শ্রমিকদের মজুরি জনিত সমস্যা ও বাসস্থানের সমস্যা কীভাবে তাদের সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল?


Q. শ্রমিকদের মজুরি জনিত সমস্যা ও বাসস্থানের সমস্যা কীভাবে তাদের সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল?
মজুরিজনিত সমস্যা : ভারতীয় শ্রমিকরা শ্রমিক হবার পূর্বে গ্রামীণ অর্থনীতির শহরের কারখানাগুলিতে কাজের জন্য ভিড় করেছিল তখন আর্থিক দিক থেকে অন্নের সংস্থান করার জন্য শহরে এসে তারা মজুর হয়েছিল। ভারতবর্ষের নানা গ্রাম থেকে সর্দার দালাল। মিস্ত্রী শ্রেণির লোকেরা মালিকদের স্বার্থে এই সব মানুষদের এনে জড়ো করত। শহরে এনে তাদের কাজের ব্যবস্থা করত এবং এর বিনিময়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে ‘দস্তুরি’ বা উৎকোচ আদায়। অন্যদিকে ভারতীয় পুঁজিপতি শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের নিঃস্ব ও আর্থিকভাবে অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের উপর এক অমানুষিক শোষণ  ও অত্যন্ত নিম্নমানের মজুরি চাপিয়ে দিয়েছিল।
মজুরির হার : ভারতের প্রধান দুটি শিল্প বস্ত্রশিল্প ও পাটশিল্পের শ্রমিকদের মজুরির হার আলোচনা করলেই ভারতীয় শ্রমিকদের মোটামুটিভাবে গড় মজুরির একটা চিত্র পাওয়া যায়। 1982 খ্রিঃ বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষরা মাসিক 12 টাকা, নারীরা মাসিক 9 টাকা, শিশুরা মাসিক 6 টাকা মজুরি পেত। এই মজুরি পরবর্তী 30 বছরে আর বাড়েনি। 1892-93 খ্রিঃ বাংলায় পাট কলগুলিতে নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষরা দিনে গড়ে 9 আনা, মহিলারা দিনে গড়ে 5 আনা ও শিশুরা দিনে গড়ে 2 আনা উপার্জন করত। বেদলি, সোমপ্রকাশ প্রভৃতি পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায় চা বাগিচার মালিকগন শ্রমিকদের ইচ্ছেমতো খাটিয়ে মাসে মাত্র 3 টাকা থেকে 317, টাকা মজুরি পেত। প্রতিবাদ করলে বিনিময়ে তারা পেত চড়-চাপড়, বেত্রাঘাত।

শ্রমিকদের সমাজ জীবনের ওপর প্রভাব : অস্বাভাবিক নিম্ন মজুরি ও ভয়াবহ আর্থিক দূরাবস্থার ফলে শ্রমিকদেজর জীবন ধারণ অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে উঠেছিল অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। চাল, ডাল, গম, লবন ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যা জীবিকা নির্বাহের জন্য একান্ত অপরিহার্য ছিল তা পূর্বের চেয়ে অনেক অধিক দামে কিনত হত। অথচ মজুরি বৃদ্ধি সেই অনুপাতে একেবারেইহ হয়নি। বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমিকদের অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছে ছিল।

K.L. Datta এর “Report on the Enquiry into the rise of pries in India” প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেলেও মজুরির হার একই রকমের ছিল বা কোন কোন ক্ষেত্রে পতনও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে বোম্বাই-এর বস্ত্রকলগুলির তুলনায় বাংলার পাটকলগুলিতে এই জুরিবৃদ্ধির হার প্রায় কিছুই চিল না বলা যেতে পারে। অস্বাভাবিক নিম্ন মজুরি ও অন্যদিকে আকাশছোঁয়া দাম শ্রমিকদের আতিক জীবনে নিয়ে এসেছিল চরম দুর্দশা। এর ফলে প্রায় তারা অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থাকত। এই চরম আর্থিক সংকট একসময় তাদের প্রতিবাদের পথে যেতে বাধ্য করেছিল।
শ্রমিকদের বাসস্থান সমস্যা : শ্রমিকদের বাসস্থান এবং জীবনধারণের অন্যান্য দিকের অবস্থান ছিল অবর্ণনীয়। ভারতবর্ষের সুদূর গ্রাম-গঞ্জ থেকে যে মানুষের দল কাজের সন্ধানে এসে ভিড় করেছিল, তাদের আবাস স্থল ছিল ঘিঞ্জি, স্যাঁতস্যাঁতে, দুর্গন্ধময়, মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী, পুঁজিপতি মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের বসবাসের কোন ব্যবস্থার কতা আদৌ ভাবনাচিন্তা করেননি বললেই চলে। দীর্ঘ টালবাহানার পর শ্রমিক সংগঠনগুলির আন্দোলনের চাপে অল্প সংখ্যক মালিককে এই ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করতে এবং কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়।

বস্তি জীবন : শ্রমিকরা তাদের কর্মসংস্থানের আশেপাশে গড়ে ওঠা বস্তিগুলিতে নিজেদের আবাসস্থল খুঁজে নিতে বাধ্য হতো। এই বস্তিগুলির অবস্থা ছিল জঘন্য। 1906 খ্রিঃ সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার বি. ফোলে কলকাতা, হাওড়ার শিল্পাঞ্চালের শ্রমিক বস্তিগুলি পরিদর্শন করে সমস্যার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা দেখে হতবাক হয়ে যান। তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন কুলিরা যে অবস্থায় বসবাস করতে তা অকল্পনীয়। এই বস্তিগুলিতে কোন রকম জলের ব্যবস্থা বা জল নিষ্কাশণের ব্যবস্থা ছিল না। বস্তির এক একটি ঘরে যেখানে দু-তিনজন থাকা কঠিন ছিল সেখানে পাঁচ বা ততোধিক, শ্রমিক, পরিবার-পরিজন থাকত। এরকম ঘিঞ্জি, আলো-বাতাসহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার ফলে তারা নানা ধরনের রোগের শিকার হত এবং অকালে প্রাণ হারাত।

1911 খ্রিঃ প্রতিবেদন : 1911 খ্রিঃ আদমসুমারির অনুসারে দেখা যায় প্রায় সব শিল্পাঞ্চলেই 69% শ্রমিক এক কামরা বিশিষ্ট বাসস্থানে বাস করত। অর্থাৎ গড়ে সাড়ে চারজন লোক একসঙ্গে একটা ঘরে বসবাস করত। এই শ্রমিক বস্তিগুলি ছিল পরিকল্পনাহীন নোংরা। এক একটি ঘরে একাধিক পরিবার পরিজন থাকত। এর ফলে কোন পরিবারে কোন ‘Privacy’ বলে কিছু ছিল না। একই ঘরে শ্রমিকরা আগুন জ্বেলে রান্না বান্না করত এরফলে যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটত। বস্তির জঞ্জাল যাতাযাতের সরু রাস্তাগুলিতে স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে থাকত। শ্রমিকদের এই নরকবাস তাদের স্বাস্থ্যের চরম ক্ষতি করেছিল এবং তারা নানামারাত্মক ব্যধির কবলে পড়েছিল।
উপসংহার : বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে পুঁজিপতি মিল মালিকগণ, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের চাপে এবং শ্রমিক অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি এড়ানোর জন্য কিছু কিছু ‘কুলি লাইন’ তৈরি করে দিলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ছিল। আবার এই কুলি লাইনে ছিল মালিকদের দাদালদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আধিপত্য ও কঠোর অত্যাচারের চাপ। এর ফলেও শ্রমিকদের বসবাস অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল।

Type Here ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন