ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্বদেশী শিল্পের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য নির্ণয় করো?


Q. ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসের প্রেক্ষিতে স্বদেশী শিল্পের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য নির্ণয় করো?
ভূমিকা : স্বদেশী যুগে যেসব শিল্পোদ্যোগীর কর্মকান্ডের পরিচয় আমরা পায় তারা মূলত দুই ধরনের সামাজিক শ্রেণি থেকে উদ্ভুত হয়েছিল। প্রথমঃ মধ্যবিত্ত শ্রেণি যার মধ্যে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক, রসায়নবিদ, উকিল, স্কুল শিক্ষক ও অধ্যাপকরা। দ্বিতীয় হস্তশিল্পীরা যাঁরা বর্ধমান, বরিশাল, হাওড়া, কলকাতা সহ আরো অনেক অঞ্চলে ছোট-মাঝারি আকারের কারখানা গড়ে তুলেছিল জমিদার শ্রেণির একাংশ যারা রংপুর, পাবনা, নদীয়া সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু স্বদেশি কোম্পানী গড়ে তুলেছিল। এরা অনেকাংশ ছিলেন আত্মনির্ভরশীল এবং নিজের উদ্যোগে স্বাধীনভাবে স্বদেশি শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

✽ সামাজিক উৎস : ভারতে বৃহৎ বুর্জোয়াদের উদ্ভব ঘটেছিল বণিক, ব্যাঙ্কার, দালাল, ফাটকাবাজ, জুয়ারি শ্রেণি থেকে। বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন রসায়নবিদ ও রসায়নের অধ্যাপক। সাধনা ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা যোগেশচন্দ্র ঘোষও ছিলেন রসায়নের অধ্যাপক। পি.এম. বাগচি অ্যান্ড কোং এর প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীমোহন বাগচি এসেছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে এই স্বদেশী কোম্পানির ভারতবর্ষে প্রথ রাসায়নিক কালীর প্রস্তুতাকরক। পেশায় উকি রমেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ জেলায় গেঞ্জি ও জাঙ্গিয়া বানানোর একটি কারখানা প্রস্তুত করেন। পাবনা জেলা সে যুগে ছিল হোসিয়ারী দ্রব্য প্রস্তুতের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র, শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মথুরামোহন চক্রবর্তী পেশায় ছিলেন ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। চব্বিশ পরগনা জেলার নাটাগড়ের বনমালি কর্মকার এক লোহার কারিগর যন্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন।

✽ আদিম সঞ্চয়ের পদ্ধতি : ছোট ও মাঝারি বুর্জোয়ারা আদিম পুঁজি সঞ্চয়ের পদ্ধতি থেকে সরে আসে। প্রফুল্লচন্দ্র রায় অধ্যাপনার মাধ্যমে উপার্জনের টাকা জমিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন । ডঃ নীলরতন সরকার চিকিৎসক হিসাবে জমানো অর্থ দিয়ে প্রস্তু করেন ন্যাশনাল ট্যানারি। মাঝারি স্বদেশি কোম্পানিগুলি মৌলিক গবেষণার ভিত্তিতে দ্রব্য প্রস্তুতে গুরুত্ব দিতে থাকে।

✽ কারখানার স্থান নির্বাচন ও কারখানা বানানোর পরিকল্পনা : কারখানার স্থান নির্বাচন ও তাঁর পরিকাঠামো নির্বাচনে বৃহৎ বুর্জোয়ারা নির্ভর করতেন বিদেশী বিশেষজ্ঞদের ওপরে অন্যদিক স্বদেশি বস্ত্র তৈরির কারখানা মোহিনী মিলের কর্ণধার মোহিনীমোহন চক্রবর্তী তার কারখানার সমস্ত পরিকল্পনা নিজে করেন। হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হারান আয়ুর্বেদীয় ঔষাধালয় স্থাপন করেন বাঁকুড়ার গ্রামাঞ্চলে কারণ। সেই ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে এলাকা থেকে ঔষধ তৈরির গাছগাছড়া সংগ্রহ করা অনেক সহজ হয়।

✽ কোম্পানীর পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ : স্বদেশী কোম্পানীগুলি ভারতীয়দের হাতেই কোম্পানির পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। বেঙ্গল হোসিয়ারী কোং-এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মেসার্স ডবলিউ এন.বোস অ্যান্ড কোম্পানি। বঙ্গলক্ষী কটন মিল, মোহিনী মিল জবকুসুম কেশ তৈল প্রস্তুত কারকের পরিচালক ছিলেন সি.কে.যেন এন্ড কোং।

✽ যন্ত্রপাতি : ভারতবর্ষে শিল্পায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিদেশ থেকে ক্রমশ বেশি পরিমাণে যন্ত্রপাতি আমদানি এর কারণ এই নয় যে ভারতীয় কারিগরদের দক্ষতার অভাব ছিল কিংবা এদেশে দেশী প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেনি। এর মূল কার ছিল, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দেশীয় শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় প্রযুক্তিকে ধ্বংস করে ভারতবর্ষের মাটিত বিদেশী শিল্প স্থাপন করা। তাঁতবস্ত্র, সিগারেট, দেশলাই বিদেশ থেকে আমদানি করা মেশিন দিয়ে উৎপাদন করা হতো। অন্যদিক ছোট মাঝারি বুর্জোয়াদের অনেকেই নিজেরা নিজেদের কারখানায় যন্ত্র বসাতেন এবং সেই যন্ত্রে উৎপাদন করতেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ শ্রীথে মিল-এর কর্ণধার উদয় কুমার দাস নিজেই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এবং নিজের কারখানার সব মেশিন তিনি নিজে প্রস্তুত করেছিলেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের সব মেশিন তাদের নিজেদের কারখানাই তৈরি হতো। তাদের এই আত্মনির্ভরতা তাদের বিদেশী নির্ভরতার দিক ঠেলে দেয়নি। কিন্তু তাদের যন্ত্রপাতি তাঁদের কারখানার ব্যবহারর জন্যই ছিল, তা ব্যবহারের জন্য পণ্য হয়নি। তবে বেশ কিছু স্বদেশী কর্মোদ্যোগী বাজারের বিক্রির জন্য যন্ত্র বানিয়েছিল।

✽ বাজার : বাজারের জন্য ছোট ও মাঝারি বুর্জোয়ারা দেশি দোকানের উপর নির্ভর করতো। ঔপনিবেশিক যুগে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু সংখ্যক ছোট ও বড় দোকান গড়ে উঠেছিল। যার মাধ্যমে স্বদেশী দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি হতো। এই বিষয়ে লক্ষ্মীর ভান্ডার, ভারত ভান্ডার, ছাত্র ভান্ডার, খাদি ভান্ডার, ফেক্টো প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

✽ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি : ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্ৰ, আদিত্য মুখার্জি প্রমুখরা মনে করেন যে, ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি কোনভাবেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। স্বদেশী বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিদের অনেকেই ব্রিটিশ শাসন বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।ইস্ট-ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস-এর অন্যত কর্ণধার হীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিপ্লবী সংগঠন যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়াকার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রমোহন বসু ব্রিটিশ বিরোধি বিপ্লবী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালিন কারারুদ্ধ হন। এই সবই ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিরোধিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন