Q. ঔপনিবেশিক আমলে কৃষির বাণিজ্যিকরণ ভারতীয় কৃষিকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল?
✽ কৃষির বাণিজ্যিকরণ কী : কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ বলতে কেবলমাত্র উৎপাদনের ভোগ্যপণ্যে পরিণত হওয়া বা নগদ টাকার জন্য কৃষিজ উৎপাদনকে বোঝায় না। প্রাক-ব্রিটিশ যুগেও চাষের ফসলের বাজার ছিলো। কিন্তু তার জন্য ভারতীয় কৃষিতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আসেনি। বাণিজ্যিকরণ কথাটি আরো অনেক বেশি অর্থবহ। বাণিজ্যিকিরণ বলতে বোঝায় কৃষকদের স্বেচ্ছায় বাজার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া। জমির বাজার, কৃষিপণ্যের বাজারের বিকাশ এবং কৃষকের স্তর বিন্যাস এই সমস্ত কিছুরই পরিণতি কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন।✽ ভারতে ঔপিনিবেশিক আমলে কৃষির বাণিজ্যিকিকরণ : ভারতের ব্রিটিশ শাসনকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির হয়। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে কৃষকরা মূল্যের ওঠানামায় এবং বাজারের চাহিদায় সারা দিয়েছিল। বিশ শতকের প্রথম দশকে পরিবর্তন ও পরিকাঠামোর উন্নতির ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং প্রধান কৃষি পণ্যগুলির একটি অভ্যন্তরীণ জাতীয় বাজার গঠিত হয়েছিল।
✽ কৃষির ওপর প্রভাব : ঔপনিবেশিক সরকার ভারতের কৃষিতে যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তগুলি এনেছিল তার ফল ঐতিহ্যকে গন্ডিবদ্ধ সম্পত্তির অধিকার পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত অপ্রতিহত ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এই নতুন অধিকারের দ্বারা লাভবান ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক তারতম্য ছিল। সরকারের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব চাহিদা এবং খাজনা বৃদ্ধির বিষয়ে জমিদারদের ওপর আইনি নিয়ন্ত্রণের অভাব কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ করে তুলেছিল। ঔপনিবেশিক আমলে যেভাবে কৃষিপণ্যের বাজার তৈরি হয়েছিল তা পূর্বের তুলনায় ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। প্রথমঃ পরিমানগত পার্থক্য অর্থাৎ মোট উৎপাদনের অনেকটা বাজারে আসতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ ঔপনিবেশিক অর্থনীতির আওতায় ইংল্যান্ডের শিল্পায়নের চাহিদা ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারকে প্রভাবিত করেছিল। ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব ও খাজনার অতিরিক্ত চাহিদা কৃষকদের বাজারমুখী করে তোলে, রাজস্ব ও খাজনার চাহিদা
মেটাতে হত নগদ টাকায়, অথচ কৃষকদের কাছে নগদ টাকার ঘাটতি ছিল। তাই পণ্যের বাণিজ্যের প্রয়োজন দেখা দিল তাছাড়া বীজ, কৃষি সরঞ্জাম, গবাদি পশু ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের প্রায় ঋণ নিতে হত। ভারতের বিভিন্ন স্থানের শস্য বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ আসত পণ্যের মাধ্যমে। দুইটকোম্ব ও শাহিদ আমীন দেখিয়েছেন, বাধ্যতামূলকভাবে নগদ টাকায় রাজস্ব এবং খাজনা দেওয়ার জন্য কৃষকরা প্রায়ই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তেন। খাজনা মেটানো ও ঋণ পরিশোধের তাগিদ কৃষকদের জবরদস্তিমূলক বাণিজ্যিকরণের দিকে নিয়ে যায়। ইরফান হাবিব দেখিয়েচেন যে, মুঘল যুগের থেকে ব্রিটিশ যুগের এক বড়োসড়ো বিচ্যুতি চোখে পড়ে। খাদ্যশস্যের ফলন কমে যায়, আবহাওয়া জমির বিশেষত্ব ও পরিবেশ অনুযায়ী ভারতের এক এক অঞ্চলে এক এক ধরনের অর্থকারি শস্যের চাষ শুরু হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মোট যত একর জমিতে আখ চাষ হতো, তার 53.4%, 27.84% যথাক্রমে যুক্তপ্রদেশ ও বাংলায় চাষ হত। পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যুক্তপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশে গম চাষের হার ছিল যথাক্রমে 35.24%, 25.3% এবং 10.3% মাদ্রাজে 77.3% চীনাবাদাম উৎপন্ন হত। বম্বে, বেরার ও হায়দ্রাবাদে তুলাচার্যের হার ছিল যথাক্রমে 30.88%, 15.85% এবং 13.94%। ধান ও পাট চাষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল বাংলা। 1930-31 খ্রিঃ নাগাদবাংলার মোট আবাদি জমির 72.5 জমিতে ধান চাষ এবং 10.7% জমিতে পাট চাষ হত। কিন্তু ব্রিটিশ আইন জমিকে হস্তান্তরযোগ্য সম্পত্তিতে পরিণত করে। জমি বন্ধকি রেখে ঋণ গ্রহণের বিষয়টি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়। এই নতুন বিকাশ চাষিদের অর্থকরী শস্য ফলানোর মনোযোগী করে তোলে। উনিশ শতকর অন্তিম লগ্ন থেকে দেখা যায় যে, বন্ধকি ঋণের অধিকাংশটাই ছিল কৃষির সঙ্গে যুক্ত মহাজনদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ভাড়াতে চাষির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কৃষক তার উৎপাদনের একটা বড়ো অংশ খাজনা হিসাবে দিয়ে দিতে বাধ্য হন। আগে কৃষক ভূমি রাজস্ব হিসাবে যা দিতেন তার থেকে এর পরিমাণ ছিল অনেকটাই বেশি।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ভারতে কৃষির বাণিজ্যিকরণের ফলে অর্থকরী শস্য ফলনের দিকে ঝোঁক বেড়ে যায় এবং কৃষি অর্থনীতি মারাত্মক ভারসাম্যহীনতার শিকার হয়। কৃষির বাণিজ্যিকরণের প্রত্যক্ষ পরিণতি ছিল কৃষকদের ঋণভারে জর্জরিত হওয়া এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে মহাজন ও বনিয়াদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়া।