উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন (WBHA) টেস্ট পেপার ২০২৪
A. বিকল্প উত্তরগুলির মধ্যে থেকে সঠিক উত্তরটি বেছে নিয়ে লেখো: (প্রতিটি প্রশ্নের মান-১)
1. Parallel Myths গ্রন্থের লেখক―
(a) জে এফ বিয়ারলেইন
(b) ডবলিউ গ্রিম
(c) হেরোডোটাস
(d) ডডওয়েল
2. রাজতরঙ্গিণী রচনা করেন―
(a) কৌটিল্য
(b) কলহন
(c) বিলহন
(d) কালিদাস
3. পৃথিবীর প্রাচীনতম জাদুঘর হল—
(a) ব্রিটিশ মিউজিয়াম
(b) এননিগালডিনান্না-র জাদুঘর
(c) ল্যুভর মিউজিয়াম
(d) রোমান মিউজিয়াম
4. ‘মিউজিয়াম’ কথাটি এসেছে—
(a) লাতিন শব্দ মসিয়ান থেকে
(b) গ্রিক শব্দ মউসিয়ন থেকে
(c) ইংরেজি শব্দ মিউজিয়ম থেকে
(d) a ও b দুই-ই ঠিক
5. বৈজ্ঞানিক ইতিহাসচর্চার জনক কে?
(a) থুকিডাইডিস
(b) হেরোডোটাস
(c) সু-মা-কিয়েন
(d) ইবন খালদুন
6. “সব ইতিহাসই সমকালীন ইতিহাস”—উক্তিটি করেছেন—
(a) ক্রোচে
(b) র্যাংকে
(c) র্যালে
(d) ই এইচ কার
7. Early History of India গ্রন্থের লেখক—
(a) জন স্টুয়ার্ট মিল
(b) জেমস মিল
(c) জেমস প্রিন্সেপ
(d) ভিনসেন্ট স্মিথ
৪. ‘মিথ’ কথাটি এসেছে যে শব্দ থেকে—
(a) গ্রিক শব্দ মিথোস
(b) লাতিন শব্দ মিথোস
(c) গ্রিক শব্দ মিথুন
(d) লাতিন শব্দ মিথুন
9. আমি নেতাজীকে দেখেছি—গ্রন্থটির লেখক কে?
(a) মণিকুন্তলা সেন
(b) দক্ষিণারঞ্জন বসু
(c) নারায়ণ সান্যাল
(d) প্রফুল্ল দাস
10. ল্যুভর মিউজিয়াম অবস্থিত—
(a) ফ্রান্সে
(b) জার্মানিতে
(c) ইংল্যান্ডে
(d) হল্যান্ডে
11. জীবনের জলসাঘরে কার আত্মজীবনী?
(a) দক্ষিণারঞ্জন বসু
(b) মণিকুন্তলা সেন
(c) নারায়ণ সান্যাল
(d) মান্না দে
B. নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও: (প্রশ্নের মান-৪)
1. লোককথা কাকে বলে? লোককথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য-সহ ইতিহাসচর্চায় লোককথার গুরুত্ব আলোচনা করো।
2. স্মৃতিকথা ও মৌখিক ঐতিহ্য বলতে কী বোঝো? ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলির গুরুত্ব কী?
3. আধুনিক ইতিহাস লিখতে গেলে একজন ঐতিহাসিককে কীভাবে আধুনিক ইতিহাসের লিখন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়?
4. জাদুঘর কাকে বলে? অতীত পুনর্নির্মাণে জাদুঘরের ভূমিকা/বিভিন্ন ধরনের জাদুঘরের পরিচয় দাও।
--------------------------------------------------
1. লোককথা কাকে বলে ? লোককথার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
➛ লোকসমাজের প্রচলিত এক ধরনের কাল্পনিক গল্প। যেগুলি অতীত ইতিহাসের ঘটনা অনুকরণে গড়ে ওঠে, তাদের লোককথা বলে। মূলত অতীতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে বংশপরম্পরায় এই গল্পগুলি প্রচলিত হয়ে আসছে। এই লোককথার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন বিভিন্ন পণ্ডিতগণ, যেমন- কার্ল ও লিঞ্চ ব্রাঞ্চ এর মতে- " মানুষের জীবন ও কল্যাণ এর সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা গল্পগাথাকেই লোককথা বলে।" আবার আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন-" গদ্যের ভীতর দিয়া যে কাহিনী প্রকাশ করা হয়, তাহাকেই সাধারণভাবে লোককথা বলে।"
✸ লোককথার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য-সহ গুরুত্ব :
১. শ্রুতি নির্ভর : লোককথা গুলি কোন লিখিত আকারে পাওয়া যায় না এগুলি লোকের মুখে মুখে প্রচলিত বয়স্কদের কাছ থেকে কম বয়সীরা শুনে শুনে মনে রাখে।
২. সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয় : বিভিন্ন দেশের লোক কথা থেকে সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের ধর্মবিশ্বাস খাদ্যাভ্যাস সংস্কার পোশাক-পরিচ্ছদ সমাজের রীতি-নীতি প্রভৃতির পরিচয় পাওয়া যায় লোককথার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
৩. চরিত্র : লোককথার গল্পগুলি কাল্পনিক হলেও এর চরিত্রগুলি মূলত সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে এই লোককথাগুলি গড়ে উঠেছে।
৪. ইতিহাসের ধারণা : লোককথা অলিখিত ঐতিহাসিক উপাদান কারণ এগুলি থেকে অতীতের সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রভৃতির তথ্য পাওয়া যায়।
৫. ঐতিহ্য : লোককথাগুলিতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই বিশ্বের লোককথাগুলি বৈচিত্র্যময়। যেমন- আলিবাবা চল্লিশ চোর, আরব্য রজনী, পঞ্চতন্ত্র প্রভৃতি।
৬. জনপ্রিয়তা : লোক কথাগুলি অতীতকাল থেকে মানুষকে বিনোদন প্রদান করে চলেছে। ফলে কোনো কোনো লোককাহিনীর জনপ্রিয়তা ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে।
৭. নীতি শিক্ষা : সাধারণত সন্তানদের বুদ্ধিমান ও নীতিবান করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই লোককথাগুলি।
২. স্মৃতিকথা ও মৌখিক ঐতিহ্য বলতে কী বোঝো? ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলির গুরুত্ব কী?
✸ স্মৃতিকথা ও মৌখিক ঐতিহ্য : স্মৃতি বলতে মনে রাখা বিষয়কে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে নিকট অতীতকে স্মরণ করা যায়। কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁর জীবনের ফেলে আসা সময়ের কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ বা প্রকাশ করে অতীতকে স্মরণ করে। এইভাবে অতীত স্মরণকেই বলা হয় স্মৃতিকথা। উদাহরণ – জ্যোতি বসুর লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্ৰন্থ “যতদূর মনে পড়ে” ইংরেজ শাসন ও স্বাধীন ভারতের ইতিহাস জানতে সাহায্য করে।
মৌখিক ঐতিহ্য হল এমন এক সংস্কৃতিক ধারণা যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে লোকমুখে প্রচলিত হয়। জান ভ্যানসিনা বলেছেন, মৌখিক ঐতিহ্য হল এক ধরণের মৌখিক বার্তা যা কথা, গান প্রভৃতির মাধ্যমে মুখে মুখে পূর্ববর্তী প্রজন্ম অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছায়। Oral History Association – এর মতে, “অতীতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষের কন্ঠস্বর, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও চর্চা করাকেই মৌখিক ইতিহাস বা মৌখিক ঐতিহ্য বলে”। উদাহরণ – (i) প্রচীন গ্রিসের ইতিহাস (ii) নীলকরদের অত্যাচারের ইতিহাস ইত্যাদি।
✸ ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলির গুরুত্ব :
১.অতীত দিনের ঘটনা তুলে ধরা : স্মৃতিকথাগুলিতে বিগত সময়ের বাস্তব ঘটনাগুলি উঠে আসে। তাই অতীত দিনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরার ক্ষেত্রে স্মৃতিকথার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন— সুফিয়া কামালের একাত্তরের ডাইরী গ্রন্থে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার কথা উঠে আসে।
২. অলিখিত : মৌখিক ঐতিহ্য প্রধানত মুখে মুখে প্রচারিত হয় বলে প্রাথমিকভাবে এর কোনো লিখিত ইতিহাস থাকে না। গান, লোকগাথা ইত্যাদি থেকে প্রাপ্ত মৌখিক তথ্যগুলি অবশ্য পরবর্তী সময়ে ইতিহাস রচনা করার ক্ষেত্রে কাজে লাগে। তাই লোকমুখে প্রচলিত মৌখিক ঐতিহ্য অলিখিত হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
৩. প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা : কোনো লেখক অতীতের কোনো ঘটনা তাঁর স্মৃতিকথায় প্রয়োজন অনুযায়ী উল্লেখ করে থাকেন। অতীতের ওই বিশেষ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্মৃতিকথায় তাঁর দেওয়া বিবরণের গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে। অনেক গুণী ব্যক্তির স্মৃতিকথায় তাঁর নিজের জীবনের নানান গুরুত্বপূর্ণ কাহিনি ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সমাজকর্মী হেলেন কেলারের ‘দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ’-এর কথা উল্লেখ করা যায়। এতে তিনি প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।
৪. ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা : ইতিহাস রচনা করার সময় অনেক ক্ষেত্রে স্মৃতিকথার প্রয়োজন পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে ইতিহাস রচনা করার ক্ষেত্রে মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। এই গ্রন্থে তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস ও তৎকালীন বিভিন্ন নেতার ভূমিকা তুলে ধরেছেন।
৫. আদর্শগত ও পদ্ধতিগত দিকের ব্যবহার : মৌখিক ঐতিহ্যে আদর্শগত ও পদ্ধতিগত—দুটি দিক দেখতে পাওয়া যায়। অনেক সময় সমাজের নীচু শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মানুষদের ইতিহাস জানতে এ দুটি দিকের প্রয়োজন পড়ে। ওইসব মানুষরা কোনো আদর্শকে অবলম্বন করে তাদের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করছেন কিনা সেটা মৌখিক ঐতিহ্যের দ্বারা জানা যায়। এবং সেখানকার মানুষের মুখের কথা, প্রচলিত গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদি পদ্ধতির মধ্য দিয়েও ইতিহাস রচনার উপাদান পাওয়া যায়।
৩. আধুনিক ইতিহাস লিখতে গেলে একজন ঐতিহাসিককে কীভাবে আধুনিক ইতিহাসের লিখন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়?
ভূমিকা : ইতিহাস হল গতিশীল সমাজবিজ্ঞান। তাই প্রায়ই ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রয়োজন দেখা দেয়। নতুন আবিষ্কার বা তত্ত্বের আলোকে অতীত ঘটনাবলির পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ইতিহাসের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি ইতিহাস রচনার পদ্ধতিও হয়ে উঠেছে জটিল। তাই আধুনিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কার্যপ্রণালী লক্ষ ও অনুসরণ করা হয়।
✸ ইতিহাস রচনার লিখন পদ্ধতি অনুসরণ :
১. তথ্যের ওপর গুরুত্ব : ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের প্রধান মাধ্যম অবশ্যই তথ্য। কেন-না, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ঐতিহাসিকদের পক্ষে ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। তাই ঐতিহাসিকরা লিপি, মুদ্রা, স্মৃতিস্তম্ভ, সরকারি দলিল দস্তাবেজ, সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি প্রভৃতি থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করেন।
২. ঐতিহাসিক ঘটনা নির্বাচন : ঐতিহাসিক ঘটনা নির্বাচন ঐতিহাসিকদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। অতীতের সমস্ত ঘটনাই ইতিহাসের বিষয় হতে পারে না। তাই অতীতের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে থেকে ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত বিষয়কে ঐতিহাসিকরা বাছাই করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, বিজ্ঞান হল বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞানাত্মক বোধশক্তির নির্বাচনমূলক পদ্ধতি। বিজ্ঞানের মতো ইতিহাসও তাই বহু ঘটনার মধ্যে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় ঘটনার নির্বাচন।
৩.বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা : একজন ঐতিহাসিকের বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা পূর্ণভাবে বিচার করার ক্ষমতা থাকা উচিত। তিনি ওই অভিজ্ঞতা যতটা ইতিহাস রচনার কাজে লাগাবেন তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ ততই সমৃদ্ধ হবে। কেবলমাত্র নিজের দেশ ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা তাঁর লেখাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলবে।
৪. মানবসমাজের বিভিন্ন দিক : বর্তমানে ইতিহাসের পদ্ধতি অনেক বিসতৃত হয়েছে। লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবসমাজের বিভিন্ন দিকের আলোচনা। রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতিসমস্ত বিষয় নিয়েই মানব ইতিহাস। ইতিহাস যে শুধুমাত্র রাজা বা রাজবংশ, যুদ্ধ বা কূটনীতির কাহিনি অথবা ধর্ম ও নীতিকথা প্রচারের মাধ্যম নয়, আধুনিক ইতিহাসচর্চায় তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে একটি বিষয়ের ওপর অযথা জোর না দিয়ে প্রত্যেকটি বিষয়কেই প্রয়োজনমতো উপস্থাপিত করা আধুনিক ঐতিহাসিকদের কর্তব্যে পরিণত হয়।
৫. বর্তমান ও অতীতের সংযোগ : ই. এইচ. কার এই অভিমত পোষণ করেন যে, ইতিহাস হল বর্তমান ও অতীতের মধ্যে অন্তহীন সংলাপ। যে ইতিহাসে কোনো সমস্যার সমাধান নেই অথবা নতুন কোনো চিন্তাধারার সন্ধান নেই, সে ইতিহাস ঘটনাপঞ্জির বর্ণনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইতিহাস অতীত সম্পর্কিত বিতর্কের যত বেশি অবসান ঘটাতে পারবে এই বিষয়ের মূল্য ততই বৃদ্ধি পাবে। তাই আধুনিক ঐতিহাসিকদেরও এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্নতা থাকবেই। কিন্তু কতগুলি,অপরিবর্তনীয়। মূল ধারণা রয়েছে যেগুলি প্রায় সব ঐতিহাসিকই ব্যবহার করে থাকেন। এর মধ্য দিয়ে সর্বজনসম্মত ইতিহাস রচনা প্রণালীর সন্ধান পাওয়া যায়।
৪. জাদুঘর কাকে বলে? অতীত পুনর্নির্মাণে জাদুঘরের ভূমিকা/বিভিন্ন ধরনের জাদুঘরের পরিচয় দাও।
গ্রিক শব্দ ‘mouseion’ থেকে মিউজিয়াম শব্দটি এসেছে। মিউজিয়ামের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে জাদুঘর বা সংগ্ৰহশালা কথাটি ব্যবহৃত হয়। সাধারণ অর্থে জাদুঘর হল বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক উপাদানের সংগ্রহশালা। এখানে ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, শিল্প-বিষয় প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ নমুনা সংরক্ষণ করে তা জনসাধারণের জন্য স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে প্রদর্শনের যে ব্যবস্থা করা হয় তাকে জাদুঘর বলে।
✸ অতীত পুনর্নির্মাণে জাদুঘরের ভূমিকা : পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন জাদুঘরের ভূমিকা ভিন্নমুখি হতে পারে। জাদুঘরের প্রধান উদ্দেশ্য ও ভূমিকা হল― ১.সংগ্ৰহ, ২.সংরক্ষণ, ৩. প্রতিকৃতি নির্মাণ, ৪. প্রদর্শন, ৫.গবেষণার কাজে সহায়তা, ৬.আনন্দ দান।
১. সংগ্ৰহ : হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শন বা নমুনা গুলি সংগ্ৰহ করে ইতিহাস রচনার দরজা উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে জাদুঘর অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
২. সংরক্ষণ : বর্তমানে জাদুঘর গুলিতে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক উপাদান সংরক্ষিত থাকে। যেমন – প্রাচীন মুদ্রা, লিপি, বিভিন্ন শিল্পকলা, প্রত্নতাত্ত্বিক বস্ত্র, আশ্চর্যজনক বস্তু, বিভিন্ন মডেল, চার্ট ইত্যাদি।
৩. প্রতিকৃতি নির্মাণ : অতীতের যে সব নিদর্শন দুষ্প্রাপ্য কিন্তু মূল্যবান সেগুলির প্রতিকৃতি নির্মাণ করে জাদুঘর দর্শকদের সেই বস্তু সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে এবং ঐতিহাসিক নমুনা গুলির সাহায্যে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৪. প্রদর্শন : জাদুঘর অতীতের দুর্লভ ঐতিহাসিক বস্তু সামগ্রী সাধারণ দর্শক, পাঠক, গবেষক প্রভৃতি সব ধরনের মানুষের প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এবং জাদুঘরে সংরক্ষিত বস্তু গুলির পাশে দেওয়া তথ্য থেকে মানুষ সংরক্ষিত বিষটি সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
৫. গবেষণার কাজে সহায়তা : যে কোনো মানুষের সংগ্রহ করা ঐতিহাসিক নমুনা জাদুঘরে সংরক্ষিত হতে পারে। এই নমুনা গুলির প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে গবেষণার সুযোগ করে দেওয়া জাদুঘরের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য বা কাজ। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানগুলির সাহায্যে জাদুঘর ইতিহাসকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
৬. আনন্দ দান : অতীত ইতিহাসের বাস্তব অস্তিত্ব আছে জাদুঘরে। জাদুঘরে সাধারণ দর্শকদের সংখ্যাই বেশি হয়। তাদের কাছে জাদুঘর হল লঘু জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে কিছু আনন্দ লাভের স্থান। জাদুঘর বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেই আনন্দ মানুষকে দিয়ে থাকে।
✸ বিভিন্ন ধরনের জাদুঘরের পরিচয় :
(১) বিশ্বকোশ জাদুঘর : বিশ্বকোশ জাদুঘর বলতে সুবৃহৎ, বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের জাতীয় জাদুঘরকে বোঝায়, যেখানে বিপুল সংখ্যক দর্শকের প্রবেশের সুযোগ থাকে এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিষয়ের বিপুল ও অসাধারণ সংগ্রহ থাকে। বিশ্বকোশ জাদুঘরের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হল ব্রিটিশ মিউজিয়াম। ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে ‘সর্বজনীন জাদুঘর’ বলা হয়।
(২) প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর : প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে কেবলমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করা হয়। এই ধরনের জাদুঘর দুইধরণের হতে পারে—খোলা জায়গায় অবস্থিত এবং অট্টালিকার অভ্যন্তরে অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের উদাহরণ হল ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান মিউজিয়াম।
(৩) শিল্প জাদুঘর : শিল্প জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকলা সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এসব শিল্পকলা মৃৎশিল্প, আসবাবপত্র, ধাতুর ফলকে খোদিত শিল্প, ভাস্কর্য, চিত্র, নকশা প্রভৃতি নানা ধরনের হতে পারে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসমোলিয়ান জাদুঘর হল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক শিল্প জাদুঘরের উদাহরণ।
(৪) ঐতিহাসিক গৃহ জাদুঘর : কোনো প্রাচীন ঐতিহাসিক গৃহকে কেন্দ্র করে যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়, তা ঐতিহাসিক গৃহ জাদুঘর নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক গৃহ বলতে কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির জন্মস্থান বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ছিল এমন বাড়ি হতে পারে। ঐতিহাসিক গৃহ জাদুঘরে বিভিন্ন নথিপত্র, মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রভৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগে অবস্থিত হাজার দুয়ারি একটি ঐতিহাসিক গৃহ জাদুঘরের উদাহরণ।
(৫) সামরিক জাদুঘর : সামরিক জাদুঘরে কোনো দেশের সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধসংক্রান্ত নানা নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। সাধারণত এই জাদুঘরে যুদ্ধকালীন অস্ত্রশস্ত্র, অন্যান্য সামরিক সরপ্তাম, সেনাদের পোশাক প্রভৃতি নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। ‘কানাডিয়ান ওয়ার মিউজিয়াম’ প্রভৃতি হল সামরিক জাদুঘরের উদাহরণ।
(৬) বিজ্ঞান জাদুঘর : বিজ্ঞান জাদুঘর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিস্ময় প্রভৃতি বিষয়ের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে থাকে। বিজ্ঞানের জাদুঘরগুলি কম্পিউটার, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি পৃথক পৃথক বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে পারে। শিকাগোর ‘মিউজিয়াম অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ হল একটি বিজ্ঞান জাদুঘর। পরিশেষে বলা যায় জাদুঘর হল অতীতের স্মৃতিচিহ্ন এবং বর্তমানের যোগসূত্র। তাই অতীত পুণর্গঠনের ক্ষেত্রে জাদুঘরের ভূমিকা অপরিসীম।