন্যপ্রথা, বিধবা বিবাহ, বিবাহ সংক্রান্ত আইনকানুন পরিবর্তন, শিক্ষার বিস্তার, সম্পত্তিতে অধিকার দান ইত্যাদি। তিনি মনে করতেন এই সমস্যাগুলির সমাধান ছাড়া নারী কল্যাণ কোনভাবেই সম্ভব নয়, সমাজ ব্যবস্থার উন্নতিও সম্ভব নয়। ভারতীয় নারী জাতির কল্যাণে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। তাঁর প্রদর্শিত পথেই পরবর্তীকালে নারী কল্যাণ কর্মসূচিগুলি রূপান্তরিত করার চেষ্টা হয়েছিল।

কেশবচন্দ্র সেন : রামমোহন পরবর্তী সময়ে নারীমুক্তি আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী ‘পত্রিকা’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এছাড়া এই আন্দোলনে ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৮৭২ খ্রিঃ ভারতীয় বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তিত হয়। এর দ্বারা বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ হয়, অসবর্ণ ও বিধবা বিবাহ স্বীকৃত হয়। ব্রাহ্মনেতারা স্ত্রীশিক্ষার স্বপক্ষে এবং পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর ও বিধবা বিবাহ আন্দোলন : বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ সংক্রান্ত আন্দোলন। তাঁর এই আন্দোলনকে ব্রাহ্মরা ও নব্যবঙ্গীয়রা সমর্থন জানায়। অন্যদিকে হিন্দুধর্ম সভার মুখপাত্ররা এর তীব্র বিরোধিতা করতে থাকে বিদ্যাসাগর বুঝতে পারেন সরকারী সাহায্য ছাড়া বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করা সম্ভব হবে না। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার পর ১৮৬৫ খ্রিঃ সরকার হিন্দু বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং একটি আইনও বিধিবদ্ধ করে। এছাড়াও তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও কৌলিনা প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বিদ্যাসাগার স্ত্রী-শিক্ষাকে আন্দোলনের স্তরে উন্নীত করেছিলেন। ১৮৪৯ খ্রিঃ বেথুন সাহেবের সঙ্গে বেথুন স্কুল স্থাপন করেন। সরকারী সাহায্য ছাড়াই গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বস্তুত পক্ষে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের এই আন্দোলনগুলিকে কেন্দ্র করেই মূলত নারী মুক্তির বিষয়টি সমস্ত ভারতের চিন্তাশীল সমাজকে আলোড়িত করেছিল। অন্যান্য আন্দোলন― (১) প্রার্থনা সমাজ : ১৮৬৭ খ্রিঃ মহারাষ্ট্রে প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন আত্মারাম পান্ডুরঙ্গ। এর কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল নারী কল্যাণ, বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, পর্দা প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলি। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা রাণাডে স্থাপন করেন বিধবা বিবাহ সমিতি, দাক্ষিণাত্য শিক্ষক সমিতি। 

বিধবাদের পুনর্বিবাহ ও সার্বিক সাক্ষরতা প্রসারে এই দুই সমিতি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। (২) আর্য সমাজ : ১৮৭৫ খ্রিঃ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী হিন্দুধর্ম ও সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে প্রার্থনা সমাজের প্রতিষ্ঠা করেন। এর পাশাপাশি স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, বিধবা বিবাহ, কৌলিন্য প্রথা ও পণ প্রথার বিরুদ্ধেও আর্য সমাজ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। (৩) রামকৃষ্ণ মিশন আন্দোলন : শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। এই আন্দোলন ছিল মানবতাবাদী আন্দোলন। নারী জাতি শুধু ভোগের উপকরণ নয়, শক্তিরূপী মহামায়ার আর এক রূপ শিক্ষা এ আন্দোলন দিয়েছিল।
উপসংহার : ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল এমন একটি যুগ যেখানে নারীর অধিকার ও অন্যান্য বিষয় ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই শতাব্দীকে নারীর যুগও বলা যায়। কারণ প্রায় সমগ্র বিশ্বব্যাপী নারীর ভাল-মন্দ, তাদের সম্ভাবনা ইত্যাদি ছিল এই শতকের জোরদার আলোচনার বিষয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষেও নারী সমাজের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিন্দাবর্ষণ শুধু হয় প্রথমে মিশনারীদের দ্বারা,তারপর সমাজ সংস্কারকদের দ্বারা প্রধানত বাংলা ও মহারাষ্ট্রে। ধীরে ধীরে অবশ্য তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এদেরই আন্দোলনের ফলে যুগ যুগ ব্যাপী লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত ভারতীয় নারী তার অধিকার অনেকটাই ফিরে পেয়েছিল।

✈︎ Read More Article :

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন