❏ ঔপনিবেশিক ভারতের শাসন
✱ নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও : প্রশ্নের মান-৮
1. মর্লে-মিন্টো/1935 খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনের বিভিন্ন দিক ও বৈশিষ্ট্য-সহ সমালোচনা করো। (Mark : 3+5)
2. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিত কী ছিল? এই ঘটনার ফল কী হয়েছিল? অথবা, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল? (Mark : 5+3)
3. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (1929 খ্রিস্টাব্দ) প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। এই মামলার পরিণতি কী হয়েছিল? (Mark : 3+5)
4. লখনউ চুক্তির শর্তাবলি উল্লেখ করো। এই চুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো। (Mark : 3+5)
1. মর্লে-মিন্টো/1935 খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইনের বিভিন্ন দিক ও বৈশিষ্ট্য-সহ সমালোচনা করো।
❏ ভূমিকা : ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত-বিষয়ক যে গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন করে তা ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত। সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল থেকে এই আইন কার্যকরী হবে।
❏ ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্য : এই আইনের বিভিন্ন শর্তগুলিকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা- [1] কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়ক শর্ত, [2] প্রাদেশিক সরকার বিষয়ক শর্ত।
[1] কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়ক শর্ত : (i) যুক্তরাষ্ট্র গঠন: ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে দুই ধরনের রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল—[a] ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল। [b] দেশীয় শাকদের দ্বারা শাসিত বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতের প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনাধীন রাজ্য ও বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে কেন্দ্রে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের ইচ্ছানুসারে এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার দেওয়া হয় বড়োলাট ও তাঁর অধীনস্থ একটি মন্ত্রীসভার হাতে।
[2] প্রাদেশিক সরকার বিষয়ক শর্ত : (i) আইনসভা: ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের দ্বারা প্রাদেশিক আইনসভা এককক্ষ বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট উভয়ই হতে পারত। বাংলা-সহ ছয়টি প্রদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট এবং অবশিষ্ট পাঁচটি প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। (ii) স্বায়ত্তশাসন: এই আইনের দ্বারা প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। ফলে প্রদেশগুলিতে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটে। (iii) মন্ত্রীসভা: প্রতিটি প্রাদেশিক গভর্নরের শাসনকার্যে সহায়তার জন্য তাঁর অধীনে একটি করে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। মন্ত্রীরা প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হতেন এবং তাদের কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। (iv) গভর্নরের ক্ষমতা: কেন্দ্রের অনুকরণে প্রদেশগুলির শাসনকাঠানো গড়ে তোলা হয়। গভর্নর প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব পান। আইনসভার যে-কোনো প্রস্তাব বাতিল করা, অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করা, আইনসভা ও মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে নিজের হাতে প্রদেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করা প্রভৃতি বিশেষ ক্ষমতা গভর্নরের হাতে দেওয়া হয়। (v) সাম্প্রদায়িক নির্বাচন: প্রাদেশিক আইনসভাগুলিতেও কেন্দ্রের অনুকরণে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। তপশিলি সম্প্রদায়ের জন্য ‘পুনা চুক্তি’ (১৯৩২ খ্রি.) অনুসারে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
❏ উপসংহার: এই আইনের দ্বারা ভারতে সাম্প্রদায়িক নির্বাচন চালু হওয়া, ভোটাধিকার সংকুচিত করা প্রভৃতি ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আইনটি ভারতীয়রা সাদরে গ্রহণ করেনি। এই আইনকে কংগ্রেস ‘সম্পূর্ণ হতাশজনক’ এবং মুসমিল লিগ ‘গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধ্বংসকারী’ বলে অভিহিত করে।
_________________
2. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিত কী ছিল? এই ঘটনার ফল কী হয়েছিল? অথবা, এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
❏ ভূমিকা : ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পঞ্জাবের অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ইংরেজ বাহিনী নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত।
❏ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড : রাওলাট আইনের প্রতিবাদে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার চরম পরিণতি দেখা দেয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে। আফগানিস্তানের সীমান্তে পাঞ্জাবের অবস্থিতি, যুদ্ধের সেনা ও অর্থ সংগ্রহের জন্য পাঞ্জাবিদের ওপর সরকারের জুলুম, ‘গদর’ বিদ্রোহ উপলক্ষ্যে পাঞ্জাবিদের ওপর চরম নির্যাতন এবং পাঞ্জাবে কর্মচ্যুত শিখ সৈন্যদের সমাবেশ বহু পূর্ব থেকেই পাঞ্জাবকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার মাইকেল ও' ডায়ার (Michael O Dyer)-এর স্বৈরাচারী শাসনে পাঞ্জাব যথার্থই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল। ১০ই এপ্রিল পাঞ্জাবের দুই জনপ্রিয় নেতা ড. সত্যপাল ও ড. সৈফুদ্দিন কিচলু-কে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে অজ্ঞাত স্থানে অন্তরিন করে সরকার পাঞ্জাবে ঝড়ের সূত্রপাত করে।
ওই দিন মধ্যাহ্নে দিল্লির কাছে পালওয়াল স্টেশনে গান্ধিজির গ্রেফতারের সংবাদ প্রকাশিত হওয়া মাত্র লাহোর শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। গান্ধিজি ও পাঞ্জাবের নেতৃদ্বয়ের গ্রেফতারের প্রতিবাদে অমৃতসর শহরে শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রা বের হলে পুলিশ তার ওপর গুলি চালায়। ২০ জন নিহত এবং দেড়শোজন আহত হয়। উন্মত্ত জনতা এরপর ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হয়। সরকারি দপ্তর, রেলস্টেশন, ব্যাংক, টেলিগ্রাফ অফিস এবং ইংরেজদের বাসস্থানের ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। সরকারের জনবিরোধী এই আইন ও অত্যাচারের প্রতিবাদে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সভায় শিশু ও নারীসহ প্রায় ১০ হাজার জন যোগদান করেছিল। সভা চলার সময় আত্মরক্ষার কোনো সুযোগ না দিয়ে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে পুলিশ জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে শিশু ও নারীসহ প্রায় এক হাজার নির্দোষ ভারতীয় নিহত হয়।
❏ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া : জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতবাসীর কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্নরূপটি প্রকাশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় গুলি চালানোর ঘটনাকে সমর্থন করে। ভারত-সচিব মন্টেগু এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ‘নিবারণমূলক হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেন। তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ভারতীয়রা এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। যেমন—
(i) ক্ষোভ-বিক্ষোভ: জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে সারা ভারত ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঘৃণায় ফেটে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, “এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।”
(ii) উপাধি ত্যাগ: জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। গান্ধিজিও ব্রিটিশদের দেওয়া ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি ত্যাগ করেন। একসময় ব্রিটিশ শাসনকে ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদ' মনে করা গান্ধিজি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ তাঁর ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় লেখেন যে, “এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।”
_________________
3. মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (1929 খ্রিস্টাব্দ) প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। এই মামলার পরিণতি কী হয়েছিল?
❏ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (1929 খ্রিস্টাব্দ) প্রেক্ষাপট :
(১) শ্রমিক আন্দোলন : ভারতের বিভিন্ন কলকারখানায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ নিয়ে আন্দোলনে সরব হলে ভারতের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকরা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্র ও বাক্-স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা প্রভৃতি দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রসারে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
(২) হুইটলি কমিশন : শ্রমিকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি ও আন্দোলনের প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের ক্ষোভ ও আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে 'হুইটলি কমিশন' (Whitley Commission) গঠন করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারই বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে।
(৩) শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী আইন: বড়োলাট লর্ড আরউইন শিল্পবিরোধ বিল’ (Trade Disputes Bill) ও 'জননিরাপত্তা বিল' (Public Safety Bill) নামে শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী দুটি আইন পাসের উদ্যোগ নেন। শিল্পবিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক বিরোধের মীমাংসার কথা বলা হয়। জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টদের দমনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
(৪) মামলা : কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ ও শ্রমিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩২ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এটি ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। অভিযুক্ত ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমুখ। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। এঁরা হলেন ফিলিপ স্প্ল্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্র্যাডলি এবং লেস্টার হাচিনসন।
❏ মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি : মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে। এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষে সওয়াল করেন জওহরলাল নেহরু, এম. সি. চাগলা প্রমুখ। মামলার পরিণতি কমিউনিস্টদের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি, যেমন—
(১) মামলার রায় : ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার রায়ে কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতার বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড প্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফ্ফর আহমেদ, শওকত উসমানি, কে. এন. জোগেলকর, শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গুে, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণি গোস্বামী, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী, ফিলিপ স্প্ল্যাট প্রমুখ।
(২) গান্ধিজির ভূমিকা : কংগ্রেস নেতা গান্ধিজি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের পক্ষ সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দি নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।
(৩) অন্যান্য পদক্ষেপ : ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসার, শ্রমিক ইউনিয়নগুলির সক্রিয়তা, শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতি স্তব্ধ করতে সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
_________________
4. লখনউ চুক্তির শর্তাবলি উল্লেখ করো। এই চুক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
❏ ভূমিকা : জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে (১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে) তিলকের উদ্যোগে কংগ্রেস ও জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা লক্ষ্ণৌ চুক্তি নামে পরিচিত।
❏ লখনউ চুক্তির শর্তাবলি : লক্ষ্ণৌ চুক্তির শর্তানুযায়ী - (i) কংগ্রেস ও লিগ একযোগে ব্রিটিশের কাছে শাসন সংস্কারের দাবি জানাবে। (ii) কংগ্রেসের স্বরাজের আদর্শ মেনে নেবে এবং কংগ্রেসও লিগের আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি মেনে নেবে। (iii) প্রাদেশিক আইনসভা ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মোট সদস্যের এক-তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম প্রতিনিধি।
❏ লখনউ চুক্তির গুরুত্ব: কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে স্বাক্ষরিত লক্ষ্ণৌ চুক্তির গুরুত্ব অসীম। (i) হিন্দু-মুসলিম ঐক্যগঠন: এই চুক্তি ইংরেজের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের ওপর আঘাত হানে। এ প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভাবত ঐক্যের চূড়ান্ত নিদর্শন এই চুক্তি। (ii) তিলক ও জিন্নার মর্যাদা বৃদ্ধি: এই চুক্তির রূপকার হিসেবে বালগঙ্গাধর তিলক ও মহম্মদ আলি জিন্নার জাতীয় নেতা হিসেবে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। (iii) আলাদা আলাদা স্থায়িত্ব: এই চুক্তিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের পৃথক স্বার্থকে পরোক্ষে স্বীকার করা হয়েছিল। মহম্মদ দুরানীর মতে—“লক্ষ্ণৌ চুক্তি দ্বারা কংগ্রেস স্বীকার করে নেয় যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক জাতি।”
❏ উপসংহার : জাতীয় কংগ্রেস লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম লিগের আলাদা নির্বাচনের দাবি মেনে নেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু-মুসলিম দুটি আলাদা জাতি এবং তাদের স্বার্থও আলাদা। বেশ কয়েকটি ত্রুটি সত্ত্বেও লক্ষ্ণৌ চুক্তি হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়কে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশীদার করতে সক্ষম হয়। এই চুক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ভারতে এক উত্তাল জাতীয় আন্দোলনের ঢেউ তোলে।
_________________