নবম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায় অনুশীলনী প্রশ্ন উত্তর | ফরাসি বিপ্লবের কয়েকটি দিক
❐ আরো পড়ুনঃ IX History
{tocify} $title={Table of Contents}
Q১. নতুন ফরাসি সংবিধান (১৭৯৫ খ্রি.) সম্পর্কে লেখো?
ভূমিকাঃ রোবসপিয়ারের মৃত্যুদণ্ডের পর জ্যাকোবিনদের পতন ঘটে এবং জিরন্ডিস্ট ও মধ্যপন্থী দল ক্ষমতা লাভ করে। ফলে শাসনতন্ত্রে বুর্জোয়া ও মধ্যবিত্তদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
❏ ফ্রান্সের নতুন সংবিধান : [1] প্রতিবিপ্লব : জিরন্ডিস্ট দলের শাসনকালে প্রতিবিপ্লব প্রকাণ্ড রূপ নেয়। মৃত রাজা ষোড়শ লুই-এর ভাই অষ্টাদশ লুই ভেরোনা থেকে এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ফ্রান্সে আগেকার রাজতন্ত্র ও ‘পুরাতনতন্ত্র’ ফিরিয়ে আনার কথা ঘোষণা করেন। [2] সংবিধান প্রণয়ন : ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের ফিরে আসার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ দূর করতে জাতীয় কনভেনশন ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে দ্রুত একটি সংবিধান চালু করে। বুর্জোয়া শ্রেণির মুখপাত্র বয়েসি দ্য অ্যাংলাস এই সংবিধান রচনা করেন।
[3] সাংবিধানিক পদক্ষেপ : ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের দ্বারা— [i] নাগরিকদের অধিকার ঘোষাণার পাশাপাশি তাদের কর্তব্যের কথা ঘোষণা, [ii] সর্বসাধারণের ভোটাধিকারের পরিবর্তে সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার, [iii] দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন, [iv] শাসনকার্য পরিচালনার জন্য পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদের একটি ‘ডাইরেক্টরি’ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। [4] বিদ্রোহ প্রতিরোধ : জাতীয় কনভেনশন প্রবর্তিত ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান অভিজাত, রাজতন্ত্রী, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, প্যারিসের জনতা—কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারা কনভেনশনের অধিবেশনে অভিযান চালালে সেনাপতি নেপোলিয়ন সহজেই বিদ্রোহ দমন করেন। ফলে ফ্রান্সে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণি আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে।
উপসংহার: ১৭৯৫ সালের ফরাসি সংবিধান প্রকৃতপক্ষে ১৭৯৩ সালে গণতান্ত্রিক সংবিধানের চেয়ে রক্ষণশীল ছিল। এই সংবিদানের দ্বারা কেন্দ্রীয় শাসনের শক্তি বৃদ্ধি এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হ্রাস পায়
Q২. টীকা লেখো : ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণা।
ভূমিকাঃ ফরাসি সংবিধান সভা মূল সংবিধান রচনার আগে ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা' ('Declaration of Rights of Man and Citi-zen') নামে একটি দলিল প্রকাশ (২৬ আগস্ট, ১৭৮৯ খ্রি.) করে।
❏ ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা: [1] ঘোষণাপত্রের ভিত্তি : ফরাসি সংবিধান সভা কর্তৃক প্রকাশিত ‘ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্র' রচনার ক্ষেত্রে ‘আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এবং ইংল্যান্ডের ‘ম্যাগনাকার্টা’ ও ‘বিল অব রাইট্স’, লক, রুশো, মন্তেস্ক প্রমুখ দার্শনিকের মতাদর্শ প্রভৃতির বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। [2] মানুষের অধিকার ঘোষণা : ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রে বলা হয় যে—[i] মানুষ জন্মগতভাবে মুক্ত ও স্বাধীন, [ii] মানুষের জন্মগত অধিকারগুলি পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয়, [iii] আইনের চোখে সব মানুষ সমান, [iv] রাষ্ট্রের প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হল জনগণ, [v] যোগ্যতা অনুসারে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার অধিকারী, [vi] বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি হল মানুষের সর্বজনীন অধিকার।
[3] সীমাবদ্ধতা : ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন—[i] ঘোষণাপত্রে সামাজিক সাম্যের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। [ii] এতে মানুষের অর্থনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। [iii] এতে শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। [iv] মানুষের সংগঠিত আন্দোলন করার অধিকার সম্পর্কেও ঘোষণাপত্রটি নীরব থেকেছে। [v] নাগরিকের অধিকারের কথা বলা হলেও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ঘোষণাপত্রে কিছুই বলা হয়নি।
[4] গুরুত্ব : কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণাপত্রের গুরুত্বকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক ওলার বলেছেন যে, এই ঘোষণার মাধ্যমে “বিশেষ অধিকার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার ও সাম্যের নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” কোবান মনে করেন যে, এই ঘোষণাপত্র “বিশেষ অধিকারের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছে।”
উপসংহার: ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকার ঘোষণাপত্রের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই ঘোষণাপত্রই সামন্ততান্ত্রিক পুরাতনতন্ত্রের সমাধি রচনা করে। এতে আধুনিক গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলির স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। তাই ঐতিহাসিক ওলার বলেছেন যে, এই ঘোষণাপত্র ছিল “পুরাতনতন্ত্রের মৃত্যু পরয়ানা।”
অধ্যায় (৫) বিংশ শতকে ইউরোপ | |||
---|---|---|---|
(১/২) মার্কের নোটস | (৪) মার্কের নোটস | (৮) মার্কের নোটস | MCQ Test |
Click Here | Click Here | Click Here | Click Here |
Q৩. ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে লেখো।
অথবা, ফরাসি বিপ্লবে ‘নারী’-দের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
ভূমিকাঃ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি রাজা ষোড়শ লুই স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকলে বুর্জোয়ারা সেখানে তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশনে বসা এবং সদস্যদের মাথাপিছু ভোটের দাবি জানায়। বিপদগ্রস্ত রাজা বাধ্য হয়ে তা মেনে নিলেও খুব শীঘ্রই মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্যাভাব প্রভৃতি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় শ্রেণির লোকেরা বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ৷
❏ ফরাসি বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ : তৃতীয় শ্রেণির অন্যতম দরিদ্র নারীরা ফরাসি বিপ্লবে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। [1] খাদ্যাভাব : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ভাগে ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করে। খাদ্যের দাবিতে প্যারিসে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে খাদ্যের দাবিতে প্রায় ৬ হাজার মহিলা ৫ অক্টোবর প্রবল বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে মিছিল করে ভার্সাই রাজপ্রাসাদ অভিযান করে।‘রুটি চাই’ ধ্বনিতে মিছিল মুখরিত হয়। লাফায়েৎ-এর নেতৃত্বে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ২০ হাজার সদস্য এই মিছিল অনুসরণ করে এগোতে থাকে।
[2] রাজতন্ত্রের শবযাত্রা: আন্দোলনকারী নারীরা ৬ অক্টোবর রাজপ্রাসাদের রক্ষীদের হত্যা করে এবং সমগ্র রাজপরিবারকে বন্দি করে প্যারিসে আসতে বাধ্য করে। ঐতিহাসিক রাইকার এই ঘটনাকে ‘রাজতন্ত্রের শবযাত্রা' বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার: ফরাসি বিপ্লবে সদেশের নারীরা তাদের সক্রিয়তার প্রমাণ দেয়—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে তারা বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করা, অবৈধ সন্তানের স্বীকৃতি লাভ, রাজনৈতিক ক্লাব গঠন প্রভৃতি বিভিন্ন অধিকার লাভ করে।
Q৪. বাস্তিল দুর্গের পতন ও তার গুরুত্ব লেখো।
ভূমিকাঃ ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই বুর্জোয়াদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করলেও তিনি পুরাতনতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে জনপ্রিয় অর্থমন্ত্রী নেকারকে পদচ্যুত এবং প্যারিস ও ভার্সাইয়ে সেনা মোতায়েন করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্যারিসের জনতা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ ও দখল করে নেয়।
❏ বাস্তিল দুর্গের পতনের গুরুত্বগুলি হল—
[1] রাজার নতিস্বীকার : বাস্তিলের পতনের পর আতঙ্কিত রাজা প্যারিসে এসে বিপ্লবের তেরঙা (লাল-নীল-সাদা) পতাকাকে ফ্রান্সের প্রতীক বলে মেনে নেন। বিপ্লবী বেইলি-কে প্যারিস পৌরসভার মেয়র পদে বসানো হয়। জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে সংগঠিত করে বিপ্লবী লাফায়েৎ-কে এর প্রধান সেনাপতি করা হয়। [2] স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে আঘাত : কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র ও মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের প্রতীক। এখানে বিনা বিচারে প্রজাদের বন্দি করে রাখা হত। তাই বাস্তিলের পতনে রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসে। এর ফলে রাজতন্ত্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। [3] জনগণের শক্তিবৃদ্ধি : বাস্তিলের পতন ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের শক্তি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। প্রবল প্রতাপশালী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে যে জয় লাভ করা সম্ভব তা বাস্তিলের পতনের ঘটনা প্রমাণ করে দেয়।
[4] অভিজাতদের দেশত্যাগ : বাস্তিলের পর আতঙ্কিত বহু অভিজাত প্রাণভয়ে বিদেশে চলে যায়। অভিজাতরা উপলব্ধি করে যে, বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া তাদের বিশেষ অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
উপসংহার: বাস্তিলের পতনের পর প্যারিসের শাসনক্ষমতা বুর্জোয়ারা দখল করে নেয়। ঐতিহাসিক গুডউইন বলেছেন যে, “বাস্তিলের পতনের মতো বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী ঘটনা বিপ্লবে আর ঘটেনি।”
Q৫. সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে ফ্রান্সের সংবিধান সভা (১৭৮৯ খ্রি.) কী কী পদক্ষেপ নিয়েছিল?
অথবা, ফ্রান্সের ইতিহাসে ৪ আগস্টের গুরুত্ব কী?
ভূমিকাঃ অষ্টাদশ শতকে ফরাসি বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী বুর্জোয়া নেতারা সামন্তপ্রভুদের অধিকার ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। এজন্য ঐতিহাসিক কোবান বলেছেন যে, “ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতক ছিল আধুনিক যুগের সুতিকাগার।”
❏ ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাতে সংবিধানের গৃহীত পদক্ষেপ : [1] সংবিধান সভা গঠন : ফ্রান্সের জন্য সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে সংবিধান সভা (১৭৮৯ খ্রি.) গঠিত হয়। এই সভা মূল সংবিধান রচনার আগে যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে তার মধ্যে একটি ছিল সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি। তৃতীয় শ্রেণির চাপে অভিজাত ও যাজকরা ৪ আগস্ট (১৭৮৯ খ্রি.) এক ঘোষণার মাধ্যমে তাদের সামন্ততান্ত্রিক অধিকারগুলি ত্যাগ করে।
[2] সামন্তকর বিলোপ : জাতীয় সভা ১১ আগস্ট এক ঘোষণার মাধ্যমে জানায় যে, “এখন থেকে সামন্তপ্রথা বিলুপ্ত হল”। সামন্তপ্রভুরা তৃতীয় শ্রেণির দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে করভি (শ্রমকর)-সহ বিভিন্ন ধরনের সামন্তকর এবং গির্জা ‘টাইদ’ (ধর্মকর) আদায় করত। সংবিধান সভা এসব সামন্ততান্ত্রিক কর বিলোপ করে। [3] সামন্তদের অধিকার বিলোপ : সামন্ত ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকারের বিলোপ ঘটানো হয়। ভূমিদাস প্রথা, সামন্তপ্রভুদের বংশকৌলিন্যের অধিকার, খেতাব, জমিদারি, স্বত্ত্ব, একেচেটিয়া সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি প্রথার অবসান ঘোষণা করা হয়। রাজার খাস জমি ও গির্জার জমি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
উপসংহার: সংবিধান সভা আপাতত সামন্ততন্ত্রের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটাতে ব্যর্থ হলেও এই সভার ঘোষণাগুলি সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। নর্মান হ্যাম্পসন মনে করেন যে, জাতী সভা অনেকটা এগোলেও সম্পূর্ণ পথ যেতে পারেনি।
Q৬. ফরাসি সমাজব্যবস্থায় তৃতীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় দাও।
ভূমিকাঃ বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) আগে ফরাসি সমাজে বিদ্যমান তিনটি প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম ছিল বুর্জোয়া, কৃষক, শ্রমিক, সর্বহারা ভবঘুরে বা সাঁকুলোৎ প্রমুখদের নিয়ে গঠিত তৃতীয় সম্প্রদায়।
❏ ফরাসি সমাজব্যবস্থায় তৃতীয় সম্প্রদায় : ফরাসি সমাজে তৃতীয় সম্প্রদায়গুলির বিশেষত্ব হল—
[1] জনসংখ্যা : ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশ। এই বিপুল জনসংখ্যা সত্ত্বেও তৃতীয় সম্প্রদায় ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রে কোনো অধিকার পেত না।
[2] শ্রেণিবিভাগ : ফ্রান্সে তৃতীয় সম্প্রদায় মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা—[i] ধনী ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক, প্রমুখ ছিল উচ্চ বুর্জোয়া। [ii] আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক প্রমুখ ছিল মধ্য বুর্জোয়া। [iii] কারিগর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি ছিল নিম্ন বুর্জোয়া।
[3] সামাজিক অবস্থা : বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের ধনী অংশ বিদ্যা-বুদ্ধি বা অর্থসম্পদে অভিজাত সম্প্রদায়ের চেয়েও অগ্রসর ছিল। কিন্তু অভিজাতদের মতো বংশকৌলিন্য তাদের না থাকায় তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে নানা অবিচারের শিকার হয়েছিল। তারা অভিজাত সম্প্রদায়ের ঘৃণার পাত্র ছিল। [4] করভার : তৃতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ নানা করভারে জর্জরিত ছিল। দেশের মোট রাজস্বের ৯৬ শতাংশই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হত। রাষ্ট্র, গির্জা ও সামন্তপ্রভুরা তাদের কাছ থেকে ভূমিকর, উৎপাদন কর, আয়কর, লবণ কর, ধর্মকর প্রভৃতি আদায় করত। ঐতিহাসিক লাব্রজ বলেছেন যে, “অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সের কৃষকরা ছিল সর্বাপেক্ষা শোষিত।”
উপসংহার: বিপ্লব-পূর্ব ফরাসি সমাজের এই তৃতীয় সম্প্রদায় ছিল অধিকারহীন এবং চরম অবহেলিত। দীর্ঘ দিনের শোষণ ও বঞ্চনা এই সম্প্রদায়কে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের পথে অগ্রসর হতে বাধ্য করে।
Q৭. অভিজাত বিদ্রোহ সম্পর্কে টীকা লেখো?
ভূমিকাঃ ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই-এর অর্থমন্ত্রী ব্রিয়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে অভিজাতদের ওপরও করারোপের প্রস্তাব দিলে অভিজাত সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাজার সঙ্গে অভিজাতদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
❏ অভিজাত বিদ্রোহ : [1] স্টেট্স জেনারেলের অধিকার : অভিজাতরা ব্রিয়াঁর কয়েকটি প্রস্তাব মেনে নিলেও স্ট্যাম্পকর ও ভূমিকরের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। তারা দাবি করে যে, একমাত্র স্টেটস জেনারেলের কর আরোপের অধিকার আছে। [2] সদস্যকে নির্বাসন : ষোড়শ লুই পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের আচরণে উত্ত্যক্ত হয়ে নিজের ভাই ডিউক অব অর্লিয়েন্স- সহ তিনজন সদস্যকে নির্বাসিত করেন। এতে পার্লামেন্ট ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং রাজার বিরুদ্ধে কয়েকটি আইন পাস করে ইচ্ছামতো নাগরিকদের গ্রেফতার, বিচারকদের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়ে রাজার ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
[3] পার্লামেন্ট মুলতুবি : পার্লামেন্টের আইনে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা সমস্ত প্রদেশের পার্লামেন্টগুলি মুলতুবি করেন এবং ৫৭টি নতুন বিচারালয় স্থাপন করে নিজের প্রস্তাবিত সংস্কারগুলিকে আইনে পরিণত করেন। [4] বিদ্রোহের সূচনা : রাজা পার্লামেন্ট মুলতুবি করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিজাতরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। তুলোঁ, দ্যাফিনে, দুজোঁ প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
[5] গুরুত্ব : অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে নিজের অজ্ঞাতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের মূলেই কুঠারাঘাত করে।
উপসংহার: অভিজাতরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে নিজের অজ্ঞাতে ফ্রান্সের স্বৈরাচারী দৈব রাজতন্ত্র ও পুরাতনতন্ত্রের মূলেই কুঠারাঘাত করে বসে। বিপ্লবের পরবর্তী স্তরে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
Q৮. টেনিস কোর্টের শপথ কী?
ভূমিকাঃ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে নব নির্বাচিত জাতীয় সভার প্রথম অধিবেশনে তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সকল সদস্যের একই কক্ষে বসা এবং মাথাপিছু ভোটের দাবিতে সরব হয়।
❏ টেনিস কোর্টের শপথ : [1] বুর্জোয়াদের ক্ষোভ : তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধিদের দাবি রাজা নাকচ করলে ক্ষুব্ধ প্রতিনিধিরা ১৭ জুন এক সভায় নিজেদের সভাকে ‘প্রকৃত জাতীয় সভা’ বলে ঘোষণা করে এবং দাবি করে, করধার্য করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। [2] শপথ গ্রহণ : তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ২০ জুন তাদের সভাকক্ষে গিয়ে দেখেন যে, সভাকক্ষটি তালাবন্ধ রয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা মিরাবোর ও আবে সিয়েস-এর নেতৃত্বে নিকটবর্তী টেনিস খেলার মাঠে জড়ো হয়। সেখানে তারা শপথ গ্রহণ করে যে, তারা যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে, ততদিন তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবে এই ঘটনা ‘টেনিস কোর্টের শপথ’ নামে পরিচিত।
[3] রাজার ভূমিকা : টেনিস কোর্টের শপথের ৩ দিন পর তিন সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ অধিবেশনে রাজা প্রথম দুই শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সমস্ত দাবি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। এরপর রাজা সভাকক্ষ ত্যাগ করলেও তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সেনা অভিযানের হুমকি উপেক্ষা করে সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। [4] পরিণতি : শেষপর্যন্ত চাপে পড়ে রাজা তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নেন। এভাবে বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রথম পর্ব সাফল্যের সঙ্গে শেষ হয়।
উপসংহার: টেনিস কোর্টের শপথ ছিল রাজার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহের সূচনা। শেষ পর্যন্ত ২৭ জুন ভীত হাতাশাগ্রস্ত রাজা তিন সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশনে বসার এবং মাথাপিছু ভোটের দাবি মেনে নেন।
Q৯. ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ কতটা সক্রিয় হয়েছিল?
ভূমিকাঃ ফরাসি বিপ্লবের ব্যাপকতা এবং আধুনিক ভাবধারা ইউরোপের রাজতন্ত্রগুলিকে আতঙ্কিত করে। অস্ট্রিয়া, সার্ডিনিয়া, স্পেন ও নেপল্ল্সের রাজপরিবারের সঙ্গে ফরাসি রাজপরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। ফলে এসব ইউরোপীয় শক্তি ফ্রান্সের অভ্যন্তরে বিপ্লবী শক্তির অগ্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ফিলিপ গুয়েদালা বলেছেন যে, “এই যুদ্ধ ছিল ফ্রান্সের বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে রাজতন্ত্রী শক্তিগুলির লড়াই।”
❏ ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ : [i] পাদুয়ার ঘোষণা: ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই-এর শ্যালক অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ড পাদুয়া নামক স্থানে এক ঘোষণা জারি করে (৬ জুলাই, ১৭৯১ খ্রি.) ফরাসি রাজতন্ত্রের সমর্থনে ইউরোপীয় রাজাদের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের ডাক দেন এটি পাদুয়ার ঘোষণা নামে পরিচিত। [ii] পিলনিৎজের ঘোষণা: অস্ট্রিয়ার রাজা লিওপোল্ড এবং প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিখ উইলিয়াম পিলনিজ-এ এক বৈঠকে মিলিত হয়ে এক ঘোষণাপত্র প্রকাশ (২০ আগস্ট,১৭৯১ খ্রি.) করেন। এর দ্বারা তাঁরা ইউরোপীয় শক্তিগুলিকে ফরাসি রাজতন্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের আহবান জানান এটি পিলনিৎজের ঘোষণা নামে পরিচিত। [iii] ব্রান্সউইক ঘোষণা: প্রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি ডিউক অব ব্রান্সউইক এক ঘোষণায় (আগস্ট, ১৭৯২ খ্রি.) বলেন যে, কেউ ফরাসি রাজপরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে তিনি তাদের চরম শাস্তি দেবেন। এটি ব্রান্সউইক ঘোষণা বা ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টো নামে পরিচিত।
[iv] যুদ্ধ: বিভিন্ন বিদেশি শক্তি ফরাসি রাজার সমর্থনে ফ্রান্স আক্রমণ করে। চূড়ান্ত যুদ্ধে বিপ্লবী ফ্রান্স সাফল্যের সঙ্গে জয় লাভ করে। ভামির যুদ্ধে (১৭৯২ খ্রি.) অস্ট্রো-প্রাশিয়া বাহিনী ফরাসি বাহিনীর কাছে পরাজিত হলে আপাতত বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা থেকে বিপ্লবী ফ্রান্স মুক্ত হয়। ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, “যুদ্ধের ফলে ফ্রান্স একই সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শের প্রচারক এবং পররাজ্য অপহরণকারী দস্যু—উভয় ভূমিকা পালন করে।”
উপসংহার: গোটা ইউরোপ যখন মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের কবলে বাধা পড়ে আছে তখন বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে আধুনিকতার প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে অন্যান্য দেশের স্বৈরশাসকদের আতঙ্কিত করেছিল। এই আতঙ্ক থেকেই তারা ফরাসি বিপ্লবকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়।