❏ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং উপনিবেশসমূহ
C. নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও: প্রশ্নের মান-৮
1. কোন পরিস্থিতিতে, কেন ক্রিপস মিশন গঠিত হয় এবং এতে কী বলা হয়? এই প্রস্তাব ভারতীয়রা কেন প্রত্যাখ্যান করে/ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ কী?
2. ভারতের গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। ভারতের গণপরিষদের প্রকৃতি আলোচনা করো।
3. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো এবং এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
4. ভারতছাড়ো আন্দোলন/আগস্ট আন্দোলন/42-এর বিপ্লব সম্পর্কে যা জান লেখো।
5. ওয়াভেল পরিকল্পনায় কী বলা হয়? এই পরিকল্পনার পরিণতি কী ছিল?
1. কোন পরিস্থিতিতে, কেন ক্রিপস মিশন গঠিত হয় এবং এতে কী বলা হয়? এই প্রস্তাব ভারতীয়রা কেন প্রত্যাখ্যান করে/ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ কী?
❏ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্ ছিলেন ব্রিটেনের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য তথা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আইনবিদ ও বিশিষ্ট সমাজবাদী নেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান বিষয়ক প্রস্তাবাবলি আলাপ আলোচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, ক্রিপস্কে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। সেই মতো ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ ক্রিপস্ ভারতে আসেন। ক্রিপসের প্রস্তাব ভারতীয়দের কাছে একেবারে গ্রহণযোগ্য ছিল না। কারণ এর প্রতিটি প্রস্তাব ছিল ভবিষ্যতের জন্য, যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য নয়। জাতীয় কংগ্রেস ক্রিপসের প্রস্তাবকে সমর্থন করেনি। যুদ্ধকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব ক্রিপস্ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ এই প্রস্তাবে যেমন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়নি তেমনি প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ভারতীয়দের হাতে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও এই প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতা দানের কোনো কথা উল্লেখ ছিল না।
❏ ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কারণ : ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল ক্রিপস্-এর প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করে। (১) ক্রিপসের প্রস্তাবে ভারতকে স্বাধীনতাদানের কোনো উল্লেখ না থাকায় এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়। (২) ক্রিপস্ প্রস্তাবে পরোক্ষভাবে ভারত বিভাগকে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই প্রস্তাব সফল হয়নি। (৩) দেশীয় রাজ্যগুলির ৯ কোটি মানুষের ভাগ্য রাজন্যবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে জাতীয় কংগ্রেস। (৪) ক্রিপস্ প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রাদেশিক সরকারের তুলনায় দুর্বল করায় প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। (৫) সংবিধান সভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দলও ক্রিপস্ প্রস্তাবের বিরূপ সমালোচনা করে। শেষপর্যন্ত ক্রিপস্ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।
❏ উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ক্রিপস্ প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভ। কিন্তু তাঁর গৃহীত প্রস্তাবগুলি ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করতে না পারার জন্য ব্যর্থ হয়। এছাড়া প্রস্তাবগুলি সবই ছিল ভবিষ্যতের জন্য। তাই গান্ধিজি এই প্রস্তাবকে বলেন—‘a post-dated cheque on a crashing bank'। আবার এই প্রস্তাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কোনো ইঙ্গিত না থাকায় মুসলিম লিগও এর বিরোধিতা করে। তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এই প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ক্রিপস্ প্রস্তাবের ব্যর্থতার জন্য ব্রিটিশ সরকারকেও অনেকে দায়ী করেছেন।
_____________
2. ভারতের গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। ভারতের গণপরিষদের প্রকৃতি আলোচনা করো।
❏ ভূমিকা : স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ভারতের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষত জাতীয় কংগ্রেস দেশের সংবিধান গঠনের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। 1935 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে জাতীয় কংগ্রেস দাবি জানায় যে, ভারতীয়রাই ভারতের সংবিধান রচনা করবে। এর আগে 1906 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন-এ গৃহীত স্বরাজ প্রস্তাব-এর মধ্যেই গণপরিষদ গঠনের দাবি নিহিত ছিল। 1936 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের ফৈজপুর অধিবেশন-এ সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ গঠনের দাবি সুদৃঢ় হয়।
❏ গণপরিষদ গঠনের প্রেক্ষাপট : ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠনের গুরুত্ব স্বয়ং গান্ধিজি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি 'ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গণপরিষদ গঠনের কথা বলেন। পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ গণপরিষদের মাধ্যমে একটি সংবিধান রচনার কথা বলেন। এমন পরিস্থিতিতে 1939 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে।
- ক্রিপস্ মিশন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1941 খ্রিস্টাব্দে জাপান, জার্মানির পক্ষে যোগ দিলে মিত্রপক্ষের সমস্যা বৃদ্ধি পায়। এরূপ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সমর্থন লাভে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই কারণের পাশাপাশি ভারতীয়দের জন্য সংবিধান গঠন সংক্রান্ত আলোচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলও উদ্যোগ নেন। তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্কে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। 1942 খ্রিস্টাব্দের 23 মার্চ ক্রিপস ভারতে এসে ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দের সামনে একটি প্রস্তাব রাখেন। ক্রিপস্ প্রস্তাব-এ বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদের দ্বারা ভারতের জন্য সংবিধান রচিত হবে। তবে এই প্রস্তাব ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলই মেনে নেয়নি।
- মন্ত্ৰীমিশন : 1946 খ্রিস্টাব্দের 24 মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলি ভারতে মন্ত্ৰীমিশন বা ক্যাবিনেট মিশন প্রেরণ করেন। মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাবে ভারতের সংবিধান গঠন করার জন্য একটি গণপরিষদতৈরির কথা বলা হয়। এই প্রস্তাব অনুসারে, গণপরিষদে মোট 389 জন সদস্য (ব্রিটিশ শাসিত প্রদেশ থেকে 292, 93 জন দেশীয় রাজ্যগুলি থেকে এবং চিফ কমিশনার শাসিত অঞ্চল থেকে 4 জন) প্রতিনিধিত্ব করবেন।
❏ গণপরিষদের প্রকৃতি : মন্ত্রীমিশনের প্রস্তাব অনুসারে ভারতের প্রাদেশিক আইনসভাসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় (1946 খ্রিস্টাব্দ)। এইভাবে প্রাদেশিক আইনসভাগুলির সদস্যদের মধ্যে থেকে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়। নির্বাচনে মোট 296টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস 208টিতে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা মুসলিম লিগ পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে গণপরিষদ ত্যাগ করে। তবে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতকে ভাগ করে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা ঘোষণা করলে সমগ্র পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। গণপরিষদে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ড. বি. আর. আম্বেদকর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণপরিষদে একমাত্র কমিউনিস্ট সদস্য সোমনাথ লাহিড়ি নির্বাচিত হলেও পরে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে 1946 খ্রিস্টাব্দের 9 ডিসেম্বর। আর এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ।
1947 খ্রিস্টাব্দের 29 আগস্ট সংবিধান রচনার জন্য খসড়া কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন ড. বি. আর. আম্বেদকর। কমিটির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ছিলেন—কৃষ্ণশুস্বামী আয়ার, গোপালস্বামী আয়েঙ্গার, কে. এম. মুন্সি প্রমুখ। দীর্ঘ সময় পর খসড়া কমিটি ভারতের সংবিধান রচনার কাজ সম্পন্ন করে। শেষ পর্যন্ত 1949 খ্রিস্টাব্দের 26 নভেম্বর গণপরিষদে ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়। 1950 খ্রিস্টাব্দের 26 জানুয়ারি দিনটিকে ভারতবাসী প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
উপসংহার : সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে. প্রথমে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে 1976 খ্রিস্টাব্দে 42তম সংবিধান সংশোধনীতে এর সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ— এই শব্দ দুটিকে যুক্ত করা হয়। অর্থাৎ, বর্তমানে ভারত একটি ‘সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র'।
_____________
3. ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো এবং এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
❏ ভূমিকা: স্বাধীনতা লাভের পূর্বে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল এদেশের সর্বশেষ বৃহত্তম ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন। গান্ধিজির নেতৃত্বে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ আগস্ট কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আন্দোলনকে শুরুতেই দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ৯ আগস্ট ভোরে বোম্বাই স্টেশন থেকে কংগ্রেসের প্রথম শ্রেণির প্রায় সকল নেতাদের গ্রেফতার করলে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার, সরকারের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় নীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য সংকট প্রভৃতি এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
❏ ঐতিহাসিক তাৎপর্য :
[1] ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতা : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রথম শ্রেণির নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে (২৯ মার্চ) ভারতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধি দল বা ‘ক্রিপস মিশন’ জানায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতকে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ বা স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিন্তু গান্ধিজি পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তিনি এই প্রস্তাবটিকে “ফেল পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক” বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
[2] গান্ধিজির ভূমিকা : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গান্ধিজি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, এটিই ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার আদর্শ সময়। এজন্য তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘Do or Die’-এর ডাক দেন।
[3] ভারতের দিকে জাপানের অগ্রগতি : ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। তাই জাপান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর মিত্রজোটকে পরাজিত করে ভারতের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় নেতারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করেন।
[4] দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের জন্য ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ খাবার পাঠানো হতে থাকে। এর ফলে ভারতে খাদ্যদ্রব্য-সহ অন্যান্য পণ্যের মূল্যও যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। মূল্যবৃদ্ধি ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে।
❏ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারত জুড়ে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এই আন্দোলনে নারীরা বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করে।
(১) অংশগ্রহণের প্রকৃতি: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শহরের নারীরা ছাড়াও গ্রামের নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত নারীরা প্রকাশ্যে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। পাশাপাশি বাংলার মেদিনীপুর-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক পরিবারের রমণীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেন। আসামে ১৩ বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া, পাঞ্জাবের গৃহবধূ ভোগেশ্বরী ফুকোননি, নাগাভূমিতে রানি গুইডালো প্রমুখ এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
(২) নেতৃত্ব: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন। বাংলার মেদিনীপুরের তমলুকে থানা দখলে নেতৃত্ব দেন কৃষক পরিবারের বিধবা বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা। উত্তর ভারতে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালিনী। ঊষা মেহতা oবোম্বাইয়ে গোপন বেতারকেন্দ্র গড়ে তোলেন ও এই আন্দোলনের সপক্ষে প্রচার চালান। বাংলায় এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন লীলা রায়। অরুণা আসফ আলি বোম্বাইয়ে আগস্ট ক্রান্তি ময়দানে তেরঙ্গা পতাকা তোলেন।
(৩) সংগ্রামী রূপ: নারীসমাজ এই প্রথম জাতীয় আন্দোলনে তীব্র সংগ্রামী রূপ ও মানসিকতা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আন্দোলন চলাকালে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে তাল মিলিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের মতো নারীরাও সমানভাবে ব্রিটিশদের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়।
(৪) গুরুত্ব: প্রথমত, ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ সমগ্র নারীসমাজকে স্বাধীনতা লাভের প্রশ্নে আগ্রহী করে তোলেন। দ্বিতীয়ত, সমাজের প্রায় সকল স্তরের নারীদের অংশগ্রহণের ফলে এই আন্দোলন সর্ববৃহৎ গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। তৃতীয়ত, নারীদের অংশগ্রহণের জন্যই ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ধরা পড়ে, যার প্রভাব পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের উপরে।
_____________
4. ভারতছাড়ো আন্দোলন/আগস্ট আন্দোলন/42-এর বিপ্লব সম্পর্কে যা জান লেখো।
❏ ভূমিকা : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে গণ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল— যা ইতিহাসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন (42-এর বিপ্লব) নামে খ্যাত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বশেষ ও সর্ববৃহৎ গণ-আন্দোলন হল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতে এতবড়ো গণ-আন্দোলন ইতিপূর্বে গড়ে ওঠেনি। জওহরলাল নেহরুর মতে—–“এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ অভ্যুত্থান।”
❏ ভারত ছাড়ো / আগস্ট আন্দোলন :
(১) পটভূমি : (i) ক্রিপস্ প্রস্তাবের ব্যর্থতা: ক্রিপস্ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ এতে ভারতকে স্বাধীনতা দানের কোনো উল্লেখ ছিল না। তাই এই প্রস্তাব ব্যর্থ হলে ভারতবাসী আর-একটি গণ-আন্দোলনের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। (ii) ব্রিটিশ সেনাদের অত্যাচার: যুদ্ধরত দেশগুলিতে প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের ঘটনা ভারতবাসীর ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। (iii) খাদ্যসংকট ও মূল্যবৃদ্ধি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত কারণে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়। তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিলে ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসান কামনা করে। (iv) ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা: অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন শহরবাসীদের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনাকে জাগ্রত করেছিল। যার ফলস্বরূপ এক সর্বভারতীয় গণ-আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল।
(২) আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণ : ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন আগস্ট বিদ্রোহ বা ৪২-এর আন্দোলন নামেও খ্যাত। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কংগ্রেস কার্যনির্বাহী সমিতি ঐতিহাসিক ভারত ছাড়ো প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। গান্ধিজি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আমরা দেশকে স্বাধীন করব, নয়তো ওই প্রচেষ্টায় মৃত্যুবরণ করব।” (We shall either free India or die in the attempt)।
(৩) নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার : ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ৮ আগস্ট মধ্যরাতে গান্ধিজি, মৌলানা আজাদ এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের পুলিশ গ্রেফতার করে। জাতীয় কংগ্রেসকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
(৪) স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন : ৯ আগস্ট নেতাদের গ্রেফতারের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ভারতবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সভাসমিতি, শোভাযাত্রা ও হরতাল পালনের মাধ্যমে ভারতবাসী তাদের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণি সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তমলুকের ৭৩ বছর বয়স্কা ‘গান্ধিবুড়ি’ মাতঙ্গিনি হাজরা, অসমিয়া তরুণী কনকলতা বড়ুয়া, করাচির কিশোরী হেমু কালানি পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন।
(৫) প্রসার : আগস্ট আন্দোলন প্রথমে বোম্বাই, আমেদাবাদ, কলকাতা, পুনা, নাগপুর, কানপুর-সহ বিভিন্ন শহরে শুরু হয়। বাংলার মেদিনীপুরের তমলুকে গঠিত হয় স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, যুক্তপ্রদেশের বালিয়া, সুলতানপুর, উড়িষ্যার বালেশ্বর, কটকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মূল কেন্দ্র গড়ে ওঠে।
(৬) অন্যান্য নেতৃত্ব : অনুশীলন দল, যুগান্তর দল ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলও এই আন্দোলনে শামিল হয়। সর্বভারতীয় নেতাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, অচ্যুত পট্টবর্ধন, রামমনোহর লোহিয়া, অরুণা আসফ আলি প্রমুখ।
(৭) সরকারের দমননীতি : আন্দোলন দমনের জন্য সরকার নিষ্ঠুর দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। সরকারি হিসাব থেকে জানা যায় পুলিশ ৫৩৮টি জায়গায় গুলি চালিয়ে ১০২৮ জনকে হত্যা ও ৩০০০ জনকে আহত করে।
(৮) ব্যর্থতার কারণ : ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ব্যর্থতার একাধিক কারণ ছিল— (i) পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলার অভাব: প্রথম থেকেই ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলন ছিল অপরিকল্পিত ও অসংগঠিত। স্বভাবতই আন্দোলনের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল। (ii) অন্যান্য দলের বিরোধিতা: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু-মহাসভা-সহ কিছু রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর বিরূপতা আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী ছিল। (iii) অন্যান্য কারণ: আন্দোলন চলাকালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, শস্যহানি ইত্যাদি কারণে খাদ্যাভাব,মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মানুষ আন্দোলন থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
(৯) গুরুত্ব : ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, এই আন্দোলনের গুরুত্ব কম ছিল না— (i) স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি: ভারত ছাড়ো আন্দোলন ভারতবাসীর স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষাকে বাড়িয়ে দেয়। (ii) গণ-আন্দোলন : এই আন্দোলনে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিল। (iii) কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি : বস্তুত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবার প্রমাণিত হয়ে যায় যে, ভারতীয়দের মধ্যে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। (iv) ভারতবাসীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ: এই আন্দোলনে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও স্বাধীনতার দৃঢ়সংকল্প সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিল।
❏ উপসংহার : ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল। ইউরোপের বুকে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন সারা ভারত জুড়ে তীব্র ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বিশ্বরাজনীতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতায় ভয় পেয়ে বড়োলাট ওয়াভেল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে লেখেন, “ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দিন শেষ হয়েছে। ... আয়ার্ল্যান্ডে ও মিশরে যেভাবে ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, ভারতে এখনই তা করা দরকার।”
_____________
5. ওয়াভেল পরিকল্পনায় কী বলা হয়? এই পরিকল্পনার পরিণতি কী ছিল?
❏ ভূমিকা : জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মতভেদের কারণে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল। এই অচলাবস্থার অবসানের জন্য বড়োলটি লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সঙ্গে
আলোচনা করে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এটি ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা' (১৯৪৫ খ্রি.) নামে খ্যাত।
[1] শর্তাবলি: এই পরিকল্পনায় বলা হয় — (a) শীঘ্রই সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর ও সংবিধান রচনার কাজ শুরু করবে। (b) নতুন সংবিধান গৃহীত না-হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গড়া হবে। (c) কেন্দ্রীয় পরিষদে বর্ণহিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা সমান থাকবে। (d) বড়োলাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া সমস্ত সদস্যই হবেন ভারতীয়। (e) ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ইংরেজের হাতেই ন্যস্ত থাকবে।
[2] সিমলা বৈঠক: এই প্রস্তাবগুলি আলোচনা করার জন্য লর্ড ওয়াভেল সিমলাতে ভারতীয় নেতাদের একটি বৈঠক ডাকেন (২৫ জুন, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ)। কংগ্রেসের পক্ষে মৌলানা আজাদ ও মুসলিম লিগের পক্ষে জিন্না এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
[3] পরিণতি : জিন্না তাঁর পাকিস্তান দাবি থেকে সরে আসতে অসম্মত হন। তিনি দাবি করেন যে, কেন্দ্রীয় পরিষদে সমস্ত মুসলিম সদস্যকে গ্রহণ করতে হবে মুসলিম লিগের সভ্যদের মধ্য থেকে। কংগ্রেস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। শিখরাও পৃথক অঞ্চলের দাবি জানায়। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐকমত্য না হওয়ায় সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।
_____________
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস MCQ সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন ২০২৪ মার্ক - ৮
- উচ্চমাধ্যমিক সংস্কৃত সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক এডুকেশন সাজেশন ২০২৪