ইতিহাস প্রশ্ন ও উত্তর মান - ৫ ইতিহাস মেনু ❝ ই ❞
importance history questions 5 mark bengali version
———❝ ই ❞ // ইতিহাস প্রশ্ন উত্তর ———
১. ইলবার্ট বিল আন্দোলন সম্পর্কে টীকা লেখ?
▻ ১৮৭৩ খ্রি.-এর ফৌজদারি আইন অনুসারে মফসসলের ভারতীয় দায়রা বিচারকগণ কোনো শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়র বিচার করতে পারতেন না। লর্ড রিপনের পরামর্শে আইন সচিব মি. ইলবার্ট এই বৈষম্যমূলক আইনের পরিবর্তে যে খসড়া আইন প্রস্তুত করেন ১৮৮৩ খ্রি. তা ইলবার্ট বিল নামে পরিচিত হয়। এই খসড়া বিলে জেলা দায়রা আদালতের ভারতীয় বিচারকদের শ্বেতাঙ্গ আসামির বিচারের অধিকার দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় ও ভারতীয় বিচারকদের সমমর্যাদার অধিকারী করা।
খসড়া আইনটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানায়। ইউরোপীয়দের প্রতিবাদের চাপে সরকার বিলটি সংশোধন করতে বাধ্য হয় এবং স্থির হয়, ভারতীয় বিচারক কর্তৃক শ্বেতাঙ্গদের বিচার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ-জুরির মতামত গ্রহণ বাধ্যতা মূলক হবে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সংশোধিত ইলবার্ট বিলের বিপক্ষে প্রচার চালায়। ধীরে ধীরে ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে ওঠে।ইলবার্ট বিল আন্দোলন শিক্ষিত ভারতবাসীর উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। জাতীয় মর্যাদা সম্পর্কে ভারতীয় দের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, ও/ ভারতবাসী উপলব্ধি করতে পারে যে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের গুরুত্ব কত বেশি। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বেশিরভাগ ভারতীয়র মোহভঙ্গ ঘটে। ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ তীব্র আকার ধারণ করেইলবার্ট বিল বিতর্ক থেকে ভারতীয়রা শিক্ষা নেয় যে একমাত্র স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেই ভারতবাসী প্রকৃত মর্যাদা ও নিরাপত্তা পাবে।
২. ইলবার্ট বিল বিতর্ক আন্দোলনের গুরুত্ব কী ছিলো?
▻ ভারতের বড়োেলাট লর্ড রিপন-এর আমলে তাঁর আইনসচিব ইলবার্ট রচিত বিলকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা ‘ইলবার্ট বিল আন্দোলন' নামে পরিচিত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলবার্ট বিল আন্দোলনের গুরুত্ব হল—
- ➊ ইলবার্ট বিল প্রকাশ হওয়ার পর সর্বপ্রথম কলকাতা হাইকোর্টের ব্যারিস্টার ব্রানসনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সমিতির নেতৃত্বে ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। ভারতের ইংলিশম্যান পত্রিকা ও ইংল্যান্ডের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা মূলক লেখা প্রকাশিত হয়।
- ➋ ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে ইউরোপীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে সরকার বিলটির সংশোধন করতে বাধ্য হয়। নতুন সংশোধিত আইনে বলা হয় যে, এখন থেকে ভারতীয় বিচারকগণ ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার সময় জুরির সাহায্য নিতে বাধ্য থাকবেন। বলাবাহুল্য এই জুরিদের অধিকাংশই ছিলেন ইউরোপীয়।
- ➌ ইউরোপীয়দের চাপে ইলবার্ট বিল সংশোধন করা হলে ভারতীয়দের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা সংশোধিত ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।
- ➍ ইলবার্ট বিল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতি-বর্ণে বিশ্বাসী ভারতীয়দের জাতীয়তা বোধের জাগরণ ঘটে।
- ➎ সুসংবদ্ধ রাজনৈতিক সমিতি গঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব এ সত্য প্রমাণিত হয়। ভারতীয় হিসেবে সম্পূর্ণ জাতীয় মর্যাদা পেতে গেলে স্বাধীনতা লাভ করা প্রয়োজন, ভারতবাসীর অন্তরে এই অনুভূতির জন্ম দেয় ইলবার্ট বিল আন্দোলন।
- ➏ একটি সর্বভারতীয় জাতীয় তহবিল এবং বিভিন্ন সভাসমিতি গঠিত হওয়ায় ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির অগ্রগতি ঘটে।
৩. ইউরোপীয় দেশ গুলি উপনিবেশ স্থাপনের কারণগুলি কি ছিল লেখ?
▻ উপনিবেশ বা Colony বলতে সাধারণত দেশের বাইরে বা অন্য দেশে কোনো রাষ্ট্রের বসতি গড়ে তোলাকে বোঝায়। কোনো রাষ্ট্রের উপনিবেশের জনগণ ওই রাষ্ট্রের কাছে আনুগত্যতা প্রকাশ করে থাকে। ঔপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে রুপার্ট এমারসন বলেছেন, ঔপনিবেশিকতা হল বিদেশি জনসাধারণের
ওপর দীর্ঘদিন ধরে শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ, কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো
দেশ বা তার অঞ্চলকে যখন নিজ অধীনস্থ করে নেয় তখন সেই দেশ বা অঞ্চলটি হয়ে যায় ওই নির্দিষ্ট
রাষ্ট্রের উপনিবেশ।
❏ উপনিবেশ স্থাপনের কারণ : ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সামুদ্রিক
অভিযানের সূত্র ধরেই ঔপনিবে -শিকতাবাদের সূত্রপাত ঘটেছিল বলে অনেকেই মনে
করেন। প্রথম দিকে পোর্তুগাল ও স্পেন এবং পরবর্তী কালে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স
প্রভৃতি দেশও উপনিবেশ স্থাপনে মনোনিবেশ করেছিল। বিভিন্ন ইউরোপীয়
দেশের উপনিবেশ স্থাপনের কারণগুলি হল—
- ➊ ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির উপনিবেশ স্থাপনের অন্যতম কারণ ছিল অপরাপর রাষ্ট্রের কাছে নিজ মর্যাদা বৃদ্ধি করা। সম্পদশালী কোনো দেশে উপনিবেশ গঠন করে ওই রাষ্ট্রগুলি বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেদের কে গড়ে তোলে। উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কথা বলা যেতে পারে। উক্ত দুটি দেশের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের বৃহৎ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
- ➋ ইউরোপীয় দেশগুলির উপনিবেশ স্থাপনের অপর একটি কারণ ছিল পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটানো। পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটার মাধ্যমেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বাদের প্রসার ঘটে। প্রথমে ইংল্যান্ড এবং পরে অন্যান্য কিছু ইউরোপীয় দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটায় পুঁজিবাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণ, বিভিন্ন শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পুঁজির বিনিয়োগ শুরু হয়। অর্থাৎ, পুঁজিবাদের প্রসারে উপনিবেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়।
- ➌ ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলির পুঁজিপতি শ্রেণির ব্যক্তিরা শিল্পবিপ্লবের পর নিজ দেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের দেশের নতুন নতুন শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। মুনাফাজাত ওই অতিরিক্ত অর্থ মূলধন হিসেবে দেশের বাইরে বিভিন্ন শিল্পে লগ্নি করার লক্ষ্যে ইউরোপীয় শক্তিগুলি মনোনিবেশ করে। এই সূত্রেও উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে।
- ➍ শিল্পজাত বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পড়ে বিভিন্ন কাঁচামালের। অধিক পরিমাণ দ্রব্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামালের চাহিদাও ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য শিল্পোন্নত ইউরোপীয় দেশগুলি উপযুক্ত উপনিবেশের খোঁজ শুরু করে। এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। খুবই কম দামে অধিক পরিমাণ কাঁচামাল পাওয়ার জন্য ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলি আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে কাঁচামাল দখলের কারণেই ওই দেশগুলি উপনিবেশগুলিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মেতে ওঠে।
- ➎ শিল্পোন্নত দেশগুলির পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় বেশি উৎপাদনের দিকে জোর দিয়েছিল। ফলে কারখানাগুলিতে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এই প্রয়োজন মেটানোর অন্যতম উপায় ছিল উপনিবেশগুলি থেকে সস্তায় শ্রমিকের জোগান। ফলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলি কাঁচামালের পাশাপাশি সুলভে শ্রমিক সংগ্রহের জন্যও উপনিবেশ স্থাপনে উদ্যোগী হয়।
❏ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পুলিশি ব্যবস্থা : প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজ কোম্পানি
পুলিশ প্রশাসনে মোগল যুগের রীতি বজায় রাখে। 1765 খ্রিস্টাব্দে তারা বাংলা
সুবার দেওয়ানি লাভ করার পর স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ফৌজদার
নামে দেশীয় পুলিশদের হাতে অর্পিত হয়। তখন পুলিশ চৌকিগুলি নিয়ন্ত্রণ করত
জমিদাররা। নায়েব নাজিমের তত্ত্বাবধানে পুলিশ গ্রামাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষার কাজ চালাত। অবশেষে 1781 খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের
অধীনে পুলিশরা তাদের দায়িত্বপালন করতে শুরু করে।
হেস্টিংসের আমলে ভারতে পুলিশি ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে কার্যকারী করে তোলা
সম্ভবপর হয়নি। তাই কর্নওয়ালিশ পুলিশি ব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজান।
প্রথমেই তিনি জমিদারদের হাত থেকে পুলিশি
দায়িত্ব কেড়ে নেন। জেলাগুলিকে কতগুলি থানায় ভাগ করেন। প্রত্যেক থানার
দায়িত্বে একজন করে ভারতীয় দারোগা নিয়োগ করেন। দারোগা নিয়োগ ও তার কাজের
তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান ম্যাজিস্ট্রে -টরা। এই দারোগারা ছিলেন
গ্রামাঞ্চলে ইংরেজ কোম্পানির শাসনের প্রতীক। স্থানীয় জমিদার দের সঙ্গে
দারোগাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ।বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব
পুলিশের হাতে থাকলেও বাংলার
বাইরে রাখার জন্য ইংরেজ কোম্পানি ম্যাজিস্ট্রেটদের অতিরিক্ত নজরদারির
দায়িত্ব প্রদান করে। তবে এই ব্যবস্থা অল্পদিনের মধ্যেই বাতিল করে দেওয়া
হয়।
সিন্ধু মডেল অনুযায়ী একে একে পাঞ্জাব, বোম্বাই (মুম্বাই), মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলে পুলিশি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। মহাবিদ্রোহের পর 1858 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এ দেশের পুলিশ প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংগঠিতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়। 1861 খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় পুলিশ আইন। এই ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ইনস্পেকটর জেনারেল এবং সর্বনিম্ন স্তরে ছিল দারোগা।পরিশেষে বলা যায় যে, সারা দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বানচাল করায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে। তবে তারা সাধারণ মানুষের কাছে অত্যাচার ও ঘৃণার প্রতীকরূপে পরিচিত ছিল।
▻ সমগ্র বিশ্বে ইংল্যান্ড, পোর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি উপনিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত দেশগুলির মধ্যে আবার সবথেকে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির তুলনায় ব্রিটিশ উপনিবেশের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। ব্রিটিশ শক্তি কর্তৃক উপনিবেশ বিস্তারের প্রক্রিয়াগুলি ছিল নিম্নরূপ।
❏ ইংল্যান্ডের উপনিবেশ বিস্তারের প্রক্রিয়া : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে বিংশ শতাব্দীরপ্রথমদিক পর্যন্ত সময়কালে ইংল্যান্ড বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলে উপনিবেশ গঠন করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইংল্যান্ডের নাবিক ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূল অঞ্চল অধিকার করেন। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে ক্যাপটেন কুক অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি নিউজিল্যান্ড আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে ব্রিটেনের বহু নাবিক এবং ব্যবসায়ী নিউজিল্যান্ডে বসবাস করতে শুরু করলে সেটি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়।
ফরাসিদের দুর্বলতার সুযোগে 1762 খ্রিস্টাব্দে কানাডার কুইবেক অঞ্চলটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। 1774 খ্রিস্টাব্দে পাস হওয়া কুইবেক অ্যাক্টের দ্বারা ইংল্যান্ড কুইবেকবাসীদের ধর্মীয় স্বাধীনত প্রদান করা ছাড়াও অন্যান্য কিছু সুযোগসুবিধা প্রদান করে। এ সত্ত্বেও কানাডায় ফরাসিদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ, কেপ কলোনি, নাটাল, ট্রান্সভাল প্রভৃত্তি অঞ্চলে ব্রিটিশ উপনিবেশ গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময় মিশর, জাম্বিয়া, নাইজিরিয়া, উগান্ডা, সুদান, রোডেশিয় প্রভৃতি দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলেও ইংল্যান্ডের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারত ছিল ব্রিটিশদের কাছে সর্বাপেক্ষা লাভজনক উপনিবেশ ভারতে তাদের প্রধান ঔপনিবেশিক প্রতিপক্ষ শক্তি ফ্রান্সকে পরাজিত করে প্রায় দুশো বছর ধরে প্রথমে বাণিজ্যিক এবং পরবর্তী সময় রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রেখেছিল। 1858 খ্রিস্টাব্দে ভারত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিংহল (শ্রীলঙ্কা), ব্রষ্মদেশ (মায়ানমার), সিঙ্গাপুর, মালাক্কা, ফিজি প্রভৃতি অঞ্চলেও ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন হয়েছিল। এর সুফল হিসেবে উক্ত অঞ্চলগুলির নৌবাণিজ্য এবং ব্যাবসার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শক্তি লাভবান হয়ে ওঠে।
▻ হায়দার আলির মৃত্যুর পর ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি 1784 খ্রিস্টাব্দর দ্বারা
দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। হায়দারের পুত্র টিপু সুলতান
মহীশূরের শাসক হন। কিন্তু ম্যাঙ্গালোরের সন্ধি টিপু ও ইংরেজ দের পারস্পরিক
সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান করতে না পারায় উভয়ের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত
ছিল।
ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী জেনে টিপু সুলতান ফ্রান্স ও
তুরস্কের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনা টিপুর উদ্দেশ্য
সম্পর্কে ইংরেজদের শঙ্কিত করে। ফলস্বরূপ তারাও ম্যাঙ্গালোরের সন্ধির শর্ত ভঙ্গ
করে টিপুর শত্রু নিজামের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে উদ্যোগী হয়। এই ঘটনায় টিপু
ক্রুদ্ধ হয়ে ইংরেজদের মিত্ররাজ্য ত্রিবাঙ্কুর আক্রমণ করতে উদ্যত হন। এমন
অবস্থায় ত্রিবাঙ্কু রের রাজা ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থনা করলে 1790
খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
দিতে বাধ্য হন। ইংরেজ, মারাঠা ও নিজাম টিপুর রাজ্যের বেশকিছু অংশ দখল করে। টিপু তাঁর রাজ্যের অর্ধেক ছেড়ে দিতে এমনকি দুই পুত্রকে ইংরেজদের কাছে পণবন্দি করে রাখতে বাধ্য হন।
ইংরেজদের সঙ্গে শ্রীরঙ্গপত্তনমের অমর্যাদাকর সন্ধি টিপুর পক্ষে মেনে নেওয়াটা একপ্রকার অসম্ভব ছিল। ফলে নিম্নলিখিত একাধিক কারণে উভয়পক্ষের মধ্যে আবার যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
- তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে টিপুর পরাজয়ের পর শ্রীরঙ্গপত্তনমের সন্ধি স্বাক্ষরিত হলেও এর মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে প্রকৃত শান্তি স্থাপিত হয়নি। ফলে তিনি অপর একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি স্বরূপ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যেমন—🅐 তৃতীয় ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মহীশূরের অর্থনীতিতে সৃষ্ট বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার জন্য তিনি একটি নতুন রাজস্ব নীতি গ্রহণ করেন। 🅑 ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি তিনি বণিকদের থেকেও প্রচুর ঋণ নেন। 🅒 মহীশূরে পুনরায় একটি বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এ ছাড়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার উদ্দেশ্যে টিপু ফ্রান্স, কাবুল, আরব, কনস্ট্যান্টিনোপল প্রভৃতি স্থানের রাষ্ট্রপ্রধানদের থেকেও সাহায্য প্রার্থনা করে ছিলেন।
- এই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলাকালীন লর্ড ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেল হয়ে ভারতে আসেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরি জন শোরের নিরপেক্ষতার নীতি বর্জন করে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন। অধীনতা -মূলক মিত্রতা নীতির দ্বারা ওয়েলেসলি বেশিরভাগ ভারতীয় রাজশক্তিকেই বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু টিপু সুলতান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাঁর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
- ওয়েলেসলিও কর্নওয়ালিশের মতো ইঙ্গ-মারাঠা-নিজাম’ মৈত্রীচুক্তিকে বজায় রাখতে চেয়েছিলেন।এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে মারাঠা ও নিজাম ইংরেজদের সঙ্গে মিলিত হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
- এই সময় টিপুর সঙ্গে মরিশাসের ফরাসি গভর্নরের সুসম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলে তা ইংরেজ দের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। ফলে চতুর্থ ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
1799 খ্রিস্টাব্দে সদাশিব ও মলভেলির যুদ্ধে টিপু পরাজিত হন। ফলে ইংরেজরা পুনরায় শ্রীরঙ্গপত্তনম অবরোধ করে। শ্রীরঙ্গপত্তনম রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ চলাকালীন টিপু নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের পতন ঘটে। মহীশূরের প্রাচীন হিন্দু রাজবংশের উত্তরাধিকারীকে ইংরেজরা মহীশূরের রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
পেশোয়া প্রথম মাধব রাও-এর নেতৃত্বে তারা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু 1772 খ্রিস্টাব্দে তাঁর হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায় মারাঠা শক্তির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া কিছুটা স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রথম মাধব রাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা নারায়ণ রাও পেশোয়া পদ লাভ করেন। কিন্তু এর পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারণ বশত ইংরেজদের সঙ্গে মারাঠাদের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে। যার ফল হল উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘটিত তিনটি যুদ্ধ।
❏ প্রথম ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ 1775-82 খ্রিস্টাব্দ : পিতৃব্য রঘুনাথ রাও নারায়ণ রাওকে হত্যা করে পেশোয়া পদ দখল করলে মারাঠা রাজনীতি নতুন পথে অগ্রসর হয়। বিশিষ্ট কয়েকজন মারাঠা সর্দার মৃত নারায়ণ রাওয়ের পুত্র দ্বিতীয় মাধব রাও-কে পেশোয়া বলে ঘোষণা করে রঘুনাথ রাওকে পদচ্যুত করেন। বিতাড়িত ও অপমানিত রঘুনাথ রাও ইংরেজদের সঙ্গে 1775 খ্রিস্টাব্দে সুরাটের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধি স্বাক্ষরের পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পুনরায় পেশোয়া পদ লাভ করা। ওই বছরই রঘুনাথ রাও এবং ইংরেজদের মিলিত বাহিনী আরাসের যুদ্ধ-এ পেশোয়াকে পরাজিত করে।
❏ দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ 1803-05 খ্রিস্টাব্দ : নানা ফড়নবিশের মৃত্যুর পর পেশোয়ার সহযোগী হোলকার এবং সিন্ধিয়ার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এমন অবস্থায় নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও সিন্ধিয়ার পক্ষ নিলে ক্ষুব্ধ হোলকার পেশোয়া-সিন্ধিয়ার মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এমতাবস্থায় 1802 খ্রিস্টাব্দে পেশোয়া আত্মরক্ষার্থে ইংরেজদের সঙ্গে বেসিনের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এই সন্ধির দ্বারা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ইংরেজদের থেকে সুরক্ষার আশ্বাস পেলেও লর্ড ওয়েলসলির অধীনতামূলক মিত্রতা নীতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পেশোয়া এই সন্ধি সম্পর্কে অনুতপ্ত হন এবং সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেন। এর ফলশ্রুতি হিসেবেই শুরু হয় দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ। ইংরেজ বাহিনীর কাছে অসহই, ওয়াড়গাঁও, দিল্লি এবং লাসওয়ারীর যুদ্ধে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলে পরাজিত হয়। ফলস্বরূপ 1803 খ্রিস্টাব্দে সিন্ধিয়া সুরজ-অঞ্জনগাঁও এবং ভোঁসলে দেওগাঁও-এর সন্ধি স্বাক্ষর করে। যুদ্ধের শেষে পেশোয়ার মতো সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেও ইংরেজদের সঙ্গে ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ নীতি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে হারের ফলে মারাঠা শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
পদ বিলুপ্ত হয় এবং মারাঠা শাসক ইংরেজ কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ভোঁসলে ও হোলকারের সঙ্গে জোট বেঁধে মারাঠারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ শুরু হয়।
উপসংহার : তবে 1818 খ্রিস্টাব্দে অস্টি এবং কেরেগাঁওয়ের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও পদচ্যুত এবং কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন। পেশোয়া পদ বিলুপ্ত হয় মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং ভোঁসলে ও হোলকার ইংরেজদের বশ্যতা মেনে নেয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে মারাঠা শক্তির পতন ঘটে। সামরিক শক্তিই হোক বা দক্ষ নেতৃত্ব সবদিক থেকেই মারাঠা পেশোয়া এবং তার সহযোগী শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
▻ ইউরোপের নবজাগরণের প্রসঙ্গ এলেই ইটালির নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে নবজাগরণের সূচনা ঘটেছিল ইটালিতেই। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী চিন্তাধারার আলোকে ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতে বিশেষত বাংলার সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা ঘটেছিল। বাংলায় নবযুগের এই সূচনা ও বিস্তারকে ‘নবজাগরণ' বলা হয়ে থাকে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ঐতিহাসিকগণ ইউরোপীয় নবজাগরণের বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে বাংলার নবজাগরণের তুলনামূলক আলোচনা করে থাকেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ যেমন উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের দিকগুলি তুলে ধরেছেন, তেমনি অনেকে আবার বাংলা ও ইটালির নবজাগরণের বৈসাদৃশ্যগুলির দিকে আলোকপাত করেছেন।
- ➀ ইটালির নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল সমাজসংস্কার। ইটালির নবজাগরণ মধ্যযুগীয় অন্ধকার ও কুসংস্কার দূরীভূত করার দিশা দেখিয়েছিল। যা পরবর্তীকালে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
চিরাচরিত প্রথা ও অন্ধ সংস্কারগুলির মূলে কুঠারাঘাত করেছিল। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এইসকল ভ্রান্ত ধারণাগুলি ভাঙতে শুরু করে। পরবর্তী সময় এই ধ্যানধারণা ভারতের সর্বত্র বিস্তত হয়।
- ② ইটালির নবজাগরণে স্বাধীন যুক্তিবাদী চিন্তাধারার বিকাশ লক্ষ করা গিয়েছিল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে ইটালির মনীষীরা নিজেদের স্বাধীন চিন্তাধারার দ্বারা সেদেশের জনগণের মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিলেন।
- ③ ইটালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল লাতিন ও গ্রিক সাহিত্য। সেদেশের নবজাগরণের ফলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষত কথ্যসাহিত্যের প্রসার ঘটতে থাকে।
প্রধানত সংস্কৃত, ফরাসি এবং আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের বিকাশ।
- ④ ইটালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স নগরীর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই নগরীটিকে কেন্দ্র করেই ইটালির নবজাগরণের সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটেছিল।
❏ ইটালি ও বাংলার নবজাগরণের মধ্যে বৈসাদৃশ্য :
- ① ইটালির নবজাগরণ ব্যাপকতার দিক থেকে বাংলার নবজাগরণের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। ইটালির নবজাগরণে সেদেশের সমাজের সকলস্তরের মানুষ সার্বিকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়, ইটালিতে সূত্রপাত ঘটা এই নবজাগরণ কালক্রমে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
নবজাগরণকে সীমাবদ্ধ নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, বাংলার শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণিই নবজাগরণে শামিল হয়েছিল। এর পাশাপাশি এতে হিন্দুদের অবদানই ছিল অধিক। তাই ড. অনিল শীল বাংলার নবজাগরণকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন' বলেছেন।
- ② পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালির নবজাগরণ আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তবে যে পরিবেশে ফ্লোরেন্স নগরীকে কেন্দ্র করে ইটালিতে নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল সেটি ছিল স্বাধীন এবং মুক্ত।
যায়। তবে যে পরিবেশে কলকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে বাংলার নবজাগরণের বিকাশ ঘটেছিল সেটি ছিল
পরাধীন এবং সীমাবদ্ধ। কারণ, তখন বাংলা ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন।
- ③ ইটালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে গতিবেগ, উদ্যমতার প্রবাহ ছিল যথেষ্ট ইতিবাচক। আর ওই ইতিবাচক প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। আর এসবের যোগফলস্বরূপ ইটালির নবজাগরণ স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক বিস্তারলাভ করে।
মতো এখানকার নবজাগরণে গতিবেগ এবং উদ্যমতার ফারাক পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বাংলার নবজাগরণে বহুমুখী সৃজনশীলতার নিদর্শনও ছিল তুলনামূলক কম।
উপসংহার : এ কথা ঠিক যে, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই পাশ্চাত্য ভাবধারার সংস্পর্শে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যার ফলস্বরূপ বিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের বিস্তার ঘটে।
ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে বাংলার নবজাগরণের পার্থক্য থাকলেও একথা অনস্বীকার্য যে, স্থান, পরিস্থিতি, পরিবেশগত পার্থক্য উভয়কে স্বতন্ত্রতা প্রদান করেছিল।
▻ ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির মতো
ইন্দোনেশিয়াতেও ইউরোপীয় দেশগুলি প্রাধান্য বিস্তারের প্রয়াস চালিয়েছিল।
স্পেনীয়, ইংরেজ ও ডাচদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ডাচরাই সাফল্য লাভ করে
ইন্দোনেশিয়ায় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ইন্দো -নেশিয়ার মশলা বাণিজ্যে
একচেটিয়া কর্তৃত্ব স্থাপনই ছিল ডাচ সরকারের লক্ষ্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ
থেকে
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিবর্তে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ সরকারের প্রত্যক্ষ
ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়। যার অবসান হয়েছিল 1949 খ্রিস্টাব্দে
ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা অর্জন দ্বারা।
- সমগ্র দেশে মালাই ভাষা প্রচলিত থাকায় এই ভাষাই জনসাধারণের মনে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবোধের সঞ্চার করেছিল।
- 1916 খ্রিস্টাব্দে ডাচ সরকার প্রতিষ্ঠিত ভোকস্রাদ (VOLKSRAAD) নামক একটি গণসভা ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীদের রাজনৈতিক মত প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে ওঠে। যেটি সে দেশের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
- মুসলিম প্রাধান্যযুক্ত ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মকে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য ‘সারেকাৎ ইসলাম’ দল সংস্কারমূলক কার্যাবলি শুরু করে। যার ফলে সেদেশে এক ধর্মভিত্তিক জাতীয় সংহতি গড়ে উঠেছিল।
- 1920 খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা হয়। যেটি আবার ছিল এশিয়ার সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট দল। তারা মার্কসবাদকে জাতীয় সংগ্রামের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হলেও ডাচ সরকার ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
- ধর্মীয় ও ছাত্র সংগঠনগুলিও জাতীয়তাবোধের সঞ্চারের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।ভারতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ইন্দোনেশীয়দের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
স্বাধীনতা লাভ করে। সুকর্নো ও মোহম্মদ হাট্টা যথাক্রমে স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
▻ 1945 খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মানির পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ক্রিমিয়ার নিকট ইয়াল্টা প্রদেশে মিত্রপক্ষের তিন রাষ্ট্রপ্রধান মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও সোভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিন এক বৈঠকে মিলিত হন এটিই ইয়াল্টা সম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনে যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্গঠনের তিন রাষ্ট্রনায়কের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে।
বিষয়গুলি হল—
- রাষ্ট্রসংঘ গঠনের সিদ্ধান্ত।
- জার্মানি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।
- যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্গঠন।
- পোল্যান্ড সম্পর্কে সিদ্ধান্ত এবং
- সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত।
উপসংহার : ইয়াল্টা সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই সম্মেলনে দূরপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী করে তুলেছিল। ফলস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়ন কালক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রতি দ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়।
▻ 1949 খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা অর্জনের কিছু দিনের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হয়। কিন্তু বহু জাতি ও ধর্ম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় ঐক্য সংকটের মুখে পড়ায় এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ফলে 1956–58 খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে একটি ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এই ব্যবস্থাটি পরিচালিত গণতন্ত্র বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
1958 খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্টদের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. সুকর্নোর ক্ষেত্রে সংগঠিত রাজনৈতিক সমর্থনের ব্যাপারটি শিথিল ছিল। ড. সুকর্নোর লক্ষ্য ছিল অখণ্ড সুসমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্রীয় দল গড়ে তোলা। কিন্তু তাঁর এই উদ্দেশ্য 1960 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি শক্তি গঠন করার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলির এমনকি কমিউনিস্ট দলের সমর্থনেরও ড. সুকনোর প্রয়োজনীয়তা ছিল। সংগঠিত শক্তির সমর্থন না থাকায় ড. সুকর্নো সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হন। কেন-না বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে একটি ভারসাম্য গড়ে তোলা পর্যন্ত তাঁকে সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছিল। এ কারণে ড. সুকর্নো PNI (ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদী দল), PKI (ইন্দোনেশীয় কমিউনিস্ট দল) এবং নাদাতুল উলেমা প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের সমর্থন আশা করেছিলেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের পরি প্রেক্ষিতে ড. সুকর্নো কমিউনিস্টদের সর্বদাই PNI এবং নাদাতুল উলেমার সমমর্যাদা দিতে রাজি ছিলেন। অর্থাৎ, এশিয়া মহাদেশের মুক্তিকামী নেতা থেকে একনায়ক হয়ে ওঠার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ড. সুকর্নোর প্রয়োজন ছিল একাধারে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন। রাজনৈতিক দলগুলিকে, বিশেষত কমিউনিস্টদের দমন করার অর্থ যে সেনাবাহিনীর হাতে নিরঙ্কু ক্ষমতা তুলে দেওয়া, তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।
1958-62 খ্রিস্টাব্দ সময়কালে ইন্দোনেশিয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্র সোভিয়েত
ইউনিয়নের কার্যকলাপের
দরুন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এইরূপ সংকটজনক
পরিস্থিতিতে PKI এবং ইন্দোনেশীয় প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি বোঝাপড়া হয়। 1960
থেকে PKI-এর ওপর অতিরিক্ত চাপের সূচনা হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে
প্রেসিডেন্টের অনুকূলে গৃহীত নীতির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী সুস্পষ্ট প্রাধান্য অর্জন করে,
কমিউনিস্টদের পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়। অবশেষে 1966 খ্রিস্টাব্দের
আগে একটি যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ড. সুকর্নোকে পদচ্যুত করে সেনাবাহিনী নিজ
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্রপতি হন সুহার্তো।
সুহার্তোর শাসনকালে ইন্দোনেশিয়ায় শিল্পায়ন ও গ্রামীণ উন্নয়ন হয়েছিল।
কিন্তু 1998 খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার সংস্কার আন্দোলনের চাপে সুহার্তোর পতন
ঘটে এবং হাব্বিবি ক্ষমতা দখল করেন।
মূলত দুটি চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপীয় শক্তি-সমবায় প্রতিষ্ঠিত হয় – [1] রুশ জার প্রথম আলেকজান্ডার কর্তৃক রূপায়িত পবিত্র চুক্তি (১৮১৫ খ্রি.) এবং [2] অস্ট্রীয় প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ কর্তৃক রূপায়িত চতুঃশক্তি চুক্তি (১৮১৫ খ্রি.)। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চতুঃশক্তি চুক্তির পাঁচটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়— [1] আই-লা-সাপেল সম্মেলন (১৮১৮ খ্রি.), [2] ট্রপো সম্মেলন (১৮২০ খ্রি.), [3] লাইবাখ বৈঠক (১৮২১ খ্রি.), [4] ভেরোনা বৈঠক (১৮২২ খ্রি.) এবং [5] সেন্ট পিটার্সবার্গ বৈঠক (১৮২৫ খ্রি.)।
জারের ডাকা সেন্ট পিটার্সবার্গে শক্তি-সমবায়ের পঞ্চম সম্মেলনে ইংল্যান্ড যোগ দেয়নি। তা ছাড়া গ্রিসের বিষয়ে শক্তি-সমবায়ের সদস্যদের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলে শক্তি-সমবায়ের পতন ঘটে মে, ১৮২৫ খ্রি.। ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে, “ইউরোপীয় শক্তিগুলি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে সিদ্ধান্ত নেয় যে, আর কোনোভাবেই ফরাসি বিপ্লব বা নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান ঘটতে দেওয়া হবে না। এই উদ্দেশ্যে তারা ‘ইউরোপীয় শক্তি-সমবায়’ গড়ে তোলে।”
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে গ্যারিবল্ডির অবদান : ইটালির ঐক্য আন্দোলনে যে তিনজন প্রবাদ প্রতিম পুরুষ অসামান্য অবদানের স্বাক্ষর রাখেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বীর দেশপ্রেমিক গ্যারিবল্ডি (১৮০৭–১৮৮২ খ্রি.)। গ্যারিবল্ডি ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাৎসিনির সংস্পর্শে এসে ইয়ং ইটালি দলের
সদস্য হন। তিনি ম্যাৎসিনির নেতৃত্বে স্যাভয়-এর বিদ্রোহে (১৮৩৪খ্রি.) যোগ দিলে তাঁর প্রাণদণ্ডের নির্দেশ হয়। ফলে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। ১৮৪৮-এর বিপ্লব: ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইটালিতে বিপ্লব শুরু হলে গ্যারিবল্ডি ইটালিতে ফিরে আসেন এবং রোমে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ম্যাৎসিনির অন্যতম সহকারী হিসেবে
গ্যারিবন্ডি ‘লাল কোর্তা’ নামে সেনাদল গঠন করে দক্ষিণ ইটালির সিসিলি ও নেপল্স অভিযান করেন। সেখানকার বুরবোঁ রাজবংশকে পরাস্ত করে তিনি সিসিলি ও নেপল্স জয় (১৮৬০ খ্রি.) করেন। গ্যারিবন্ডি সিসিলি ও নেপল্স-এ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ক্যাভুর উপলব্ধি করেন যে, ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ এই প্রজাতন্ত্র মেনে নেবে না। এতে ইটালির ঐক্যের ক্ষতি হবে। এজন্য পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। দেশপ্রেমিক গ্যারিবল্ডি যুদ্ধ এড়িয়ে সিসিলি ও নেপল্স ইমান্যুয়েল-এর হাতে তুলে দিয়ে নিজে ক্যাপেরেরা দ্বীপে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান।
রাজ্যটি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।
অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্য/কারণ : ইটালি কর্তৃক অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণের বিভিন্ন উদ্দেশ্য বা কারণ ছিল। যেমন—
- ইটালি ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ করলেও অ্যাডোয়ার যুদ্ধে ইটালি পরাজিত হয়। পরবর্তী কালে মুসোলিনি অ্যাবিসিনিয়া দখলের মাধ্যমে এই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্যোগ নেন।
- ইটালির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান, খাদ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতির প্রয়োজনে মুসোলিনি ইটালির ভৌগোলিক সম্প্রসারণ ঘটানোর উদ্যোগ নেন।
- ইটালিতে শিল্পের বিকাশ ঘটলে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিক্রির জন্য মুসোলিনি অ্যাবিসিনিয়ার দিকে নজর দেন।
- অ্যাবিসিনিয়ার অবস্থান ছিল ইটালির সাম্রাজ্যভুক্ত সোমালিল্যান্ড ও ইরিত্রিয়ার মাঝখানে। মুসোলিনি যে অখণ্ড পূর্ব আফ্রিকা রাজ্য গঠনের পরিকল্পনা করেন তার জন্য অ্যাবিসিনিয়া দখলের প্রয়োজন হয়।
▻ নাৎসি নেতা হিটলার জার্মানির শাসনক্ষমতা দখলের পর ভার্সাই সন্ধির তোয়াক্কা না করে জার্মানির সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দিকে মন দেন।
ইঙ্গ-জার্মান নৌ-চুক্তি : হিটলার ইংল্যান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের দ্বারা জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নেন। জার্মানির সামরিক শক্তিবৃদ্ধিতে কোনো বাধার সৃষ্টি না করে ইংল্যান্ড ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির সঙ্গে ইঙ্গ-জার্মান নৌ-চুক্তি স্বাক্ষর করে। ইঙ্গ-জার্মান নৌ-চুক্তি হিটলারের একটি বড়ো কূটনৈতিক সাফল্য ছিল। চুক্তির ফলে–[1] জার্মানি ব্রিটেনের সহানুভূতি লাভ করে। [2] ইংল্যান্ড জার্মানির পক্ষে থাকায় জার্মানির অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের প্রতিবাদ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। [3] হিটলার ফ্রান্সকে ইংল্যান্ডের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মিত্রহীন করে দেয়। [4] ফ্রান্স নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে আত্মরক্ষামূলক চুক্তি ১৯৩৫ খ্রি. স্বাক্ষর করে।
ইটালির অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ : ইটালির অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়ে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল খুবই লজ্জাজনক। ইতালীয় ও অ্যাবিসিনীয় সেনাদলের মধ্যে এক খণ্ডযুদ্ধের (১৯৩৪ খ্রি.) ঘটনার জন্য অ্যাবিসিনিয়ার কাছে ইটালি নিঃশর্ত ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অ্যাবিসিনিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ১৫ সদস্যের এক মীমাংসা কমিটি গঠন করে। জাতি সংঘের মীমাংসা কমিটিকে উপেক্ষা করে ইতালীয় বাহিনী ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ৩ অক্টোবর অ্যাবিসিনিয়া আক্রমণ করলে জাতিসংঘ ইটালিকে ‘আক্রমণকারী’ বলে ঘোষণা করে।
ইটালির সঙ্গে বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ তার সদস্যরাষ্ট্রগুলিকে নির্দেশ দেয়। অধিকাংশ সদস্য এই নির্দেশ মান্য করলেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স আন্তরিকতার সঙ্গে এই নির্দেশ পালন করেনি। এই পরিস্থিতিতে ইটালি অ্যাবিসিনিয়া দখল (১৯৩৬ খ্রি.) করে নেয় এবং ইটালির রাজা ‘অ্যাবিসিনিয়ার সম্রাট’ বলে ঘোষিত হন। ইটালি ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সদস্যপদ ত্যাগ করে।
ইটালির আগ্রাসন প্রতিরোধে জাতিসংঘ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।
ইংল্যান্ডের শিল্পায়ন | মহাদেশীয় শিল্পায়ন |
---|---|
ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় তাদের শিল্পকে বিশেষ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়নি। | ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে ইংল্যান্ডের পরে এবং প্রায় একই সঙ্গে শিল্পায়ন ঘটায় তারা শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়। |
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইংল্যান্ডের সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য থাকায় ইংল্যান্ড সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং সেখানকার বাজারে শিল্পপণ্য বিক্রির সুযোগ পেয়েছিল। | ইংল্যান্ডের মতো সুবিশাল উপনিবেশ মহাদেশীয় দেশগুলি না থাকায় তারা কাঁচামাল সংগ্রহ বা শিল্পপণ্য বিক্রির উপযুক্ত বাজার পায়নি। |
ইংল্যান্ড তার নিজস্ব আবিষ্কারগুলির মাধ্যমে শিল্পবিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়। | মহাদেশীয় দেশগুলি ইংল্যান্ডের যন্ত্রপাতিগুলি কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ দেশে শিল্পায়ন ঘটায়। |
ইংল্যান্ডের শিল্পের প্রসারে ব্যক্তিগত পুঁজির প্রধান ভূমিকা ছিল, সেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল গৌণ। | ইউরোপের অন্যান্য দেশের শিল্পায়নে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। |
পেলে রাষ্ট্রপতিকে অপসারিত করা যায়।
▻ ভারতে ইংরেজ কোম্পানির শাসনের মূল ভিত্তি ছিল সিভিল সার্ভিস। প্রথমদিকে কোম্পানি ছিল নিছক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রধানত মধ্যবিত্ত ও সাধারণ শ্রেণি থেকেই এই কর্মচারীরা নিযুক্ত হতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের অভিজাত পরিবারের সদস্যদের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার উচ্চপদে নিয়োগ করা হতে থাকে। লন্ডনে অবস্থিত ‘বোর্ড অফ ডিরেক্টরস’-এর মাধ্যমে এই নিয়োগ সংক্রান্ত কাজকর্ম হত। তবে পরবর্তীকালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সিভিলিয়ান’ নিয়োগের ব্যবস্থা চালু হয়।
লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগ : লর্ড ওয়েলেসলিও নবীন কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে তৎপর ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ গড়ে তোলেন। এই কলেজের মাধ্যমে তিনি সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, আবেগ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন। তবে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ কিছুদিনের মধ্যেই ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ হয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে হেইলবেরি কলেজ সিভিলিয়ানদের শিক্ষাপ্রদানের জায়গা হিসেবে পরিচিতি পায়। যদিও এই কলেজও পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এই সর্বোচ্চ পদের নাম পরিবর্তন করে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (Indian Civil Service) করা হয়। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়েই ঔপনিবেশিক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মচারীদের নিয়োগ করা হত।
ইটালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুরের ভূমিকা : বিদেশি শক্তিগুলিকে বিতাড়িত করে খণ্ডবিখণ্ড ইটালির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাঁরা অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইটালীর রাজ্য পিডমন্টের প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর (১৮১০-'৬১ খ্রি.)। বাস্তববাদী ক্যাভুরের মতাদর্শ ছিল—[1] ইটালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে বিদেশি সাহায্য গ্রহণ করা এবং [2] পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার স্যাভয় রাজবংশের অধীনে ইটালিকে ঐক্যবদ্ধ করা।
বিদেশি শক্তির সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ক্যাভুর ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৫-৫৬ খ্রি.) পিডমন্টের বাহিনীকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাঠিয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সহায়তা করেন। ক্যাভুর ফ্রান্সের সঙ্গে প্লোমবিয়ের্সের গোপন চুক্তির (১৮৫৮ খ্রি.) স্বাক্ষর করেন। পিডমন্ট ফ্রান্সের সহায়তায় অস্ট্রিয়াকে ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনো-র যুদ্ধে পরাজিত করে এবং লম্বার্ডি দখল করে। ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধির (১৮৫৯ খ্রি.) দ্বারা পিডমন্টের সঙ্গে লম্বার্ডি ও মিলান যুক্ত হয়। তবে কয়েকটি ঘটনায় রাজার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাভুর পদত্যাগ করেন।
▻ ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯ খ্রি.) আগে ইউরোপের মানুষ রাজতন্ত্রের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য প্রকাশ করত। বিভিন্ন জাতিকে পদানত করে সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটানোই ছিল সে যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ইউরোপে জাতীয়তাবাদী ধারণার বিকাশ : বিপ্লবের পরবর্তীকালে ইউরোপে পরিস্থিতি পালটে যায় এবং রাজতন্ত্র বিরোধী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ফ্রান্সে জাতীয়তাবাদ ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারী রাজা ও রাজতন্ত্রের পরিবর্তে দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত্য জানাতে শুরু করে। এভাবে তাদের মনে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের জন্ম হয়। ফ্রান্সের ‘জাতীয় সভা’ ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে পিতৃভূমি বিপন্ন' বলে ঘোষণা করলে ফরাসিদের মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটে। দেশে একই ধরনের আইনকানুন চালু হলে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ আরও তীব্র হয়।
উদ্দেশ্য: (i) স্যাডোয়ার যুদ্ধে (১৮৯৬ খ্রি.) আবিসিনিয়ার কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ তোলা (ii)
(ii) বিশ্বমাঝে ইতালিকে এক উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য শক্তিশালী বিদেশনীতি গ্রহণ করা। (iii) ইতালিবাসীর ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি রক্ষা করা। (iv) সাম্যবাদী প্রভাব থেকে ইতালিকে মুক্ত রাখা।
প্রথমদিকে ফ্যাসিস্ট দল গড়ে তোলার লক্ষ্য ছিল ইতালির প্রচলিত বিভিন্ন আইনকানুন ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে সাম্যবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। ফ্যাসিবাদের মূল উদ্দেশ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রই সব, এখানে ব্যক্তি বিশেষের কোনো স্থান নেই। ফ্যাসিবাদী দলের সদস্যরা মনে করত, “রাষ্ট্রই সকল শক্তির আধার, রাষ্ট্রের বাইরে কিছু নেই এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও কিছু নেই” (Everything in the ate, nothing outside the state and nothing against the State) |
ও ফ্রান্স জার্মানির কিছু দাবি মেনে নিতে চাইলে উদ্ভব ঘটে তোষণনীতির। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছে নাতসিবাদ ও সাম্যবাদ দুই-ই ছিল বিপজ্জনক; কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে তাদের কাছে সাম্যবাদ ছিল বেশি বিপজ্জনক। অর্থাৎ সাম্যবাদের অগ্রগতির প্রতিরোধকারী শক্তি হিসেবে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তোষণনীতির দ্বারা জার্মানিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ইতালি যাতে জার্মানির সঙ্গে জোট বাঁধতে না পারে তার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ইতালির প্রতি অধিক তোষণনীতি গ্রহণ করে জাতিসংঘের সদস্য হয়েও ইংল্যান্ড, ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে সরব হয়নি।
তোষণনীতির ফলাফলঃ ইতালির প্রতি ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের তোষণনীতির সুযোগ নিয়ে বিনা প্রতিরোধে মুসোলিনি একের পর এক ভূখণ্ড দখল করেন। হিটলারও তাঁর আগ্রাসী লক্ষ্য নিয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে যোগ দেন ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স তাঁকে বাধা দিতে আগ্রহী নয় দেখে হিটলার অস্ট্রিয়া দখলে উৎসাহিত হন। তিনি একটি ভ্রান্ত তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে অস্ট্রিয়ার ওপরে কতকগুলি অবাস্তব দাবি চাপিয়ে দেন এবং কয়েক মাস পরেই জোর করে সমগ্র অস্ট্রিয়া দখল করে নেন। চেকোশ্লোভাকিয়ার অন্তর্গত সুদেতান অঞ্চল ছিল জার্মান-অধ্যুষিত। হিটলারের আক্রমণের সম্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হয়ে চেকোশ্লোভাকিয়া রাশিয়া ও ফ্রান্সের সাহায্য প্রার্থনা করলে এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এমতাবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন টলারের সঙ্গে এক আপস আলোচনা শুরু করেন। ফ্রান্সও এই আলোচনায় যোগদান করে। অতঃপর মুসোলিনির মধ্যস্থতায় মিউনিখ শহরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের, হিটলার ও মুসোলিনির মধ্যে মিউনিখ চুক্তি সম্পাদিত (১৯৩৮ খ্রি., ২৯ সেপ্টেম্বর)। এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুসারে সুদেতান অঞ্চল জার্মানিকে দেওয়া হয়। এর অল্পকালের মধ্যেই সমগ্র চেকোশ্লো ভাকিয়া দখল করে নেন এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের তোষণনীতির চূড়ান্ত পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
ভারতের বস্ত্রশিল্পের অবনতির কারণ :
- শুষ্ক বৈষম্য : ভারতে বিলাতি কাপড়ের প্রবেশের পথ প্রশস্ত করার জন্য অবাধ বাণিজ্যের অজুহাতে ব্রিটেন থেকে আমদানিকৃত মিলের কাপড়ের ওপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে ভারতের রপ্তানিযোগ্য শিল্পজাত পণ্যের ওপর ব্রিটেনে চড়া হারে শুল্ক বসানো হয়। অর্থনীতিবিদ রমেশচন্দ্র দত্তের মতানুসারে, “ভারতীয় বস্ত্র রপ্তানির ওপর ১০% শুল্ক চাপানো হলেও ব্রিটিশ সুতিবস্ত্র আমদানির ওপর মাত্র ২% শুল্ক চাপানো হয়েছিল।”
- সস্তা ও শৌখিন বস্ত্র: ম্যাঞ্চেস্টারের মিলে তৈরি কাপড় দামে সস্তা ও শৌখিন হওয়ায় খুব সহজেই তা ভারতীয় ক্রেতাদের মন জয় করে নেয়। ফলে ভারতের তাঁতশিল্পে এক অভূতপূর্ব সংকট দেখা দেয়।
- ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব: জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের মতে ভারতে অবশিল্পায়নের প্রধান কারণ ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের অভিঘাত। শিল্পবিপ্লবের সুবাদে উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডে অতি অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ বস্ত্র উৎপাদন শুরু হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় কম হয় ও ব্রিটিশ বস্ত্র ব্যবসায়ীরা সস্তায় বস্তু বিক্রয় করার সুযোগ পায়।
- দাদনের বিনিময়ে চুক্তি: কোম্পানির কর্মচারী ও দেশীয় এজেন্টগণ বলপূর্বক তাঁতিদের অর্থ দাদন দিয়ে নির্দিষ্ট মূল্যে কাপড় বুনে দিতে বাধ্য করে। ফলে তাঁতিদের স্বাধীনতা ও মুনাফা অর্জনের সুযোগ কমে আসে।
- কাঁচা তুলোর ওপর ব্রিটিশের একচেটিয়া কর্তৃত্ব: একচেটিয়া তুলোর ব্যাবসা ইংরেজদের হাতে থাকায় তাঁতিদের চড়া দামে তুলো কিনতে হত আর কম দামে সেই তুলো থেকে তৈরি বস্ত্র কোম্পানিকে বিক্রি করতে হত। এইভাবে তাঁতিরা সর্বস্বান্ত হয়ে তাঁত বোনা ছেড়ে দেয়।
- মন্বন্তর ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ১৭৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দের ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বহু তাঁতির মৃত্যু হলে তাঁতশিল্প ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় এবং বস্ত্রশিল্পকেন্দ্রিক শহর, যেমন— সিলেট, রংপুর, মালদা, নদিয়া, চট্টগ্রাম ইত্যাদির ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যায়।
- উদার বাণিজ্য : ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লোপ পায় এবং উদার বাণিজ্যনীতি চালু হয়। এর ফলে ব্রিটেনের সস্তা দামের কাপড়ে ভারতের বাজার ভরে যায় এবং দেশীয় বস্ত্রশিল্প মার খায়।