❏ ভারতের আইন বিভাগ
✱ নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও: প্রতিটি প্রশ্নের মান-৮
1. ভারতের সংসদের উভয়কক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করো।
2. লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করো।
3. ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করো।
4. পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার পর্যালোচনা করো।
_______________________________
1. ভারতের সংসদের উভয়কক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক আলোচনা করো।
❏ সংসদের ভূমিকা : ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা বা পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এই দুটি কক্ষের মধ্যে নিম্নকক্ষ হল লোকসভা এবং উচ্চকক্ষ হল রাজ্যসভা। রাজ্যসভা যেখানে অনধিক ২৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতে পারে, সেখানে লোকসভার সদস্যসংখ্যা সর্বাধিক ৫৫২ জন হতে পারে। রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন অঙ্গরাজ্যগুলির আইনসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নিয়মানুযায়ী হয়ে থাকে। অন্যদিকে, লোকসভার সদস্যরা সরাসরি সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। তা ছাড়া রাজ্যসভায় মোট ১২ জন সদস্যকে মনোনীত করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির রয়েছে। তিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজসেবা, চারুকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃতী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এই মনোনয়ন দেন। লোকসভায় শুধুমাত্র ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি দুজনকে মনোনীত করেন। কার্যকালের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাজ্যসভা স্থায়ী কক্ষ এবং রাজ্যসভার সদস্যদের মেয়াদ ছয় বছর। প্রতি দু-বছর অন্তর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর নেন। কিন্তু লোকসভা স্থায়ী কক্ষ নয়, লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। স্বাভাবিকভাবে সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদও পাঁচ বছর। কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভেঙে দিতে পারেন।
❏ ভারতের সংসদের উভয়কক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক : তিনটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যথা—[1] যেক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয়ে সমান ক্ষমতার অধিকারী, [2] যেক্ষেত্রে রাজ্যসভা লোকসভার চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী এবং [3] যেক্ষেত্রে লোকসভা রাজ্যসভার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী।
[1] রাজ্যসভা ও লোকসভার সমক্ষমতা : কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভা সমান ক্ষমতা ভোগ করে। (i) পার্লামেন্টে বিলগ্রহণ-সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে একমাত্র অর্থ বিল ছাড়া রাজ্যসভা ও লোকসভা অন্যান্য বিলের ব্যাপারে সমান ক্ষমতার অধিকারী। (ii) সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। উভয়কক্ষের সম্মতি ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা যায় না। (iii) রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ও পদচ্যুতির বিষয়ে এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ক্ষেত্রে উভয়কক্ষ সমান ক্ষমতার অধিকারী। এছাড়া সুপ্রিমকোর্ট এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ, মুখ্য নির্বাচনি অফিসার, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষক প্রমুখ পদাধিকারীকে অপসারণ করার ক্ষেত্রে রাজ্যসভা ও লোকসভার সমান ক্ষমতা রয়েছে। (iv) আইনসভার অবমাননা বা অধিকারভঙ্গের অভিযোগে কোনো সদস্য বা সদস্য নন এমন ব্যক্তিকে উভয়কক্ষের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। (v) কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্ট স্থাপন এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে হাইকোর্টের ক্ষমতার পরিধি বাড়ানো প্রভৃতি বিষয়ে দুটি কক্ষ সমান ক্ষমতার অধিকারী। (vi) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা অনুমোদনের ব্যাপারেও লোকসভা ও রাজ্যসভার সমান ক্ষমতা রয়েছে।
[2] রাজ্যসভার প্রাধান্য : যেসব বিষয়ে রাজ্যসভার একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলি হল— (i) রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি এমন প্রস্তাব গ্রহণ করেন যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য-তালিকার কোনো বিষয়ে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহলে পার্লামেন্ট সেই বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে। (ii) রাজ্যসভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থে পার্লামেন্ট এক বা একাধিক সর্বভারতীয় চাকরি সৃষ্টির জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে (৩১২ নং ধারা)। (iii) উপরাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব শুধুমাত্র রাজ্যসভায় উত্থাপন করা যায়। এ ছাড়া আইনসভার স্থায়ী কক্ষ হিসেবে রাজ্যসভা লোকসভার তুলনায় একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা ভোগ করে।
[3] লোকসভার প্রাধান্য : যেসব বিষয়ে লোকসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলি হল— (i) অর্থ বিল একমাত্র লোকসভাতেই উত্থাপিত হতে পারে। তাছাড়া কোনো বিল অর্থ বিল কি না সে বিষয়ে মতবিরোধ ঘটলে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। অর্থ বিল লোকসভায় গৃহীত হওয়ার পর রাজ্যসভার কাছে সুপারিশের জন্য পাঠানো হয়। কোনো অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান বা সংশোধন করার ক্ষমতা রাজ্যসভার নেই। রাজ্যসভাকে অর্থ বিল সম্বন্ধে ১৪ দিনের মধ্যে তার মতামত জানাতে হয়। বিলটি এই সময়ের মধ্যে ফেরত না এলে তা গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। অর্থ বিলের ব্যাপারে রাজ্যসভার সুপারিশ গ্রহণ করা লোকসভার পক্ষে বাধ্যতামূলক নয়। (ii) কোনো সাধারণ বিল নিয়ে লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের এক যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন। এই অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে এক্ষেত্রে লোকসভার মতামতই জয়ী হয়, কারণ সদস্যসংখ্যায় লোকসভা রাজ্যসভার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। (iii) ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যাপারে লোকসভা কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে বাধ্য থাকবেন। (iv) কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তার কাজকর্মের জন্য শুধুমাত্র লোকসভার কাছেই দায়বদ্ধ থাকে। মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার ক্ষমতা একমাত্র লোকসভারই রয়েছে। এই কারণে লোকসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভার পতন ঘটে।
উপসংহার : ভারতীয় পার্লামেন্টের দুই কক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্ক বিশ্লেষণের শেষে বলা যায় যে, কিছু ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন হলেও সামগ্রিক দিক থেকে লোকসভা রাজ্যসভা অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কক্ষ হিসেবে লোকসভার গুরুত্ব স্বভাবতই বেশি। ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতারা সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার রীতিনীতির ভিত্তিতেই দুটি কক্ষের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্কের রূপরেখা স্থির করেছিলেন।
2. লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করো।
❏ লোকসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলি : ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় স্পিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জওহরলাল নেহরুর মতে, লোকসভার স্বাধীনতা ও সম্ভ্রমের মূর্ত প্রতীক হলেন স্পিকার। লোকসভা যেহেতু সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করে, তাই লোকসভার সভাপতি হিসেবে স্পিকার সমগ্র জাতির স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। সংবিধান অনুসারে স্পিকারকে অবশ্যই লোকসভার সদস্য হতে হয়। লোকসভা নির্বাচনের পর নবগঠিত সভার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে স্পিকার নির্বাচন করেন (৯৩ নং ধারা)। সাধারণত লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থী স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
স্পিকারের কার্যকাল সম্পর্কে সংবিধানে কিছু বলা না হলেও লোকসভার মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকেন। অবশ্য লোকসভার সদস্যদের স্পিকারকে অপসারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে । ভারতের সংবিধানে স্পিকার এক বিশেষ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর পদমর্যাদা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সমতুল্য বলে অনেকে মনে করেন। স্পিকারের ক্ষমতার উৎস হল ভারতের সংবিধান এবং লোকসভার কার্যপরিচালনা-সংক্রান্ত বিধি কিছু অলিখিত ক্ষমতাও তাঁর রয়েছে।
[1] সভা পরিচালনা : সুশৃঙ্খলভাবে সভা পরিচালনা করা স্পিকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল— (i) লোকসভায় কোন্ প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করা হবে, কোন নোটিশ আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হবে, কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন সংশোধনী প্রস্তাব বৈধ বলে বিবেচিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। (ii) সভায় বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে এবং দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সদস্যদের অবশ্যই স্পিকারের কাছে অনুমতি নিতে হয়। (iii) সদস্যদের বক্তৃতায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, অপ্রাসঙ্গিক বা অশালীন মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি স্পিকার বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন। (iv) সভায় সব সদস্য যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন সেদিকেও স্পিকারের লক্ষ থাকে। সভার কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সংসদীয় রীতি-বিরোধী আচরণ দেখলে তিনি কোনো সদস্যকে মৃদু তিরস্কার করতে পারেন, এমনকি শাস্তিও দিতে পারেন ইত্যাদি।
[2] অর্থ বিল-সম্পর্কিত ক্ষমতা : অর্থ বিল নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে স্পিকার তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে থাকেন। লোকসভায় অনুমোদনের পর অর্থ বিলটিকে যখন রাজ্যসভায় পাঠানো হয়, তখন বিলটি যে একটি অর্থ বিল সে-সম্পর্কে স্পিকার একটি প্রমাণপত্র দিয়ে থাকেন।
[3] লোকসভা ও রাষ্ট্রপতির সংযোগ রক্ষা : লোকসভা ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে তিনিই সংযোগ রক্ষা করে থাকেন। রাষ্ট্রপতির দেওয়া বাণী, বক্তব্য, বার্তা ইত্যাদি স্পিকার নিজে লোকসভায় উত্থাপন করেন। অন্যদিকে আবার রাষ্ট্রপতির কাছে লোকসভার বক্তব্য স্পিকারের মাধ্যমেই পেশ করা হয়।
[4] সংসদীয় কমিটির প্রধান হিসেবে ভূমিকা : সংসদীয় কমিটিগুলির প্রধান হলেন স্পিকার। তিনি বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের নিয়োগ করেন। এই কমিটিগুলি স্পিকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে দায়িত্ব পালন করে। গুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলির সভায় স্পিকার সভাপতিত্ব করেন। এর মধ্যে রয়েছে বিধি- সম্পর্কিত কমিটি (Rules Committee), সভার কর্মপদ্ধতি পরিচালনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি (Business Advisory Committee) প্রভৃতি।
[5] অন্যান্য ক্ষমতা : উপরের ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে স্পিকারের ক্ষমতা লক্ষ করা যায়। (i) পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে স্পিকারই সভাপতিত্ব করেন। (ii) যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্যদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে স্পিকার আলোচনা করতে পারেন। (iii) কোনো সদস্যের পক্ষে হিন্দি বা ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়া সম্ভব না হলে মাতৃভাষায় ভাষণদানের ব্যাপারে স্পিকার অনুমতি দিয়ে থাকেন। পরে সেই বক্তৃতা ইংরেজি বা হিন্দিতে অনুবাদের তিনি ব্যবস্থা করেন। (iv) লোকসভা সচিবালয়ের প্রধান হিসেবে স্পিকার সভার কর্মীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সদস্যদের জীবন ও সম্মান রক্ষা এবং সদস্যদের আবাসন-সংক্রান্ত ব্যবস্থা করেন।
3. ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করো।
❏ ভারতীয় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি : ভারতীয় সংবিধানে ১০৭ নং ধারা থেকে ১২২ নং ধারায় পার্লামেন্টের আইন পাসের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের একটি প্রধান কাজ। কোনো কক্ষে বিল উত্থাপন করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ পর্যন্ত বিলকে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। সরকারি বা বেসরকারি যে-কোনো বিল উত্থাপনের আগে একটি প্রস্তুতি পর্ব চলে।বেসরকারি বিল উত্থাপনের একমাস আগে একটি নোটিশ দিতে হয়। সংসদের যে-কোনো কক্ষে সাধারণ বিল উত্থাপন করা যায়। বেসরকারি বিলের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সরকারি বিল উত্থাপনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী । সরকারি বিল উত্থাপন করার আগে সেই সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের অনুমোদনের পর পার্লামেন্টের সম্মতি গ্রহণের জন্য রাজ্যসভা অথবা লোকসভা যে-কোনো কক্ষে বিলটি উত্থাপিত হয়। একটি সাধারণ বিল সাতটি পর্যায় পার হয়ে আইনে পরিণত হয়।
[1] প্রথম পর্যায় : বিলের প্রথম পর্যায়ে রয়েছে বিল উত্থাপন ও বিলের প্রথম পাঠ। বিলটি যদি লোকসভায় উত্থাপিত হয় তাহলে স্পিকারের কাছে এবং রাজ্যসভায় উত্থাপিত হলে চেয়ারম্যানের কাছে অনুমতি নিয়ে উত্থাপককে সভায় বিল পেশ করতে হয়। এই পর্যায়ে শুধুমাত্র বিলের ‘Title’ বা শিরোনাম পাঠ করা হয়।কোনো আলোচনা বা বিতর্ক এই পর্যায়ে হয় না। তবে উত্থাপক প্রয়োজনবোধে বিলটির উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে পারেন। নিয়মানুসারে উত্থাপিত হওয়ার পর বিলটি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়।
[2] দ্বিতীয় পর্যায়: বিল উত্থাপনের কয়েকদিন পর বিলের দ্বিতীয় পাঠ শুরু হয়। এই পর্যায়ে উত্থাপক বিল সম্পর্কে যে-কোনো একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারেন। যেমন— (i) বিলটি সভায় বিচারবিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হোক (ii) পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটিতে বিলটি পাঠানো হোক (iii) পার্লামেন্টের উভয়কক্ষের যুক্ত কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হোক (iv) জনসাধারণের মতামত জানার জন্য বিলটি প্রচার করা হোক।
[3] তৃতীয় পর্যায় : বিলের তৃতীয় পর্যায়ে বিলটি নিয়ে সামগ্রিক বিচারবিবেচনা করা হয়। বিলের এই পর্যায়কে কমিটি পর্যায় বলে কোনো বিল সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট বিল নিয়ে কমিটি ব্যাপক আলোচনা করতে পারে, কিন্তু বিলের নীতি বা উদ্দেশ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা কমিটির নেই। অবশ্য বিলের কোনো অংশের সংশোধনের জন্য কমিটি তার প্রস্তাব রাখতে পারে। কমিটি প্রয়োজনবোধে বিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বক্তব্য শুনতে পারে অথবা কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারে বা বিশেষ কারণে সরকারকে সংশ্লিষ্ট দলিল ও তথ্য পেশ করতেও বলতে পারে। কমিটি সবশেষে বিলটির সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত সংসদে উপস্থাপন করে।
[4] চতুর্থ পর্যায় : এই পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট বিলের প্রতিটি ধারা-উপধারা নিয়ে সবিস্তার আলোচনা ও তর্কবিতর্ক হয়। সভার যে-কোনো সদস্য বিলটির ওপর সংশোধনী প্রস্তাব আনতে পারেন। অবশ্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপনের কমপক্ষে একদিন আগে সভায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। আলোচনা ও তর্কবিতর্কের শেষে বিলের প্রতিটি ধারা ও উপধারা নিয়ে ভোটাভুটির পর বিলের দ্বিতীয় পাঠের সমাপ্তি ঘটে।
[5] পঞ্চম পর্যায় : এই পর্যায়ে বিলের তৃতীয় পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পাঠ শেষ হওয়ার পর যে-কোনো দিন বিলের তৃতীয় পাঠের সূচনা করে সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে বিলের ধারা-উপধারা নিয়ে কোনোরকম আলোচনা বা তর্কবিতর্ক হয় না, এমনকি সংশোধনী প্রস্তাবও উত্থাপন করা যায় না। বিলটি গৃহীত হবে না প্রত্যাখ্যাত হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বিলটিকে সমর্থন করলে বিলটি গৃহীত হয়। অন্যদিকে সমর্থন না পেলে বিলটি বাতিল বলে গণ্য হয়। এইভাবে বিলটি লোকসভায় গৃহীত হলে স্পিকারকে অথবা রাজ্যসভায় গৃহীত হলে চেয়ারম্যানকে সেই সম্পর্কে সার্টিফিকেট দিতে হয়।
[6] ষষ্ঠ পর্যায় : বিল পাসের ষষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে অপর কক্ষের অনুমোদনের বিষয়টি। বিলটি যে-কোনো একটি কক্ষে গৃহীত হওয়ার পর তা অনুমোদনের জন্য অপর কক্ষে যায়। সেই কক্ষেও বিলটিকে উপরোক্ত পর্যায়গুলি অতিক্রম করতে হয়। কোনোরকম সংশোধনী ছাড়াই বিলটি অপর কক্ষে গৃহীত হলে বিল অনুমোদনের ষষ্ঠ পর্যায় শেষ হয় । অপর কক্ষ অবশ্য বিলে সম্মতি না দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করতে বা সংশোধনী প্রস্তাব আনতে অথবা ছয় মাসের জন্য আটকে রাখতে পারে। তবে কোনো বিল নিয়ে দুটি কক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয়কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারেন। যৌথ অধিবেশনে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে বিলটি অনুমোদিত হয়।
[7] সপ্তম পর্যায় : সপ্তম ও শেষ পর্যায় হল রাষ্ট্রপতির সম্মতি জ্ঞাপনের পর্যায় । পার্লামেন্টের উভয়কক্ষেবিলটি গৃহীত হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয় । রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিলটিতে সম্মতি দিলে বিলটি তৎক্ষণাৎ আইনে পরিণত হয়। অবশ্য রাষ্ট্রপতির অসম্মতি জানানোর ক্ষমতাও রয়েছে। এছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য পার্লামেন্টের কাছে ফেরত পাঠাতেও পারেন। তবে পার্লামেন্ট সংশ্লিষ্ট বিলটিকে পুনরায় অনুমোদন করে পাঠালে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি দিতে বাধ্য থাকেন। এভাবে একটি বিল লোকসভা, রাজ্যসভা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত হয়।
4. পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার পর্যালোচনা করো।
❏ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার : ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় লোকসভার মতো রাজ্যের বিধানসভাতেও অধ্যক্ষ বা স্পিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিধানসভার সভাপতি হিসেবে অধ্যক্ষ সদস্যদের স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। রাজ্য বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ বা স্পিকার এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ বা ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করেন। এছাড়া অধ্যক্ষ কমপক্ষে 6 জনকে সভাপতি বা চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন করে থাকেন। বিধানসভায় ভোটা-ভুটির সময় বা অন্য সময়ে অধ্যক্ষ তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। তবে ভোটাভুটির সময় পক্ষে ও বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট পড়লে অধ্যক্ষ একটি ‘নির্ণায়ক ভোট’ দিতে পারেন। অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষেরে সাধারণ কার্যকালের মেয়াদ 5 বছর। তবে সদস্যরা চাইলে নির্দিষ্ট কার্যকালের আগেই অধ্যক্ষকে পদচ্যুত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা পদচ্যুতি সংক্রান্ত প্রস্তাবের পক্ষে বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমার্থন থাকা প্রয়োজন।
❏ ক্ষমতা ও কার্যাবলি : রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষের ক্ষমতা ও কার্যাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—
[1] সভা পরিচালনা: সুশৃঙ্খলভাবে সভা পরিচালনা অধ্যক্ষ বা স্পিকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি হল (a) বিধানসভায় কোন্ প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করা হবে, কোন নোটিশ আলোচনার জন্য গ্রহণ করা হবে, কী প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোন সংশোধনী প্রস্তাব বৈধ বলে বিবেচিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যক্ষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। (b) সভায় বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে এবং দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সদস্যদের অতি অবশ্যই অধ্যক্ষের অনুমতি নিতে হয়। (c) সদস্যদের বক্তৃতায় একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, অপ্রাসঙ্গিক বা অশালীন মন্তব্য এবং আপত্তিকর আচরণ ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি অধ্যক্ষ বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন। (d) সভায় সব সদস্য যাতে সমান সুযোগ পেতে পারেন সেদিকেও অধ্যক্ষের লক্ষ থাকে। সভার কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সংসদীয় রীতি বিরোধী আচরণ দেখলে তিনি কোনো সদস্যকে তিরস্কার এমনকি শাস্তিও দিতে পারেন ইত্যাদি।
[2] সদস্যদের অধিকার রক্ষা : বিধানসভার সদস্যদের অধিকার ভঙ্গ বা সভা অবমাননার দায়ে অধ্যক্ষ যে-কোনো ব্যক্তি বা সদস্যের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারেন। সভা অবমাননার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সদস্যকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতাও অধ্যক্ষের রয়েছে। তাছাড়া অধ্যক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো সদস্যকে বিধানসভার ভেতরে গ্রেফতার করা যায় না।
[3] অর্থ বিল সম্পর্কিত ক্ষমতা : অর্থ বিল নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে অধ্যক্ষ তার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে থাকেন।
[4] বিধানসভার কমিটিগুলিকে নিয়ন্ত্রণ : বিধানসভার কমিটিগুলির প্রধান হলেন অধ্যক্ষ। তিনি এই কমিটিগুলির সভাপতিদের নিয়োগ করেন। এসব কমিটি অধ্যক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করে থাকে।
[5] অন্যান্য ক্ষমতা : বিধানসভার অধ্যক্ষের হাতে এছাড়াও কিছু অন্যান্য ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— (a) কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সদস্যদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে অধ্যক্ষ আলোচনা করতে পারেন। (b) সভায় সাধারণ দর্শক ও সাংবাদিকদের জন্য তিনি বসার ব্যবস্থা করে থাকেন। (c) সভার কার্যবিবরণী সংরক্ষণের দায়িত্বও অধ্যক্ষের। (d) সভার কোনো সদস্য পদত্যাগ পত্র দিতে চাইলে তা অধ্যক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। (e) দলত্যাগ বিরোধী আইন অমান্য করলে অভিযুক্ত সদস্যের সদস্যপদ বাতিল করার ক্ষমতাও অধ্যক্ষের রয়েছে।
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস MCQ সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান MCQ সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন ২০২৪ মার্ক - ৮
- উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান মার্ক - ৮ সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক সংস্কৃত সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল সাজেশন ২০২৪
- উচ্চমাধ্যমিক এডুকেশন সাজেশন ২০২৪